স্কুল পালিয়ে খেলতে যাওয়া আর খেলা দেখার কারণে বাবার হাতে বেল্টের বাড়ি খেয়েছেন অনেক। ১৯৭৯-৮০ মৌসুমে আবাহনীর ব্রিটিশ কোচ উইলিয়াম বিল হার্টের গোলরক্ষক বাছাইয়ে ৩০০ জনের মধ্যে প্রথম হয়ে ঠাঁই হয় আকাশি-নীল শিবিরে। যে কারণে সেই বাবাই ফুটবল প্র্যাকটিসে যাওয়ার জন্য সর্বপ্রথম স্বীকৃতিস্বরূপ ১২০০ টাকা দিয়ে ফিনিক্স সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে আর থেমে থাকতে হয়নি। মায়ের নালিশ বা বাবার চোখ রাঙ্গানি আর কখনই দেখতে হয়নি কিংবা হজম করতে হয়নি বেল্টের মার। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন দেশের সেরা গোলরক্ষক হিসেবে। সুনামের সঙ্গে খেলেছেন বাংলাদেশের সেরা ক্লাবে এবং জাতীয় দলে। তিনি ছাইদ হাসান কানন। সমর্থকরা যাকে কানন হিসেবেই জানেন। চলুন সাবেক এই তারকার অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায়-
* ফুটবলে কিভাবে জড়ালেন?
** খেলতে খেলতেই ফুটবলার হয়ে যাওয়া আসলে আমার হয়নি। আমার ফুটবলার হওয়ার ঘটনা একটু ভিন্ন। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আমাদের ছয় ভাই বোনসহ টানাপোড়েনের সংসার। বাবার একার চাকরির টাকায় সংসার চালানো খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। বড় ভাই বিএ পাস করার পর যখন দেখি চাকরি হচ্ছে না এই বিষয়টা আমাকে খুব নাড়া দিয়েছিল। তখন থেকেই মাথার মধ্যে ঘুর ঘুর করতে থাকে পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু করার। যেহেতু ফুটবলের প্রতি ঝোঁক ছিল। তাছাড়া সে সময় বিজেএমসি, কাস্টমস ছাড়াও বিভিন্ন জুট মিলগুলোতে ফুটবলার নিত। আর ফুটবলের জনপ্রিয়তা ছিল তখন তুঙ্গে। সব মিলিয়েই সেখান থেকেই আমার ফুটবলের শুরু। হাসতে হাসতে কানন জানান এনায়েত ভাইয়ের কনুয়ের গুঁতোও কিন্তু আমার ফুটবলার হওয়ার একটা বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল।
এ প্রসঙ্গে কানন বলেন, ১৯৭৫ সালে মোহামেডান ৪-০ গোলে হারিয়েছিল আবাহনীকে। তখন আমি ক্লাস সেভেনের ছাত্র। আমার খেলা দেখা তখন থেকেই শুরু। আমি ছিলাম মোহামেডানের অন্ধ সমর্থক। সে সময় মোহামেডানে খেলেন সেরা গোল রক্ষণ শহিদুর রহমান সান্টু ভাই। সঙ্গে প্রতাপ শঙ্কর দা, গোলাম সারোয়ার টিপু ভাই রামা লুসাই। তবে সবাইকে ছাড়িয়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিলেন এনায়েত ভাই। ওই খেলায় স্টেডিয়াম ভর্তি সমর্থক। তিল ধারণের জায়গা নেই। মোহামেডানের জয়ের পর সমর্থকরা একে একে কাঁটাতারের বেড়া টপকে মাঠে ঢুকছে খেলোয়াড়দের সঙ্গে সামিল হওয়ার জন্য। আমিও তাদের সঙ্গে কাঁটাতারের বেড়া টপকে মাঠে ঢুকি। মাঠে ঢুকেই এনায়েত ভাইকে জাপটে ধরি। এনায়েত ভাই ভিড়ের মধ্যে আমাকে কনুয়ের গুঁতা মারেন। আমি ছিটকে পড়ি। বিষয়টা আমাকে খুব আহত করেছিল। মনে কষ্ট নিয়েই সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম একদিন খেলোয়াড় হিসেবেই মাঠে নামব। সেই জিদ মনে হয় আমার ফুটবলার হওয়ার পেছনে একটা বড় ভূমিকা রেখেছিল। হাসতে হাসতে বলেন কানন।
* ফুটবলার হিসেবে দল এবং দেশকে অনেক বিজয় এনে দিয়েছেন। মোহামেডানের বর্তমান বেহাল অবস্থা ও ভুটানের কাছে বাংলাদেশ জাতীয় দলের ন্যক্কারজনক পরাজয় কিভাবে দেখেন?
** দুটো বিষয়েই ভীষণ কষ্ট পেয়েছি। মোহামেডান এবং উত্তর বারিধারা দুটোই বর্তমান লিগের তলানির দল। যে রকম দল গড়েছে সে রকমই ফলাফল পাবে এটাই স্বাভাবিক। মোহামেডান আগে দল গঠন করত চ্যাম্পিয়নের জন্য। আর এখন দল গড়ে কোন রকমে টিকে থাকার জন্য। ফলাফল এর চাইতে বেশি কিছু হবে না । ভুটানের সঙ্গে পরাজয়কে আমি মনে করি ঘন ঘন কোচ পরিবর্তন এবং খেলোয়াড়দের ক্লান্তি এবং শৃঙ্খলা এই তিনটাই দায়ী। খেলোয়াড়দের লিগ চলছে। তিনটা ভেন্যুতে খেলছে এরি মধ্যে নতুন নতুন কোচের কাছে অল্প কিছুদিনের প্রশিক্ষণে ম্যাচ। তা ছাড়া শৃঙ্খলার বিষয়টা আপনারা সবায় জানেন। অবশ্যই মাঠে এর প্রভাব পড়বে। তবে ভুটানের এই জয়কে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। তারা ফুটবলে এগিয়েছে আর আমরা পিছিয়েছি।
* আপনাকে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়েই একজন ফুটবলার হতে হয়েছে। নিশ্চয়ই কারও কারও অবদানের কথা বলবেন?
** তা তো অবশ্যই। লম্বা ছিলাম বলেই আমার বাড্ডা এলাকার বজলু ভাই, মনু ভাই ও লালা ভাইয়েরা আমাকে গোলরক্ষক হতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। গোল রক্ষক হিসেবেই পাইওনিয়ার খেলে তবেই প্রথম বিভাগে নাম লেখাই। আবাহনীর ব্রিটিশ কোচ উইলিয়াম বিলহার্টের গোল রক্ষকের বাছায়ে আমাকে নির্বাচন করা হয়। ১৯৮০ সালের ফেডারেশন কাপের পর আবাহনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। পরে খোঁজ পেলাম আলি ইমাম ভাইয়ের। তিনি অফ সিজনে জুনিয়র খেলোয়াড়দের অনুশীলন করান। যারা ভাল করে তাদের বিভিন্ন ক্লাবে সুযোগ করে দেন। আমাকে প্রথম বার দেখেই হাসতে হাসতে বলেন- ‘তুই তো তারের খাম্বা রে’। আমাকে জানালেন সাইকেল বাদ দিয়ে এই লেক সার্কাস মাঠে প্রতিদিন দৌড়ে আসতে পারব কি না। যদি পারি তবেই আমাকে নেয়া হবে। আমি রাজি হয়ে যাই এবং সফল হলাম। এক বছর অনুশীলন করি ইমাম ভাইয়ের কাছে। ১৯৮১ সালে ফরাশগঞ্জ প্রথম বিভাগে উঠলে ইমাম ভাইয়ের কাছে গোল রক্ষক চায়। ইমাম ভাই আমাকে ফরাশগঞ্জ ক্লাবে পাঠালে তাদের ট্রায়ালে আমি টিকে যাই। বলা চলে এখান থেকেই পথ চলা শুরু।
* আপনার প্রিয় দল মোহামেডানে কিভাবে আসলেন?
** ১৯৮৩ সালে ব্রাদার্সে ইউনিয়নে যোগ দেই। ওই বছর ভাল খেললে ডাক আসে মোহামেডান থেকে।মোহামেডানে তখন তুখোড় ফর্মে মহসিন। আমি একটু দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যাই। পরে ইমাম ভাইয়ের পরামর্শে মোহামেডানেই যোগ দেই। তবে এখানে বলে রাখা ভাল আমার টাকার প্রয়োজন ছিল। যে কারণে আমাকে বসে থাকতে হবে জেনেও ছয় লাখ টাকার চার লাখ টাকা ক্যাশ চুক্তিতে মোহামেডানে যোগ দেই।
* অনেকে বলতেন মহসিনের সঙ্গে আপনার অনেক ঝামেলা হয়েছে মোহামেডানে থাকতে? কতটা সত্যি?
** মোটেও না। সে আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমাদের দুজনের মাঝে কে কম গোল খাব এই নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো। সে দুর্দান্ত গোলরক্ষক ছিল। তার রিফ্লেক্স আর পজিশন সেন্স ছিল অসাধারণ।
* আবাহনী থেকে কখনও অফার আসেনি?
** হ্যাঁ এসেছিল। একবার আবাহনীতে খেলানোর জন্য আসলাম ভাই আমাকে সাবের হোসেন চৌধুরী ভাইয়ের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমার মোহামেডান প্রেম আমাকে শেষ পর্যন্ত উনার সঙ্গে দেখা না করেই ফেরত আনে। ওই সময়ে আমরা ক্লাবকে ভালবেসেই খেলতাম।
* জাতীয় দলের হয়ে কোন খেলাটি আপানাকে আজও কষ্ট দেয়?
** ১৯৮৯ সালের ইসলামাবাদ সাফ গেমস ফাইনাল। শেষ মুহূর্তের গোলে আমরা পাকিস্তানের কাছে হেরে যাই। সমর্থকরা অনেকেই ভাবে সেটা আমার দোষ। আবার অনেকেই ভাবে মোনেম মুন্নার দোষ ছিল। আসলে আমি ভেবেছিলাম মুন্না হেড করে বল ক্লিয়ার করবে। আর মুন্না ভেবেছিল আমি বল ফিস্ট করব। সেটা মনে হলে আজও কষ্ট পাই।
* আপনার খেলোয়াড়ি জীবনের বড় সাফল্য কোনটা?
** মোহামেডানের হয়ে অপরাজিত হ্যাটট্রিক লীগ চ্যাম্পিয়নের স্বাদ পাওয়া।
* বর্তমান আর আপনাদের সময়ের খেলোয়াড়দের মধ্যে মূল পার্থক্য কোথায়?
** বডি ফিটনেস আর স্কিল। আমাদের সময় স্কিল খেলোয়াড় বেশি ছিল। সাব্বির, রুমি, ওয়াসিম, লিটন, আসলাম, কায়সার, মুন্না, নকিব এদের মতো বর্তমানে এমন একটা খেলোয়াড়ের নাম বলতে পারবেন না।
* স্ট্রাইকার হিসেবে কোন্ খেলোয়াড়কে সমীহ করতেন?
** শেখ মোহাম্মদ আসলাম ভাইকে। আমাকে বড় ঝামেলায় ফেলত। আমি খুব টেনশনে থাকতাম আসলাম ভাইকে নিয়ে।
* ফুটবলে আপনার কষ্ট কোথায়?
** ফুটবল আমাকে অনেক দিয়েছে। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করেই একজন ফুটবলার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। এই ফুটবলের কারণেই আজ আমি দেশের মানুষের কাছে পরিচিত। কষ্ট অন্য জায়গায়। যে নেপাল-ভুটানকে সহজেই হারিয়েছি আজ তাদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করতে হয়। কষ্ট হয় যখন শুনি বর্তমানে একজন খেলোয়াড়ের মূল্য ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা। কষ্টটা এখানেই। খেলোয়াড়দের মূল্য বাড়বে খুশির কথা কিন্তু এর বিনিময়ে কি দিচ্ছে? একটু ভেবে দেখা দরকার।
ছাইদ হাসান কানন যিনি ইচ্ছে করলে অবসর না নিয়ে মোহামেডান ছেড়ে অন্য দলে গিয়ে আরও তিন চার বছর খেলতে পারতেন। কিন্তু মোহামেডানের প্রতি তার অগাধ ভালবাসা তাকে মোহামেডান ছেড়ে দূরে যেতে দেয়নি। তাই তো তার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের সেখানেই ইতি টেনেছেন। কানন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্লু পান। ১৯৯০ সালে ডাকসু নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে ক্রীড়া সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। জাতীয় দলের ম্যানেজার হিসেবে ২০০৩ সালে সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। একই বিভাগের সহপাঠিনী রওশন আরার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। দুই ছেলে আলিফ হাসান ও আদিফ হাসান বর্তমানে উচ্চতর ডিগ্রীর জন্য কানাডায় অবস্থান করছে।