ইতালির এসি মিলানের কোচ ফ্যাবিও কাপেলো ১৯৯৩ মৌসুমে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক দিয়ে ফুটবলার লিন্টেনিকে দলে ভিড়িয়েছিলেন। তার মতে লিন্টেলি ছিলেন বুদ্ধিমান দ্রুত গতিসম্পন্ন পরিশ্রমী খেলোয়াড়। ওই বছরেই জেনোয়াতে প্রাক টুর্নামেন্টে খেলতে যাবার সময় গাড়ি দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হলে তিনি মাঠের বাইরে চলে যান। পরবর্তীতে মাঠে ফিরে এসেছিলেন, তবে তার পায়ে আর সেই কারিশমা ছিল না। বাংলাদেশে ঢাকার মাঠে ঠিক এমনই একজন খেলোয়াড় ছিলেন। যিনি তার ড্রিবলিং স্কিল আর শুটিং পাওয়ার দিয়ে দর্শকদের মন জয় করেছিলেন।
খুলনায় এক ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলার দিন দর্শকদের পটকার আঘাতে তার খেলোয়াড়ি জীবন নিভে গিয়েছিল। উন্নত চিকিৎসার পর মাঠে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে না পাওয়ায় তিনি নিজ থেকেই ফুটবলের ইতি টানেন। তিনি মোঃ মহসিন। সমর্থকদের কাছে দেশের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার মহসিন হিসেবেই পরিচিত।
মোঃ মহসিনের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোলে। তবে জন্ম রাজশাহীতে ৩ এপ্রিল ১৯৬৩ সালে। জন্ম রাজশাহীতে হলেও বসবাস ছিল ঢাকার মিরপুরে। পড়াশুনা করেছেন পুরান ঢাকার পগোজ স্কুলে। স্কুল ছুটির পর বন্ধুদের সঙ্গে গোপীবাগের মাঠে ফুটবল খেলেই সময় কাটাতেন মহসিন । তখন ব্রাদার্স সবে মাত্র নতুন দল হিসেবে নিজে মেলে ধরতে শুরু করেছে। পাকিস্তান থেকে আসা গফুর ব্যালুচ কোচের দায়িত্বে ছিলেন। মহসিনের বল কন্ট্রোল আর শুটিং পাওয়ার দেখেই গফুর বালুচ বুঝে ছিলেন এই ছেলে একদিন মাঠ কাঁপাবে।
মহসিনের সঙ্গে কথপোকথনে উঠে আসে তার ক্যারিয়ারের অনেক দিক। চলুন দেখে নেয়া যাক চুম্বক অংশÑ
ফুটবলের সঙ্গে কিভাবে জড়ালেন? আসলে আমার ফুটবলের প্রতি তেমন টান ছিল না। মূলত আমার ঝোঁক ছিল এ্যাথলেটিক্সের প্রতি। পগোজ স্কুলে পড়ার কারণে গোপীবাগের ছেলেদের সঙ্গে ভাল বন্ধুত্ব জমে উঠে। স্কুল ছুটির পর সোজা গোপীবাগের মাঠ। তাদের সংস্পর্শে এসেই ফুটবলের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যাই। ১৯৭৩ সালে ব্রাদার্সের তৃতীয় বিভাগ দলে খেলার সুযোগ পান। সেবার তিনি হ্যাটট্রিক ও ডাবল হ্যাটট্রিকসহ ৩৯টি গোল করেন। পরের বছর দ্বিতীয় বিভাগে ওই ব্রাদার্সে খেলেই গোল করেন ২২টি। ১৯৭৫ সালে ব্রাদার্সে খেলেই তিনি সমর্থকদের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন। সে সময় সমর্থকদের মোহামেডান-আবাহনীর প্রতি নজর থাকলেও ব্রাদার্সের মহসিন আলাদাভাবে নিজেকে মেলে ধরেছিলেন।
১৯৮১ সালে মহসিন লীগে ডাবল হ্যাটট্রিকসহ ২০টি গোল দিয়ে সর্বাধিক গোলদাতা হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। আলাপ প্রসঙ্গে তিনি জানান, মোহামেডান বা আবাহনীতে খেললে তার গোল সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেত।
আবাহনী-মোহামেডানের মতো জনপ্রিয় দলে না খেলা প্রসঙ্গে মহসিন বলেন, ব্রাদার্স তাকে খ্যাতি দিয়েছে। সেই ব্রাদার্সের কাছে আমি ঋণী। ব্রাদার্সকেই আমার নিজের ক্লাব বলেই মনে হয়েছে। তাছাড়া আমার ইচ্ছা ছিল বড় ফুটবলার হওয়ার। তখন কাজী সালাহউদ্দিন ভাই আর এনায়েত ভাই দশ নম্বর জার্সি পরে খেলতেন। আমি জানি মোহামেডান বা আবাহনীতে গেলে দশ নম্বর জার্সি পাওয়া যাবে না। আমি চেয়েছিলাম ব্রাদার্সে খেলেই আমি জাতীয় দলের দশ নম্বর জার্সি পরে খেলব। এ কারণে মোহামেডান-আবাহনী থেকে অনেক বড় অফার আসা সত্ত্বেও ব্রাদার্স ছেড়ে অন্য ক্লাবে যোগ দেইনি। ক্যারিয়ারে পুলকিত বিষয় প্রসঙ্গে বলেন, ওই যে বললাম আমার স্বপ্ন ছিল বড় ফুটবলার হওয়ার। দশ নম্বর জার্সি গায়ে চাপিয়ে অধিনায়ক হিসেবে জাতীয় দলের হয়ে খেলা। সেই স্বপ্ন আমার পূরণ হয়েছিল। এই বিষয়টা আমাকে পুলোকিত করে।
ফুটবলে কোন মজার ঘটনা? হাসতে হাসতে জানান ২০তম এশিয়ান যুব ফুটবলে ট্রায়ালে দ্বিতীয় বাছাইয়ে ৪১ জনের মধ্যে আমি ছিলাম না। পরবর্তীতে আমাকে অধিনায়ক হিসেবেই দলে জায়গা দেয়া হয়। কোন খেলাটির কথা আজও মনে পড়ে? ১৯৭৯ সালে কোরিয়াতে প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে খেলাটির কথা আজও মনে পড়ে। ওই ম্যাচে বাংলাদেশ ৩-১ গোলে জয় লাভ করে। বাংলাদেশ ফুটবলের ক্রেজ আগে যেমন ছিল এখন তা নেই কেন? বাংলাদেশে ফুটবলের ক্রেজ আগেও ছিল এখন আছে। বলা যায় ফুটবলের মান নেই। আগে স্কিল প্লেয়ার ছিল যাদের খেলা দেখার জন্য দর্শকরা মাঠে যেতেন। এখন স্কিল ফুটবলারের অনেক অভাব। আজকের তরুণ প্রজন্মেরা ঘরে বসে অনেক শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচ দেখতে পাচ্ছে। তারা দেশের মাঠে যদি তেমন কিছু না পায় তবে কেন খেলা দেখতে আসবে। বড় বড় দলগুলো ভাল দল গঠন করে ভাল মানের বিদেশী রিক্রুট করুক দেখবেন দর্শক আবার মাঠমুখী হবে।
বাংলাদেশ ফুটবল জাগরণে কি কি পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন? প্রথমত প্রয়োজন ফুটবলের জন্য ক্যালেন্ডার এবং মহাপরিকল্পনা তৈরি করা এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা পর্যাপ্ত মাঠের ব্যবস্থা করা। জেলা শহর ছাড়াও স্কুল পর্যায়ে এবং বয়সভিত্তিক দল গঠন করে নিয়মিত লীগসহ বিভিন্ন টুর্নামেন্টের আয়োজন করা। সম্ভব হলে বাফুফের উচিত ক্লাবগুলোর জন্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা। একটা সময় ছিল মোহামেডান-আবাহনী, ব্রাদার্স তিনটা দলের পারস্পরিক খেলা হলে স্টেডিয়াম জাম্পপ্যাকড হয়ে যেত। এখন তেমনটা হয় না। কারণ কি? ওই একটাই দর্শক কাদের খেলা দেখতে যাবে? আগে শুধু এই তিন দল নয় ছোট ছোট দলগুলোর সঙ্গে খেলা হলেই দর্শক সমাগম হতো এখন বড় ম্যাচেও দর্শক হয় না। আজকাল বড় দলগুলো যে মানের বিদেশী খেলোয়াড় নিয়ে আসে তারা অনেকেই বল ঠিকমতো রিসিভ করতে পারে না। তাহলে দর্শক তো ধীরে ধীরে কমতে থাকবেই।
মোঃ মহসিন ১৯৭৬ সালে ব্যাঙ্ককের কিংস কাপ, ১৯৭৭ সালে তেহরানে অনুষ্ঠিত ১৯তম এশিয়ান যুব ফুটবল, ১৯৭৮ সালে ব্যাঙ্কক এশিয়ান গেমস, ঢাকায় অনুষ্ঠিত ২০তম এশিয়ান যুব ফুটবল, ১৯৭৯ সালে ঢাকায় এশিয়ান কাপ দ্বিতীয় গ্রুপের কোয়ালিফাইং রাউন্ড, দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে ৯ম প্রেসিডেন্ট কাপ, ১৯৮০ সালে কুয়েত এশিয়ান কাপ এবং ১৯৮১ সালে ঢাকায় প্রথম প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপে বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে খেলেন। অধিনায়ক হিসেবে জাতীয় যুব দলের হয়ে সাফল্য দেখানোর পর ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য এশিয়ান কাপ দ্বিতীয় গ্রুপের কোয়ালিফাইং ম্যাচে মহসিনকে জাতীয় দলের অধিনায়ক করা হয়।
১৯৮২ সালের ঘটনাবহুল কাহিনী প্রসঙ্গে মহসিন বলেন, আগাখান ফুটবলে ব্রাদার্স চ্যাম্পিয়ন হয়ে ক্লাবে আনন্দ করতে করতে রাত হয়ে যায়। ফলে ক্যাম্পেই থেকে যান সেদিন। ১৯৮২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। সকালে সালাম মুরশেদির ডাকে ঘুম ভাঙ্গে। ফুটবল খেলতে যেতে হবে খুলনায়। আমার অতটা আগ্রহ না থাকলেও বন্ধুত্বের টানেই আগ্রহ প্রকাশ করি। আমাদের ফ্লাইট ছিল সম্ভবত সকাল সাড়ে আটটায়। আমাদের এয়ারপোর্ট পৌঁছতে পৌঁছতে সকাল সাড়ে নয়টা বেজে গিয়েছিল। আমি মনে মনে ভেবেছিলাম বাঁচা গেল। বোধহয় আর যাওয়া হচ্ছে না। এয়ারপোর্ট পৌঁছে শুনি ফ্লাইট ডিলে। যাই হোক খুলনা পৌঁছলাম। লীগ ফাইনাল খেলা। খেলা ছিল দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি বনাম খুলনা মুসলিম ক্লাব, বর্তমান যেটা খুলনা মোহামেডান। আমরা খুলনা মুসলিম ক্লাবের পক্ষে খেলতে গিয়েছিলাম। নির্ধারিত সময়ে খেলা শুরু হলো। দ্বিতীয়ার্ধের খেলা চলছে। খেলা তখন ১-১ গোলে সমতা। খেলা শেষ হতে ৭-৮ মিনিট বাকি। আমি বল পেয়েই আমাদের এক খেলোয়াড়কে পাশ দেই। সে গোল করে। সঙ্গে সঙ্গে দর্শকরা আনন্দে পটকা ফুটাতে শুরু করে। তৎক্ষণাৎ একটা পটকা এসে আমার কাঁধে লাগে। আমি মাঠের মধ্যে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে শুনেছিলাম আমাকে হেলিকাপ্টারে করে ঢাকায় হাসপাতালে আনা হয়েছিল। পরবর্তীতে আমি উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে যাই। চিকিৎসার পর আবারও মাঠে ফিরে এসেছিলাম কিন্তু মাঠে আমি নিজেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিনি। তাই খেলা থেকে ১৯৮৫ সালে ঢাকা ওয়ান্ডার্সের সঙ্গে খেলার দিন অবসর নেই।
মহসিন খেলোয়াড় থাকা অবস্থায় ১৯৮৪ সালে ব্রাদার্সের কোচের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া ওয়ারি ও সেনাবাহিনীর দলের কোচে ছিলেন। ১৯৯২ সালে ভারতের কেরালায় অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ যুব দলের কোচ হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। মহসিন ১৯৯১ সালে ক্রীড়ালেখক সমিতির সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হন। মহসিন মিরপুরে স্ত্রী এবং দুই সন্তান নেওয়াজ অনি ও মেনহাজ অভি নিয়ে সুখের সংসার।
একদিন স্বপ্ন দেখেছিলেন অধিনায়ক হয়ে দশ নম্বর জার্সি গায়ে চেপে জাতীয় দলের হয়ে খেলার। সে স্বপ্ন তার পূরণ হয়েছিল ঠিকই কিন্তু দেশের জন্য আরও অনেক সম্মান বয়ে আনার প্রবল ইচ্ছা ছিল। মহসিন হয়ত সেটা পারেননি কিন্তু নতুন প্রজন্মের খেলোয়াড়দের দিকে তিনি মুখিয়ে আছেন। দেশের ফুটবলকে একদিন তারা নিয়ে যাবেন একটা সম্মানজনক অবস্থানে। এই বিশ্বাস নিয়েই বেঁচে আছেন মহসিন।