মালার ফুটবলের নেশা ছিল স্কুলে পড়ার সময় থেকেই। ১৯৬৬ সালে মালা ক্লাস এইটের ছাত্র। সেই বয়সেই রহমতগঞ্জের হয়ে তৃতীয় বিভাগে খেলেন। রহমতগঞ্জ মাঠে বড়দের অনুশীলনে তিনি মাঠের বাইরে বসে থাকতেন। বল বাইরে গেলে জোরে লাথি দিয়ে মাঠে দিয়ে দিতেন। উদ্দেশ্য ছিল বড়দের নজরে পড়া। পরবর্তীতে মইনুল চৌধুরী ফুটবল টুর্নামেন্ট হয় সেখানে মালাদের উদয়ন ক্লাব চ্যাম্পিয়ন হয় এবং মালার খেলা সকলের নজরে পড়ে। অবশেষে রহমতগঞ্জের তৃতীয় বিভাগ দল দিয়েই ফুটবল যাত্রা শুরু করেন মালা। মালা বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন সাইমুন নাহার নাজুর সঙ্গে ১৯৯০ সালে। দুই ছেলে এক মেয়ে। মেয়ে আসমা নেহার উপমাকে বিয়ে দিয়েছেন। এক ছেলে ওয়ালিউল ইসলাম নিলয় স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকে এবং আরেক ছেলে সাদেকুল ইসলাম তনয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে।
মালার পরিবারিক জীবন খুব কষ্টের ছিল। যে ঘরটায় বসবাস ছিল বৃষ্টি হলে পুরো ঘর পানিতে ভেসে যেত। বাবার স্বল্প আয়ে কোন রকমে দিন কেটেছে তাদের। তবুও তার বাবার ইচ্ছে ছেলে একদিন বড় ফুটবলার হবেন। বাবা সারাদিন ফল বিক্রি করে ঘরে ফেরার সময় হালুয়া, মিষ্টি, বুন্দিয়া আর ফল নিয়ে আসতেন মালার জন্য। ছেলে ঘুমিয়ে গেলে তাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে নিজ হাতে আদর করে খাওয়াতেন। বলতেন বড় ফুটবলার হতে হবে। বড় ফুটবলার হতে পেরেছেন কি না জানেন না তবে রাস্তা ঘাটে অনেকেই মালার দিকে আঙুল দেখিয়ে যখন বলেন ওই যে ফুটবলার মালা। তখন তার গর্বে বুকটা ভরে যায়। বড় ফুটবলারের সংজ্ঞা এর চাইতে আর কি হতে পারে। আর তাইতো শেষ বেলায় পাওয়া না পাওয়ার হিসেব মিলাতে চান না মালা। মালা স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে ঢাকা লীগের প্রথম গোলদাতা। সেটা ছিল বিজেআইসি হয়ে আবাহনীর বিপক্ষে। মাঝে মাঝে সে স্মৃতিগুলো মনে হলে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। সাবেক এই ফুটবলারের সঙ্গে ফুটবল নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। সে সবের চুম্বক অংশ জনকণ্ঠের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
* ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবলের অভিষেক হয় কত সালে?
** এটার একটা মজার কাহিনী আছে যা অনেকেই জানেন না। ঢাকার প্রথম বিভাগ ফুটবলে আমার আর কাজী সালাহউদ্দিনের একই দিনে অভিষেক হয়। তার সঙ্গে আমার পরিচয় সেই স্কুল ফুটবল থেকেই। সালাহ উদ্দিন খেলতো শাহিন স্কুলের হয়ে আর আমি খেলতাম নবকুমার স্কুলের পক্ষে। দ্বিতীয় বিভাগেও দেখা হয়েছে। তবে প্রথম বিভাগে দেখা হয় ১৯৬৮ সালে রহমতগঞ্জে ওয়ারী দলের খেলায়। আমি খেলি রহমতগঞ্জের হয়ে সে খেলে ওয়ারীর হয়ে। রহমতগঞ্জের পক্ষে আমি একটি গোল করলেও সালাহউদ্দিন ওয়ারীর পক্ষে চমৎকার দুটি গোল করে জয় লাভ করে।
* সালাহউদ্দিন আর এনায়েতের মধ্যে কে সেরা? এ নিয়ে অনেক বিতর্ক। যদি জানতে চাই আপনার দৃষ্টিতে সেরা কে?
** মুচকি হাসি দিয়ে মালা জানান প্রথম সারির ছিল সালাহ উদ্দিন, এনায়েত, মেজর হাফিজ, নওসের। আমাকে বলতে পারেন দ্বিতীয় সারির স্ট্রাইকার (হাসতে হাসতে)। তবে সালাহউদ্দিন আর এনায়েত এর মধ্যে সালাহউদ্দিন গ্লামারের দিক থেকে এগিয়ে। তার বড় বড় চুল স্টাইল সব কিছু তাকে এগিয়ে রাখতো তাছাড়া খেলতো ভাল। গোল পোস্টের সামনে তাকে কেউ বল দিলে বলা চলে নাইন্টি পার্সেন্ট গোল। পক্ষান্তরে এনায়েতের ফুটবল সেন্স ছিল অসাধারণ। তার সুটিং ছিল কামানের গোলার মতো। এনায়েত মাঠে পুরো দলকে খেলাত।
* আপনি কিন্তু সেরা কে তা বলেননি।
** আসলে এই দুজনের থেকে আমি একজনকে আলাদা ভাবে দেখি। তিনি গোলাম সারোয়ার টিপু। টিপু ছিলেন অসাধারণ স্কিলফুল একজন খেলোয়াড়। তার ড্রিবলিং ছিল দেখার মতো। তিনি নিজে গোল করার চাইতে অন্য কে দিয়ে গোল করাতেন বেশি।
* রহমতগঞ্জ থেকে বিজেআইসি কিভাবে গেলেন?
** আমার খেলোয়াড়ী জীবনের এই ঘটনা মনে হলে আমাকে খুব কষ্ট দেয়। তখন রহমতগঞ্জ দলে সব প্রভাবশালী লোকের ছেলেরা জড়িত। আমার সঙ্গে চুক্তি হয় তিনশো টাকা। আমার টাকা দেবার সময় কোন নোট দেয়নি। সব রেজগি পয়সা। সিকি আধুলি দশ পয়সা পাঁচ পয়সা এসব মিলিয়ে। সেটা দেখে আমার বিবেকে খুব বাধা দেয়। নিজেকে খুব অসম্মানিত এবং লজ্জিত মনে হয়। পরের বছর বিজেআইসিতে খেলার প্রস্তাব দিলে টাকার কথা না ভেবেই সেই দলে যোগ দেই।
* আগে মোহামেডান বা আবাহনীর যে কোন দলের খেলায় দর্শক প্রচুর হতো এখন হয় না। এ বিষয়ে আপনার কি মতামত?
** আগে দলের খেলার পাশাপাশি একক খেলোয়াড়ের খেলা দেখতে যেত। সালাহউদ্দিন, মেজর হাফিজ, নান্নু, মঞ্জু এনায়েত, চুন্নু, সালাম, বাদল, আরমান, কায়সারসহ আরও অনেকে। ক্লাবগুলো বিদেশী খেলোয়াড়ও আনতো ভাল মানের যেমন প্রেমলাল, পাকির আলী, ঝুকোব, সামির সাকির, এমেকা, নালজেগার। তাদের ব্যক্তিগত খেলা দেখার জন্য দর্শক স্টেডিয়াম পারায় ভিড় জমাতো। এখন সে সব মানের খেলোয়াড় কই? দেশী বা বিদেশী কোন পার্থক্য নেই। দেশীদের খেলাও চোখে পড়ে না।
* আপনার খেলোয়াড়ী জীবনের সেরা গোল কোন টা?
** ১৯৭৩ সালে সেটা মোহামেডানের বিপক্ষে। বিজেএমসির হয়ে ২-০ গোলে জয় লাভ। যার একটি গোল ছিল প্রায় ৩০/৩৫ গজ দূর থেকে। তবে সেরা ম্যাচের কথা যদি বলেন সেটা বলতে পারি ১৯৭৭ সালে আগাখান গোল্ড কাপে মোহামেডানের হয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। আমার গোলে জিতে মোহামেডান ফাইনালে যায় ।
* মোহামেডানে কত সালে খেলেন?
** ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত। মাঝ খানে দুই বছর অন্য ক্লাবে খেলি।
* আবাহনী কখনও অফার করেনি?
** মোহামেডানে খেলার আগেই আমাকে আবাহনীতে খেলার অফার করা হয়েছিল। সে সময় শেখ কামাল আবাহনীর দায়িত্বে ছিলেন। তিনি আমাকে সরাসরি আবাহনীতে খেলার কথা বলেন। শেখ কামাল আমার রহমতগঞ্জের বাসা পর্যন্ত আসেন। কিন্তু তখন বিজেআইসির সলিমুল্লাহ, সাইদ ভাই আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তারা তখন আমাকে ছাড়তে চায়নি তাই আর আবাহনিতে সে বছর যাওয়া হয়নি।
* শেখ কামাল কি এ কারণে আপনার উপর অসন্তষ্ট ছিলেন?
** মোটেও না। পরের বছর আমি মোহামেডানে যোগ দেই। অনেক সময় খেলা শেষে বাড়ি ফেরার পথে ঢাকা কলেজ নিউ মার্কেট এলাকায় দেখা হলে আমাকে গাড়ি করে বাসায় পৌঁছে দিত। তার আচার আচরণ ছিল খুব সাবলিল। ভাগ্যক্রমে সুলতানা কামালের বাসা বকসি বাজার হওয়াতে শেখ কামালের বিয়েতে তিনি নিজে আমাকে দাওয়াত করেছিলেন। আমি সে বিয়েতে গিয়েছিলাম।
* আপনি ফুটবলার মালা এই নামে পরিচিত। এতে কার অবদান সবচেয়ে বেশি?
** আমাদের পরিবার সচ্ছল ছিল না। বাবা চকবাজারে ফল বিক্রি করতেন। কিন্তু বাবা আমার ফুটবল খেলা খুব পছন্দ করতেন। বাবা চাইতো আমি ফুটবল খেলি। বাবার উৎসাহ আর প্রেরণা আমাকে ফুটবলার মালা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই আমাকে ফুটবলার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বাবার অবদান সবচাইতে বেশি বলেই আমি মনে করি।
* কোচ হিসেবে কাকে সবার উপরে রাখবেন?
** অবশ্যই গফুর বালুচ কে। তিনি ছিলেন ফুটবলার তৈরির কারিগর।
* আপনিওতো কোচ ছিলেন? এ বিষয়ে কিছু বলেন?
** হ্যাঁ, আমাকে কোচিং পেশায় নিয়ে আসেন গোলাম সারোয়ার টিপু ভাই। রহমতগঞ্জ , সাধারণ বীমা, ওয়ারী, লালবাগ মুক্তিযোদ্ধা, মোহামেডান, সেনাবাহিনী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কে কোচিং করিয়েছি। তাছাড়া আমি ও সালাহউদ্দিন বাংলাদেশ জাতীয় দলকে বিশ্বকাপ বাছায় পর্বে খেলাই। প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপে বাংলাদেশ লাল দলের সহকারী কোচ ছিলাম। অনুর্ধ ১৬ এবং অনুর্ধ ১৯ দলের কচের দায়িত্বে ছিলাম। কায়সার হামিদ, সাব্বির, ইলিয়াস, আবুল স্বপন, গাফফার রুমির ফুটবল ক্যরিয়ারে আমার ছোয়া আছে। তাদের নিয়ে আমি গর্ব করি।
* বাংলাদেশ ফুটবলের উন্নয়নের জন্য কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত?
** এক্ষেত্রে দেশীয় কোচ, সাবেক খেলোয়াড় এবং সংগঠকদের কাজে লাগাতে হবে। সাবেক তারকা খেলোয়াড়দের এবং সংগঠকদের জেলায় জেলায় দায়িত্ব দিয়ে পাঠাতে হবে। তাছাড়া দেশীয় কোচের অধীনে বিভিন্ন স্কুলের বাচ্চাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে এবং তা নজরদারিতে রাখতে হবে। পরিকল্পনামাফিক স্কুল টুর্নামেন্ট করতে হবে নিয়মিত। সোহওয়ার্দী কাপ শেরে বাংলা কাপ নিয়মিত আয়োজন করতে হবে। নামকে ওয়াস্তে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ না করে প্রফেশনাল আকারে যদি সম্ভব হয় সেটা করতে হবে আর তা না হলে আগের ফরম্যাটে ঢাকা প্রিমিয়ার লীগ চালু করতে হবে। ভাল মানের বিদেশী খেলোয়াড় এবং কোচ আনার ব্যাপারে বাফুফেকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। আরেকটা বিষয় যেটা বেশি জরুরী তা হলো পাতানো খেলা বন্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং তার বাস্তবায়ন করতে হবে।
* তরুণ ফুটবলারদের জন্য আপনার কি উপদেশ?
** নেশায় আসক্ত হওয়া যাবে না। ফুটবল খেলে টাকা রোজগার করলে তার কিছু অংশ ভাল খাওয়ার পিছনে ব্যায় করতে হবে। মনে রাখতে হবে ক্লাব টাকা দেয় তার কাছ থেকে ভাল কিছু পাবার আশায়। তাই খেলার সময় সেরাটা দেবার চেষ্টা থাকতে হবে। বছর শেষ হলে তবেই অন্য ক্লাবের সঙ্গে নতুন চুক্তিতে যাওয়া উচিত। চরিত্রের দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। যেখান থেকে রুজি আসে তার প্রতি সম্মান থাকাটা জরুরী। অনুশীলন করতে হবে নিয়মিত। কোচের সঙ্গে কখনোই দুর্ব্যবহার করা যাবে না।