১৯৯২ সাল। ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ফুটবল লীগের ে মোহামেডান বনাম আবাহনীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। আবাহনী ড্র করলেই চ্যাম্পিয়ন আর মোহামেডানকে চ্যাম্পিয়ন হতে হলে জয়ের বিকল্প নেই। মোহামেডান ১-০ গোলে এগিয়ে। কোন এক হাওয়াই ভাসানো খবর আবাহনীর এক গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়কে মূল একাদশে জায়গা দেয়া হয়নি। সে দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছে আবাহনীর রিজার্ভ বেঞ্চে। আবাহনীর কোচ কাজী সালাহউদ্দিন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন তাকে মাঠে নামাবেন কি না। এদিকে দর্শক গ্যালারি থেকে চাপ তাকে মাঠে নামানোর জন্য। অবশেষে দর্শকদের চাওয়ার প্রতি সম্মান দেখিয়ে দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে নামানো হয় সেই খেলোয়াড়কে।
মাত্র তিন মিনিটের ব্যবধানে মোহামেডানের জালে দুইবার বল জড়িয়ে উপস্থিত সব দর্শকদের তাক লাগিয়ে দেন। পুরো মোহামেডান গ্যালারিকে স্তব্ধ করে আবাহনীর গ্যালারিতে উঠে ম্যাক্সিকান ঢেউ। যে ঢেউ শেষ পর্যন্ত মিরপুর স্টেডিয়াম থেকে আবাহনী ক্লাবে এসে শেষ হয়। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল এবং আবাহনীর সাবেক দ্রুত গতির মাঠ কাঁপানো উইঙ্গার মামুন জোয়ার্দার। সাবেক এই তারকা ফুটবলার বর্তমানে কানাডা প্রবাসী। সম্প্রতি অল্প সময়ের জন্য দেশে এসেছিলেন। ফের বিদেশ যাওয়ার আগে টি ইসলাম তারিককে তিনি জানিয়েছেন অনেক জানা-অজানা গল্প। সে সবের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো জনকণ্ঠের পাঠকদের জন্য।
মামুন জোয়ার্দারের জন্ম চুয়াডাঙ্গা জেলায়। ছোট বেলা কেটেছে সেখানেই। স্কুল জীবন থেকেই ফুটবলের হাতে খড়ি। ঢাকার মাঠে খেলার আগে রেডিওতে ফুটবলের ধারাবিবরণী শুনতেন নিয়মিত। চুন্নু, আশিস, বাদল রায়, সালাম মুর্শেদী, লিটন, মহসিনের নাম নিয়ে যখন ভাষ্যকার তাদের গুনগানে পঞ্চমুখ থাকতেন তখন নিজেকে নিয়ে কল্পনা করতেন সে যায়গায় কিভাবে যাওয়া যায়। মাঝে মাঝে ঢাকা এলে মোহামেডান আবাহনী আর ব্রাদার্স ক্লাবে ঢুঁ মারতেন শুধু খেলোয়াড়দের এক নজর দেখার জন্য। বড় ফুটবলার হয়ে মাঠ কাঁপাবেন এমন স্বপ্নের বীজ বোনা শুরু তখন থেকেই। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বয়সভিত্তিক ফুটবল টুর্নামেন্ট দিয়ে ফুটবলের অভিষেক শুরু হলেও ১৯৮৫ সালে আজাদ বয়েজ ক্লাবের হয়েই ফুটবলের যাত্রা শুরু। একে একে চলন্তিকা, ওয়ারি এবং ভিক্টোরিয়ায় খেলে নজর কাড়েন মামুন। দুরন্ত গতির উইংগার এই মামুন দুই তিন জনকে অনায়াসে ডজ দিয়ে ক্ষিপ্র গতিতে বিপক্ষ সিমানায় ঢুকে যেতেন। অত্যন্ত বিপজ্জনক ফুটবলার ছিলেন মামুন জোয়ার্দার।
১৯৯০ সালে ঢাকা মোহামেডানের হয়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেন মামুন জোয়ার্দার। ১৯৯১ সালেই তাকে কব্জা করে নেয় আবাহনী ক্রীড়া চক্র। মোহামেডানে দুর্দান্ত খেলার পরও কেন তারা তাকে রাখেনি এ প্রসঙ্গে মামুন জানান, আসলে তারা রাখেনি বিষয় সেটা নয়। আমি চিন্তা করেছি সে সময় মোহামেডানে সাব্বির ভালো ফর্মে। আমাকে হয়তবা রিজার্ভ বেঞ্চে বসেই কাটাতে হতে পারে। সে চিন্তা করেই আবাহনী থেকে প্রস্তাব এলে আমি সেখানেই যোগ দেই। তবে কিছু ক্লাব কর্মকর্তা এবং সমর্থকদের মতে জানা যায় যে মোহামেডানের তৎকালীন কোচ নাসের হেজাজির সঙ্গে তার সম্পর্ক ভাল ছিল না বিধায় তিনি মোহামেডান থেকে আবাহনীর ডাকেই সাড়া দেন। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ যুব দলে জয়গা করে নেন মামুন। সেই থেকে জাতীয় দলে টানা আট বছর খেলেছেন। বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে সৌদি আরব, চীন, কাতারসহ বহু দেশ সফর করেছেন। তার আন্তর্জাতিক গোলের সংখ্যা নয়টি।
বর্তমানে তিনি কানাডা প্রবাসী। কিছুদিনের জন্য দেশে এসেছিলেন। মাঠে গিয়েছিলেন একদিন বড় এক দলের খেলা দেখতে। সেই চিরচেনা ফুটবল মাঠ আর গ্যালারি দেখে তিনি পুরাই হতাশ হয়েছেন। যে মাঠে মোহামেডান-আবাহনীর যেকোন খেলায় গ্যালারি থাকতো সমর্থক ভরা অথচ মাঠের খেলা আর সমর্থক দেখে কেবলই হতাশার নিঃশ্বাস ফেলেছেন। বর্তমান খেলোয়াড়দের খেলার মান দেখে সত্যিই খুব অবাক হয়েছেন। আরও বিস্মিত হয়েছেন খেলোয়াড়দের দেন দরবার গল্প শুনে! মামুন জোয়ার্দার জানান, তাদের সময় বড় দলের রিজার্ভ বেঞ্চের খেলোয়াড়দের মান অনেক ভাল ছিল। মূল একাদশে যায়গা করার জন্য নিজেদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা হতো। খেলোয়াড়দের দেন দরবার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন খেলোয়াড়রা টাকা পাচ্ছেন এটা সুসংবাদ। একদিন আমরাও এই টাকার জন্য লড়াই করেছি। বলা চলে তারই ফসল। দুঃখ হয় খেলার মান দেখে। ভাল খেলে টাকা নিবে এইটা ঠিক আছে কিন্তু কিছু কিছু খেলোয়াড়দের খেলা দেখে যখন শুনেছি তাদের মূল্য চল্লিশ/পঞ্চাশ লাখ তখন একজন খেলোয়াড় হিসেবে কষ্ট পেয়েছি।
আপনি কত টাকা পেয়েছিলেন ক্লাব পর্যায়ে? উত্তরে মামুন বলেন, আবাহনীর সঙ্গে ১৯৯১ সালে যেবার প্রথম চুক্তি হয় তখন সেটা ছিল এগার লাখ। আমাকে নয় লাখ টাকা নগদ দেওয়া হয়। সেই টাকা আমি আবাহনী ক্লাব থেকে একটা রিক্সার সিটের নিচে নিয়ে বাসায় এসেছিলাম। ফুটবল খেলে এত টাকা পাব আমি কল্পনাও করিনি। তখন থেকেই আমার মনে নাড়া দিয়েছিল। যে ক্লাব কর্মকর্তাদের আর সমর্থকদের ভালবাসায় আমরা খেলোয়াড় হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি তার প্রতিদান দেওয়া উচিত ভালভাবে। আমি মনে করি একজন খেলোয়াড়ের সেই মনোভাব থাকা দরকার। মামুন জোয়ার্দার তিনটি সাফ গেমসে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু তার আফসোস একবারের জন্য সোনা জয় করে দেশবাসীর মুখে হাসি ফোটাতে পারেননি। তবে ১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত চার জাতি ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে এবং মিয়ানমার জাতীয় দলকে ২-১ গোলে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হয়। বাংলাদেশের পক্ষে একটি নকীব এবং জয়সূচক গোলটি ছিল মামুনের। মজার ব্যাপার হলো সেই প্রতিযোগিতার প্রথম ম্যাচে মিয়ানমারের কাছে বাংলাদেশ ৪-০ গোলে পরাজিত হয়েছিল।
আলোচনা করার সময় এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, তখন আমাদের জাতীয় দলের কোচ ছিলেন অটো ফিস্টার। তিনি সেই ম্যাচ খুব ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন এবং দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে পরবর্তী খেলার আগেই সেগুলো শুধরে দিয়েছিলেন। কোচের বিষয়ে তিনি জানান, অটো ফিস্টার ছিলেন বাংলাদেশে আসা বিদেশীদের মধ্যে সব চাইতে উঁচু মানের কোচ। তিনি পরবর্তীতে বিশ্বকাপে সৌদি আরব, টোগো ও ক্যামেরুন জাতীয় দলের কোচ হয়েছিলেন। অথচ তাকে আমরা রাখতে পারেনি। ঘরোয়া ফুটবলে অনেক জয়-পরাজয়ের সাক্ষী মামুন জোয়ার্দার। তিনি জানান ১৯৯২ সালের লীগের মোহামেডান আবাহনীর শেষ ম্যাচটি অনেক কারণেই তার কাছে ঘটনা বহুল। আবাহনী ড্র করলেই চ্যাম্পিয়ন আর মোহামেডানকে চ্যাম্পিয়নের জন্য জয় পেতেই হবে। এমন সমীকরণের কয়েকদিন আগে থেকেই জোর গুঞ্জন শোনা যায় যে মামুনের সঙ্গে মোহামেডানের আঁতাত হয়েছে!
যে কারণে ওই ম্যাচে মামুনকে মূল একাদশে রাখা হয়নি। বিষয়টি মামুনকে খুব আঘাত দেয়। খেলা শুরু হয়। মোহামেডান এগিয়ে যায় ১-০ গোলে। আবাহনীর কোচ সালাহউদ্দিন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। মামুন কে নামাবেন নাকি নামাবেন না! আবাহনী নামে খ্যাত দক্ষিণ-পশ্চিম গ্যালারি থেকে মামুন কে মাঠে নামানোর জন্য সমর্থকদের জোর চিৎকার কানে ভেসে আসে কোচ এবং কর্মকর্তাদের। অবশেষে দ্বিতিয়ার্ধে মাঠে থাকা রাশিয়ান খেলোয়াড় পলিনকোভকে বসিয়ে মামুনকে মাঠে নামাতে বাধ্য হয়। মামুন সমর্থকদের সে ভালবাসার প্রতিদান দিয়েছিলেন ষোলআনা। রুমির কর্নার থেকে আসলামের মাথা ছুয়ে জনির মাথার ওপর দিয়ে বল হাওয়ায় ভেসে আসে মামুনের পায়ে। ত্বরিত গতিতে হাওয়ায় ভাসানো বলকে আঘাত করেন মোহামেডানের জাল ছোঁয়ার উদ্দেশে। বল যেন মামুনের কথা শুনেই সরাসরি আশ্রয় নেয় জালে। গগনবিদারী চিৎকার শুরু হয় আবাহনীর গ্যালারিতে। গ্যালারির চিৎকার বাতাসে মিশতে না মিশতেই তিন মিনিটের ব্যবধানে প্রায় মাঝ মাঠ থেকে একক প্রচেষ্টাই বল নিয়ে আসেন মামুন। দুই তিন জনকে কাটিয়ে সামনে একমাত্র কায়সার হামিদ। কায়সার হামিদকে বডি ডজ দিয়ে পিছনে ফেলে বড় ডি এর বাইরে থেকে কোনাকুনি শটে পরাস্থ করেন মোহামেডানের গোল রক্ষক সাইদ হাসান কানন কে। তিন মিনিটের ব্যবধানে মামুনের দুই গোল সেদিন চ্যাম্পিয়ন করেছিল আবাহনীকে। গুঞ্জন আর ভ্রান্ত ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করতে পেরেছিলেন। সেদিন যদি আবাহনী জয় না পেতো তাহলে কোচ এবং ক্লাব কর্মকর্তাদের ভ্রান্ত ধারণা তাকে সারা জীবন কুড়ে কুড়ে খেত। তাই সেদিনের জয়টা ছিল মামুনের জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া।
এটি ছাড়াও ফুটবলে আরও একটি কষ্টের কথা তুলে ধরেন মামুন। ১৯৯৭ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব খেলতে যান মালয়েশিয়াতে। সেখানে ভাল খেলে নজর কাড়েন সবার। মালয়েশিয়ার একটি ক্লাব থেকে সেখানকার লীগে খেলার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয় কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো বাফুফে আমাকে সেখানে খেলার অনুমতি দেয়নি। এরকম শুধু আমাকে নয়, জুয়াল রানা, রুমি সাব্বির মোনেম মুন্না ভাই অনেকেই বাইরে খেলার প্রস্তাব পেয়েছিলেন কিন্তু কালো হাতের ইশারায় তারাও কেউ যেতে পারেনি। তারা কেউ ভাবেনি আমাদের ক্ষতির চেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশ ফুটবলের। দেশের ফুটবলের জোয়ার আনতে হলে তিনি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে বলেন মোহামেডান-আবাহনীকে। এখনও মোহামেডান আবাহনীর রিজার্ভ সমর্থক আছে দেশে। এই দুই দল ভাল দল গঠন করলে এবং দুই দলই শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন রেসে টিকে থাকলে মাঠে সমর্থক আসবেই বলে বিশ্বাস করেন সাবেক এই তারকা। তবে সে সময়টাও বেধে দেন আগামী মাত্র পাঁচ বছর । তাছাড়া ফুটবলের উন্নতির জন্য বয়সভিত্তিক দল থাকা জরুরী। নিয়মিত জেলায় জেলায় লীগ চালু করাসহ বিভিন্ন টুর্নামেন্ট করাও আবশ্যক বলে মনে করেন।
তরুণ খেলোয়াড়দের জন্য উপদেশ দিয়ে মামুন বলেন, অনুশীলন এবং শৃঙ্খলার বিকল্প নেই। আরেকটা বিষয় হলো সাবেক এবং সিনিয়র খেলোয়াড়দের সম্মান করা। কলকাতায় চার্মস কাপে আবাহনীর হয়ে খেলেছিলেন মামুন। সেখানে এক ম্যাচে তিনি বদলি হিসেবে খেলে সুনাম কুড়িয়েছিলেন। মামুন ১৯৯২-১৯৯৪ সাল পর্যন্ত খেলেন আবাহনীতে। ১৯৯৫ সালে পাড়ি জমান মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রে। সেখানে দু’বছর খেলার পর ১৯৯৭ সালে আবার ফিরে আসেন আবাহনী ক্লাবে। ইচ্ছে ছিল সেখান থেকেই ফুটবল থেকে বিদায় নেবার। সে ইচ্ছে পুরন হয়নি। অবশেষে ২০০০ সালে মুক্তিযোদ্ধায় আবারও যোগ দেন। সে বছর মোহামেডান-মুক্তিযোদ্ধা লীগের খেলায় অশ্রুসিক্ত নয়নে ফুটবল জীবনের ইতি টেনে কানাডায় পাড়ি জমান।
কানাডায় বসবাস হলেও মনটা পড়ে থাকে দেশের মাটিতেই। স্বপ্ন দেখেন দেশের ফুটবল এগিয়ে যাচ্ছে। যোগ্য ফুটবলারদের মূল্যায়ন হচ্ছে, কুশলী ফুটবলাররা বাফুফে এবং ক্লাব কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় দেশের বাইরে খেলার সুযোগ পাচ্ছেন নিয়মিত। চোখ বুজলেই প্রায়শই ভেসে আসে সেই ৮০-৯০ দশকের ফুটবলের দৃশ্য। কানায় কানায় পরিপূর্ণ গ্যালারি। বল নিয়ে ছুটছেন মামুন জোয়ার্দার। দু’তিন জনকে কাটিয়ে ডি বক্সের কোনা থেকে বলে সজোরে আঘাত। গো ও ল, গো ও ল সমর্থকদের গগনবিদারী চিৎকার আর উল্লাসে যেনো ঘুম উধাও হয়ে যায়। আড়মোড়া ভেঙ্গে ভাবতে থাকেন সবাই একটু চেষ্টা করলেই মনে হয় আমাদের সেই হারানো ফুটবলকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।