.
কোন সন্দেহ নেই, গত এক যুগে দেশের পুরুষ ফুটবলে কোন আকর্ষণ ও সাফল্য না থাকলেও এর বিপরীত দৃশ্য নারী ফুটবলে। সিনিয়র পর্যায়ে একটি রানার্সআপ ট্রফি ও জাতীয় বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতায় আটটি শিরোপা জিতেছে নারী ফুটবলাররা। পক্ষান্তরে পুরুষদের জাতীয় দল সিনিয়র পর্যায়ে ২টি রানার্সআপ ট্রফি ও বয়সভিত্তিক ফুটবলে দুটি চ্যাম্পিয়ন ট্রফি ও ১টি রানার্সআপ ট্রফি জিতেছে। তুলনামূলক বিচারে পুরুষদের চেয়ে নারী ফুটবলাররা দেশকে বেশি সাফল্য এনে দিলেও বিস্ময়করভাবে তারা পুরুষদের চেয়ে বেশি অবহেলিত ঘরোয়া ফুটবলে। যেখানে জাতীয় দলের মানহীন ফুটবলাররা নিয়মিত ঘরোয়া লীগ খেলে প্রয়োজনের চেয়েও বেশি পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন, সেখানে জাতীয় দলের মানসম্পন্ন নারী ফুটবলাররা গত ১১ বছরে মাত্র চারবার লীগ খেলার সুযোগ পেয়েছেন এবং সেটা কম পারিশ্রমিকে।
এ পর্যন্ত মাত্র চারবার মহিলা ফুটবল লীগ অনুষ্ঠিত হয়েছে (২০১১, ২০১৩, ২০১৯ ও ২০২০ সালে)। এর মধ্যে ছয় বছর আবার বিরতি ছিল। পুরুষদের প্রিমিয়ার ফুটবল লীগের দলগুলো প্রথম দুটি লীগে অংশ নিয়েছিল। ফলে সে দুটি লীগের খেলা হয়েছিল জমজমাট ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। ২০১১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর প্রথম লীগ শুরু হয়েছিল। দুই গ্রুপে অংশ নেয়া দলগুলো ছিলÑ ‘ক’ গ্রুপে : শেখ জামাল ধানম-ি, ওয়ারী, আরামবাগ ও দিপালী যুব সংঘ; ‘খ’ গ্রুপে : মোহামেডান, ব্রাদার্স ইউনিয়ন, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ও ফরাশগঞ্জ ক্লাব। বাজেট ছিল সাড়ে চার লাখ টাকা। স্পন্সর ছিল ওয়ালটন। টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন শেখ জামাল ও রানার্সআপ মোহামেডানকে যথাক্রমে ৫০ ও ৩০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছিল।
২০১৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মাঠে গড়িয়েছিল ‘ওয়ালটন এ্যানড্রয়েড প্রিমো ঢাকা মহানগরী মহিলা ফুটবল লীগ’-এর দ্বিতীয় আসর। সেবারও অংশ নিয়েছিল আটটি দল। চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আবাহনী, রানার্সআপ মোহামেডান। লীগের বাজেট ছিল সাড়ে ৫ লাখ টাকা। অংশ নেয়া প্রতিটি দলই পার্টিসিপেশন মানি হিসেবে ৩০ হাজার টাকা এবং লীগের চ্যাম্পিয়ন দল ৫০ হাজার টাকা, রানার্সআপ দল ৩০ হাজার টাকা করে পেয়েছিল। এরপর দীর্ঘ ছয় বছর বাফুফের খামখেয়ালিতে মহিলা লীগ অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে ঘরোয়া লীগ না হওয়াতে ফুটবলারদের অর্থ আয়ের পথ বন্ধ থাকলেও নিজেদের প্রতিভা দেখিয়ে বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলে ঠাঁই করে নেয়া ফুটবলাররা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাফল্যের পুরস্কার হিসেবে কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক পুরস্কার পেয়ে নিজেদের পরিবারকে সহায়তা করার সুযোগ পায় নারী ফুটবলাররা। তবে এটাই যথেষ্ট নয়। তাই তারা ক্লাব ফুটবল লীগে খেলতে মুখিয়ে ছিল।
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগে যে দলগুলো খেলে, তারা না এগিয়ে আসলে নারী ফুটবল লীগ পেশাদারিত্বের কাঠামোয় আসবে না। কয়েক বছর আগে এমন মন্তব্য করেছিলেন বাফুফে নারী উইংয়ের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ২০১৯ সালে আবারও লীগ অনুষ্ঠিত হয়। তবে একমাত্র বসুন্ধরা কিংস বাদে প্রতিষ্ঠিত কোন ক্লাব এই লীগে খেলতে অনীহা প্রকাশ করে। মানহীন পাড়া-মহল্লা-মফস্বলের অখ্যাত ৬টি ক্লাব এতে অংশ নেয়। আর্থিকভাবে শক্তিশালী হওয়ায় কিংস জাতীয় দলের প্রায় ৯০ শতাংশ খেলোয়াড় কিনে নেয়। ফলে যা হবার তাই হয়, একতরফা খেলে কিংস শিরোপা জেতে। ১২ ম্যাচের প্রতিটিতেই জিতে তারা। ১১৯ গোল করলেও একটি গোলও হজম করেনি! প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই তারা ১২-১৩টি করে গোল করে। ফলে তখনই এ নিয়ে সমালোচনা হয়। দাবি ওঠে পরেরবার যেন মানহীন ও একপেশে লীগ না হয়। প্রতিটি দলেই যেন ভারসাম্যপূর্ণ হয় এবং প্রতিষ্ঠিত ক্লাবগুলো যেন অংশ নেয়। কিন্তু ক্লাবগুলো অসহযোগিতামূলক মনোভাবের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ায় বেচারা বাফুফে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ফলে ২০২০ সালের লীগও হয় আগের বছরের লীগের ‘কার্বন কপি’। তবে জাতীয় দলের বয়সভিত্তিক জুনিয়র খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া নতুন দল এআরবি স্পোর্টিং ক্লাব কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলে। কিন্তু কিংস চ্যাম্পিয়ন হওয়া থেকে আটকাতে পারেনি। ১৪ খেলার প্রতিটিতেই জেতা কিংস এবার ১২৩ গোল করার বিপরীতে মাত্র ১টি গোল হজম করে। একটি ম্যাচে তারা ২০-০ গোলে জেতে। এভাবে মুড়িমুরকির মতো প্রতি ম্যাচে কিংসের গোল করা নিয়ে আবারও সমালোচনার ঝড় ওঠে। এবার দাবি ওঠে পরের লিগে প্রতিষ্ঠিত ক্লাবগুলোর মহিলা লীগে খেলা বাধ্যতামূলক করার এবং প্রতিটি দলে জাতীয় দলের ৫ জনের বেশি ফুটবলার না নিয়ে ‘পুলপ্রথা’ করার।
এই প্রেক্ষিতে এবার বাফুফে কঠোর হয়েছে। প্রিমিয়ার লীগের ক্লাবগুলোকে মেয়েদের ফুটবল দল গড়ার শর্ত দিয়েছে তারা। সেই হিসেবে মেয়েদের দল গড়তে শুরু করেছে প্রিমিয়ারের ক্লাবগুলো। মোহামেডান, আবাহনী, শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র, ফরাশগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাবের নাম শোনা গেছে। প্রিমিয়ার ফুটবল লীগে খেলা অনেক ক্লাবই বাফুফেতে চিঠি দিয়ে মেয়েদের দল গঠনে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। গত মহিলা লীগে অনেক ক্লাবই তাদের ফুটবলারদের সঙ্গে পারিশ্রমিক নিয়ে লিখিত চুক্তি করেনি এবং ঠিকমতো পারিশ্রমিকও দেয়নি। অথচ বাফুফে সেবার এসবের কিছুই নজরদারি করেনি। এবারের লীগেও যে এমন কিছু হবে না, তার কোন নিশ্চয়তাও বাফুফে এবার দেয়নি।
দক্ষিণ এশিয়ান নারী ফুটবলের বয়সভিত্তিক পর্যায়ে অন্যতম পরাশক্তি বাংলাদেশ। কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সে অর্থে আসছে না সাফল্য। জাতীয় দল হিসেবে এখন ঠিক ছন্দ খুঁজে পাচ্ছেন না মারিয়া-সাবিনারা। এই ব্যর্থতার পেছনে পেশাদার লীগের অভাবই দায়ী, যা ঠিকমতো আয়োজন করতে পারছে না বাফুফে!