
সাবেক তারকা ফুটবলার ‘গুরু খ্যাত’ কোচ ওয়াজেদ গাজী আর নেই। সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে ৮৭ বছর বয়সে চলে গেছেন তিনি না ফেরার দেশে (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে যাশোরের বারান্দিপাড়ায় মেয়ের বাড়িতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বার্ধক্যজনিত কারণে দীর্ঘদিন ধরে নানা রোগে ভুগছিলেন তিন সন্তানের জনক ওয়াজেদ গাজী।
বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক এই কোচের মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নেমে আসে দেশের ফুটবল অঙ্গনে। বর্ণাঢ্য খেলোয়াড়ী জীবন থেকে অবসর নেয়ার পর ঢাকার ক্লাব পর্যায়ে সুনামের সঙ্গে কোচের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তার হাতে গড়া অগণিত ফুটবলার তারকাখ্যাতি নিয়ে একসময় মাঠ মাতিয়েছেন ঢাকার ফুটবলে। গাজীর মৃত্যুতে যশোরের ক্রীড়াঙ্গনেও শোক বিরাজ করছে ।
গতকাল বাদ জোহর যশোর ঈদগাহ মাঠে মরহুমের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে যশোর শামস-উল-হুদা স্টেডিয়ামে বিভিন্ন ক্রীড়া সংগঠন ও ক্রীড়া ব্যক্তিত্বদের পক্ষ থেকে মরহুমের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।
ফুটবলার হিসেবে ১৯৫৮ সালে কিশোর বয়সে স্পোর্টিং ইউনিয়নের হয়ে কলকাতা লীগে অভিষেক ঘটে ওয়াজেদ গাজীর। ১৯৬৩ সালে খেলেছেন কলকাতা মোহামেডানে। এরপর দেশে ফিরে পূর্ব পাকিস্তান বিজি প্রেস, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, ইপিআইডিসি (বর্তমানে বিজেএমসি) ও মোহামেডানে খেলেন দাপটের সঙ্গে। তৎকালীন জাতীয় দলেরও অপরিহার্য ফরোয়ার্ড ছিলেন তিনি। তবে ক্যারিয়ারের স্বার্ণালি সময় কাটিয়েছেন পাঁচবারের লীগ চ্যাম্পিয়ন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ইপিআইডিসির (পরবর্তীতে বিআইডিসি, বিজেআইসি ও বিজেএমসি) জার্সিতে। ১৯৭৮ সালে কোচ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সবদলেই তিনি কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেন। ফুটবল অঙ্গনে খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে দীর্ঘ চল্লিশ বছর দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করেন। পরবর্তীতে বয়সের কারণে ২০১২ সালে তিনি অসুস্থ অবস্থায় যশোরে বড় মেয়ের বাড়িতে থাকতেন। আর মেয়ের কোলেই মৃত্যু নামক অমোঘ নিয়তির কাছে হার মানলেন এক সময়কার টগবগে ফুটবলার সবার প্রিয় ওয়াজেদ গাজী।
বছর কয়েক আগেও ফুটবল অঙ্গনে তিনি ছিলেন প্রাণচাঞ্চল্য এক মুখ। কিন্তু অসুস্থতার কারণে অনেকটাই আড়ালে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন আর্থিক টানাপোড়েনে। অসুস্থ অবস্থায় পড়ে থাকা ওয়াজেদ গাজীর কোন খোঁজ-খবরও কেউ রাখেননি। অসাধারণ ব্যক্তিত্বের কারণে কারও কাছে হাত পাততেও শোনা যায়নি। সবাই তাকে ভুলে গেলেও অসচ্ছল পিতাকে ফেলতে পারেননি তার বড় মেয়ে। ওয়াজেদ গাজীর ঠিকানা ছিল বড় মেয়ে শাহানা ইয়াসমিন বুলুর বাড়িতে। জীবনটা ফুটবলের পেছনে বিলিয়ে দিতে গিয়ে নিজ সংসারটাকে ভালভাবে গোছাতে পারেননি। নানা ঘটনাপ্রবাহে সংসারটাও তার তছনছ হয়ে পড়েছিল স্ত্রী মারা যাবার পর। যশোর শহরে নিজের যে বাড়িটি ছিল দুই ছেলে মিলে সে বাড়িটিও বিক্রি করে দিয়েছিল অর্থসঙ্কটে। তার দুই ছেলের নাম হাসান গাজী ও গাজী আক্তার হোসেন। বড় মেয়ে শাহানাও যে আর্থিকভাবে খুব একটা সচ্ছল তা নয়। টানাটানির সংসার। তবুও প্রিয় পিতাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন নিজের বাড়িতে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মেয়ে আর নাতিপুতিরাই তার দেখভাল করতেন।
ফুটবলার গড়ার কারিগর হিসেবে পেয়েছিলেন ‘গুরু’ খ্যাতি। জীবনের সবকিছু ভুলে ফুটবলকেই আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন মনের খোরাক হিসেবে। আর তাই যতদিন শরীর কুলিয়েছে ততদিন ফুটবলের উন্নয়নেই নিবেদিত ছিলেন তিনি। অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত জীবনের বড় একটা সময় পার করেন ফুটবলের পেছনে। ফুটবলের দুর্নিবার আকর্ষণে বাড়িঘর আর সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ভুলে ঠিকানা গড়ে তুলেছিলেন ঢাকার মতিঝিল ক্লাব পাড়ায়। ক্লাবেই থাকতেন, ঘুমুতেন। এভাবেই চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় পার করেন তিনি। কিন্তু জীবন তো আর সবসময় একই গতিতে চলে না। বয়সের ভারে অসুস্থ হয়ে ক্লাব আর ফুটবলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে যেতে হয় তাকে যশোরে।
প্রফেশনাল কোচ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর মাঝারি দলগুলোতে কোচিং করাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন সদালাপী ওয়াজেদ গাজী। তবে পুরনো ঢাকার রহমতগঞ্জ, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, ভিক্টোরিয়া, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের কোচ থাকাকালীন দেশের ফুটবলকে উপহার দেন একাধিক প্রতিভাবান তরুণ ফুটবলার। মূলত তখন থেকেই ‘গুরু’ খ্যাতি লাভ করেন। বড় দল ব্রাদার্স ইউনিয়ন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রেরও কোচের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সর্বশেষ বিজেএমসির উপদেষ্টা কোচ ছিলেন তিনি।
প্রসঙ্গত কিশোর বয়সে বাবার চাকরির সুবাদে পশ্চিমবঙ্গের বারাসাতে থাকতেন তিনি পরিবারের সঙ্গে। সেই সুবাদে কলকাতা লীগে তার অভিষেক ঘটেছিল ৬৩ সালে। ঢাকায় কোচ হিসেবে অভিষেক রহমতগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে। টানা ৮৩ সাল পর্যন্ত রহমতগঞ্জেই কাটান। এরপর দুই বছর আরামবাগ ক্লাবের কোচ ছিলেন। ৮৬ থেকে ৮৮ সাল পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৭ সালে তিনি জাতীয় দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পান। বিজেএমসির উপদেষ্টা কোচ থাকা অবস্থায় ২০১২ সালে প্রথম অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে সুস্থ হয়ে আবারও মাঠে ফেরেন। কিন্তু মনোবলটা হার মেনে যায় শারীরিক দুর্বলতার কাছে। ফলে ফেরার পর আর টিকতে পারেননি বেশিদিন। আবারও অসুস্থ হয়ে পড়লে একরাশ হতাশা নিয়ে চলে যান যশোরে। আর নিজ জেলাতেই চিরতরের জন্য বিদায় নিলেন। আর কোনদিন ফিরে আসবেন না তার প্রিয় ঢাকার ক্লাব পাড়ায়।