জন্মের পর মাত্র সাত মাস পেয়েছেন বাবার আদর। বাবাকে ‘বাবা’ বলে ডাকার আনন্দ বা দৌড়ে বাবার কোলে ঝাঁপ দিয়ে পড়া এসব কিছুই হয়নি। বাবার হাত ধরে দোকানে গিয়ে কাঠি লজেন্স কেনার মধুর কোন ঘটনা নেই জীবনে। যা আছে সব মাকে নিয়েই। মায়ের আদর আর স্নেহেই একজন আদর্শ ফুটবলার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।
আউটার স্টেডিয়ামে কিশোর লীগে খেলার আগ্রহ যার মনের মধ্যে ছিল অটুট, দর্শকদের হাজারো করতালির মাঝে বল নিয়ে দৌড়ানোর স্বপ্নের যে বীজ বপন করেছিলেন, পরবর্তীতে সেই তিনি শুধু আউটার স্টেডিয়ামের দর্শকদের নয় বরং বাংলাদেশের লক্ষ্য ফুটবল সমর্থকদের মধ্যমণি হয়ে আছেন। তিনি আর কেউ নন বাংলাদেশ ফুটবলের মধ্যমাঠ কাঁপানো সৃষ্টিশীল মিডফিল্ডার ‘আরমান মিয়া’। ফুটবল সমর্থকরা যাকে জানেন এবং চিনেন আরমান নামে।
ক্রিকেট খেলোয়াড়দের কাছে যেমন লর্ডস কিংবা ইডেন গার্ডেনে খেলার একটা লুকায়িত স্বপ্ন থাকে তেমনি আরমান মিয়া ভাবতেন আউটার স্টেডিয়ামের পাসে যে অফিসটাতে কিশোর ফুটবলের আয়োজন হতো সেটা হলো ফুটবলের সর্ব শ্রেষ্ঠ জায়গা। আর তাই এই মাঠে খেলার আগ্রহ ছিল লর্ডস কিংবা ইডেন গার্ডেনের মতোই। সেখানে কিশোর ফুটবল খেলেই তার ফুটবলার হওয়ার প্রবল ইচ্ছা জাগে। তবে কোন পর্যন্ত গেলে একজন বড় মাপের ফুটবলার হওয়া যায় সে বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র উপলব্ধি ছিল না!
জন্ম পুরান ঢাকাতে। জন্মের সাত মাস বয়সেই বাবাকে হারান এই কালজয়ী ফুটবলার। সম্বল শুধু মায়ের ভালবাসা। এই সম্বলকে পুঁজি করেই মায়ের অনুপ্রেরণা আর এলাকার এক সংগঠক গোলাপ ভাইয়ের চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত ফুটবলার হতে পেরেছেন আরমান।
নয় দশ বছর থেকেই ঢাকার বাইরে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে সমর্থকদের নজর কেড়েছিলেন। ফুটবল মাঠে বাইশ’ জনের দৌড়াদৌড়ির মাঝে কিশোর আরমান ছিলেন একটু ভিন্ন। তার বল রিসিভিং, ডিস্ট্রিবিউশন এবং জায়গায় দাঁড়িয়ে দু’একজনকে ডজ দিয়ে বেরিয়ে বিপক্ষ সীমানায় থ্রু ঠেলে দেয়া ছিল পান্ত ভাতের মতো। তাছাড়া ফ্রিকিক ছিল অসাধারণ। অনেক সময় নিজেই তার নিজের করা ফ্রিকিক দেখে হতবাক হয়ে যেতেন। এভাবেই কিশোর ফুটবল লীগ থেকে পাইওনিওর। পরবর্তীতে তৃতীয় বিভাগ দ্বিতীয় বিভাগ অতঃপর প্রথম বিভাগ।
দ্বিতীয় বিভাগে খেলার সময়ই অনূর্ধ্ব-১৬ এএফসি কাপ খেলতে রাজশাহী যান আরমান। কোচ হাসানুজ্জামান বাবলুর তত্ত্বাবধানে ছিলেন তিনি। আরমান সবার নজর কাড়েন ওই টুর্নামেন্টে। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৬ দল ওই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
ইস্কাটন সবুজ সংঘ প্রথম বিভাগে উঠেই ব্রাদার্সকে হারিয়ে তোলপাড় করে দেয়। পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে ঢাকা মোহামেডানে নাম লেখান এই মাঝমাঠের খেলোয়াড়। এত নাম ডাক এই খেলোয়াড়ের অথচ তার প্রথম আয় শুনলে অবাক হওয়ারই কথা। ১৯৮৮ সালে বিনা পয়সায় ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করেন ইস্কাটন সবুজ সংঘে। ঈদের ঠিক পূর্বে একটি খামে তিনি পান ২০০ টাকা। এই দুইশ’ টাকা তার জীবনের ফুটবল খেলে প্রথম উপার্জন।
জীবনের প্রথম দিকে তিনি খেলা শুরু করেছিলেন রাইট উইং পজিশনে। জগন্নাথ হল মাঠে প্র্যাকটিস করার সময় কোচ সরকারজি তাকে খেলান মাঝমাঠে। সেই থেকেই তিনি মাঝমাঠের অপরিহার্য খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেন।
মোহামেডানে তার খেলা হয়নি বেশি দিন। মোহামেডান, আবাহনী এবং ব্রাদার্স মিলে যে জেন্টেলমেন্ট এগ্রিমেন্ট করেছিল তার প্রতিবাদ করতেই একঝাঁক তারকা খেলোয়াড় নিয়ে যোগ দেন মুক্তিযোদ্ধায়। ফুটবলারদের মূল্যায়ন এবং ন্যায্য পাওনা ফিরে পেতে ওই সময়ের তারকা খেলোয়াড়রা একটা ঝুঁকি নিয়েছিল। যা পরবর্তীতে সফল হয়েছেন বলেই অনেকে মনে করেন।
পরবর্তীতে আবাহনী, মোহামেডোন ও মুক্তিযোদ্ধায় খেলেছেন আরমান মিয়া। ২০০১ সালে তার নেতৃত্বেই চ্যাম্পিয়ন হয় আবাহনী। ১৯৯৬ সালে তার চমৎকার গোলে আবাহনীকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় মোহামেডান। তাছাড়া ১৯৯৩ সালে কোরিয়ান হুন্দায় দলের বিরুদ্ধে ফ্রিকিক থেকে তার একটি অসাধারণ গোল আছে। এ রকম অনেক গোল আছে যা ঢাকার দর্শকরা দীর্ঘদিন মনে রাখবেন। আরমান ছিলেন মাঝমাঠের জন্য অপরিহার্য। ছিমছাম গড়নের এই খেলোয়াড়টির পায়ের কারুকাজ ছিল দেখার মতো। বল পায়ে পেলেই যেন তার গতি বেড়ে যেত। দুই তিনজন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে কোন স্ট্রাইকারকে যখন বল বাড়াতেন ওই স্ট্রাইকারের কাজ থাকত শুধু গোলে বল পুশ করা। মোহামেডানের সাব্বির আর আবাহনীর ইকবালের সঙ্গে আরমানের বোঝা পড়া ছিল চমৎকার।
বাংলাদেশ প্রথম দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় ১৯৯৬ সালে। মিয়ানমারে চারজাতি রয়েল চ্যালেঞ্জ কাপ চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য ছিলেন আরমান। তাছাড়া ১৯৯৯ সালে সাফ গেমসে ফুটবলের স্বর্ণ জয়ের সাক্ষী হিসেবেও আছেন আরমান। ২০০৩ সালের ঢাকা সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের অংশীদার হয়েও আছেন এই মাঝ মাঠের কুশলী খেলোয়াড়। আশাতীত ভাল খেলেছিলেন আরমান। যেন একাই পরিচালনা করেছিলেন দলকে। তাকে দেখা গেছে কখনো ওপরে আবার কখনো নিচে নেমে খেলতে। দলের প্রয়োজনে পুরো ৯০ মিনিট চোষে বেড়িয়েছিলেন পুরো মাঠ। এমন ধারালো মাঝমাঠ ঢাকার মাঠে অনেকদিন দেখা মেলেনি।
জেন্টেলমেন্ট এগ্রিমেন্ট আরমান মিয়াদের অনেক ভুগিয়েছে। একবার অবসরেও চলে গিয়েছিলেন। তারপর আবারও ফিরে আসেন তৎকালীন বাংলাদেশের জাতীয় দলের ফরেন কোচ জর্জ কোটানের বিশেষ অনুরোধে। মাঝমাঠের সাবেক তারকা খেলোয়াড় মাহবুব হোসেন রক্সি জানান, আরমান বাংলাদেশের হাতেগোনা সেরা মিডফিল্ডারদের একজন। জায়গায় দাঁড়িয়ে তার অসাধারণ ডজ দেখে অনেক সময় তারা নিজেরাও হতবাক হয়ে জেতেন। এমন মিডফিল্ডারের আবির্ভাব দেশের মাটিতে আবার কবে দেখা যাবে সেটা সময়ই বলে দেবে।
২০০৮ সালে অনেকটা আচমকাই অবসরে চলে যান বাংলাদেশের অন্যতম সেরা মাঝমাঠের কুশলী খলোয়াড় আরমান মিয়া। তার অবসরে সবাই অবাক হয়ে যান। আর ফিরে আসেননি মাঠে। তার শূন্যতা আজও পূরণ হয়নি। এ রকম মেজাজি আর কুশলী ফুটবলার বাংলাদেশের সমর্থকরা আরও দেখতে চায়। আরমানের বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশের জাতীয় দলের সাবেক খেলোয়াড় এবং কোচ শফিকুল ইসলাম মানিকের সঙ্গে। মানিক জানান, আরমান ছিলেন মধ্যমাঠের একজন মেজাজি কুশলী খেলোয়াড়। তার ড্রিবলিং এবং শূটিং পাওয়ার ছিল অসাধারণ। বিশেষ করে ফাইনাল পাস যখন সে দিত সেটা থেকে গোল না হওয়াটা ছিল দুর্ভাগ্য। আরমানের আরেকটি বিশেষ গুণের কথা জানান মানিক। খেলার পরিস্থিতি অনুযায়ী পুরো খেলাটাকে চেঞ্জ করে ফেলতে পারতেন।
শফিকুল ইসলাম মানিক উল্লেক করেন ১৯৯৬ সালে তার কোচিংয়ে আবাহনীকে হারিয়ে মোহামেডান চ্যাম্পিয়ন হয়। মোহামেডান হারিয়েছিল আবাহনীকে আরমানের গোলেই। সেই স্মৃতি আজও মানিককে ভাললাগায় আপ্লুত করে। মানিক বলেন, আরমান ছিলেন নিঃসন্দেহে একজন পরিপূর্ণ মিডফিল্ডার। তার মতে রুম্মন বিন ওয়ালি সাব্বিরের পরই আরমানের স্থান। অনেকটা অভিমান করেই আরমান খেলা ছেড়ে দেন। ইচ্ছে করলে তিনি আরও কিছুদিন খেলা চালিয়ে যেতে পারতেন।
কথা হয় বাংলাদেশের সাবেক খেলোয়াড় এবং কোচ হাসানুজ্জামান বাবলুর সঙ্গে। তিনি পরিষ্কার বলেন, তার ১৮ বছরের কোচিং ক্যারিয়ারে তার দেখা আরমান বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়। আরমানের খেলা ছিল একজন ন্যাচারাল গড গিফটেড খেলোয়াড়। সে নিজে খেলত এবং পুরো দলকে খেলাত। তার মতো এমন কোয়ালিটি খেলোয়াড় তিনি তার কোচিং ক্যারিয়ারে দেখেননি। রাজশাহীতে অনূর্ধ্ব ১৬ এএফসি কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাংলাদেশ দল যায় সৌদি আরব সেখানে আরমানের খেলা দেখে সৌদি সরকার তাকে তাদের দেশে স্থায়ীভাবে চায়। কিন্তু আরমান তাতে রাজি হয়নি। এ ঘটনায় বাবলুর গর্বে বুকটা ভরে যায়। এ প্রসঙ্গে বাবলু বলেন, আরমান, আলফাজ এবং সাব্বিরের মতো খেলোয়াড়কে বাংলাদেশে যুগে যুগে পেতে চায়। এ প্রজন্ম যেন তাদের খেলা দেখে অনুপ্রাণিত হতে পারে।
আরমান মিয়া ২০১৬ সালের শুরুতে সোনালি অতিত ক্লাবে অনুশীলনের সময় গুরুতর আঘাত পেয়ে আহত হন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার একটি হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ওই সময় ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়, সাবেক খেলোয়াড় সত্যজিত দাস রুপু, মানিক, রক্সি, টুটুল এবং বাবলু আরমান মিয়ার খোঁজখবর নিতে হাসপাতাল গিয়েছিলেন। সবাই তার সুস্থতা কামনা করেন।
ফুটবল খেলে দুইশ’ টাকা উপার্জন দিয়ে যে ফুটবলার তার জীবন শুুরু করেছিলেন, তিনি খেলোয়াড়ি জীবনে টাকার অনেক লোভ লালসা থেকে বিরত ছিলেন। দু’হাত দিয়ে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলেন লোভ লালসাকে। আর তাই তিনি খেলোয়াড়ি জীবনে একজন আদর্শ খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছিলেন। নজর কেড়েছিলেন লাখ লাখ ফুটবলপ্রেমীদের। তাই তো সমর্থকরা আজও মাঠে খুঁজে বেড়ান আরমান মিয়ার মতো সৃষ্টিশীল কুশলী ফুটবলারকে।