ক্ষুধার্ত বাঘ যখন হরিণের পালকে তাড়া করে তখন বাঘ কিন্তু নিশানা করে একটিকে। তাড়া করার সময় অন্য হরিণ কাছে পেলেও সে তাকে ধরে না। সে ততক্ষণ পর্যন্ত ক্ষান্ত হয় না যতক্ষণ না তার নিশানা করা হরিণকে শিকার করতে না পারে। ফুটবলে গোলের জন্য ক্ষুধার্ত আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের ঠিক এ রকম মেজাজ থাকাটাই স্বাভাবিক। যার নিশানা হবে ‘গোলপোস্ট’। গোলরক্ষককে পরাস্ত করে বলের ঠিকানা জালে পাঠানোই থাকবে একমাত্র লক্ষ্য। তবে সে লক্ষ্য কারও থাকে কারও থাকে না। ব্যতিক্রম ছিলেন নকিব। ঢাকা লীগে তার গোল করার ক্ষমতা আর গোলের সংখ্যা দেখলেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যায়।
নকিব, পুরো নাম ইমতিয়াজ আহমেদ নকিব। জন্ম নরসিংদীতে হলেও ছোটবেলা থেকেই ঢাকাতে বেড়ে ওঠা। ফুটবলের হাতেখড়ি ছোটবেলা থেকেই। সেই স্কুল ফুটবল থেকে পাইনিওর, তারপর তৃতীয় বিভাগ, অতঃপর ঢাকা ফুটবল লীগ। স্কুল পড়ুয়া ছাত্রের মতো যেন সকল শ্রেণীতেই অধ্যয়ন করেছেন। যার কারণে দক্ষ ফুটবলারের মতো সব কিছুকেই রপ্ত করতে পেরেছিলেন সিদ্ধহস্তে।
১৯৮৯ সালে ঢাকা লীগে একটা নতুন নিয়ম চালু হয়। প্রতিটি দলে একজন করে আনকোরা অর্থাৎ নতুন খেলোয়াড় মাঠে নামাতে হবে এবং কমপক্ষে পাঁচ মিনিট মাঠে রাখতে হবে। সেই সুবাদে ওই সময় নকিবের জায়গা হয়ে যায় ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। প্রথম কয়েকটা খেলায় মাঠে পাঁচ মিনিট অবস্থান করেই নিজের দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। এরপরের ম্যাচগুলোতে তিনি প্রমাণ করেন পুরো সময়ই মাঠের লড়াইয়ে থাকার যোগ্যতা তার আছে।
ছোটবেলা থেকেই আকাশি-নীল অর্থাৎ আবাহনীর সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও তিনি ঢাকা লীগে শুরু এবং শেষ ও করেন ঐতিহ্যবাহী সাদা-কালো দল ঢাকা মোহামেডানের হয়ে। তার কাছ থেকে জানা যায়, একটা সময় তার প্রিয় দল আবাহনী কোন খেলায় হেরে গেলে তিনি অঝোরে কেঁদে ফেলতেন। অথচ সেই প্রিয় দলের হয়ে খেলা হয়নি কখনোই। ১৯৮৯ থেকে ’৯৩ পর্যন্ত একটানা সাদা কালো শিবিরে খেলেছেন। তারপর ফুটবলের সেই কালো অধ্যায় নামে খ্যাত পুল তাকেসহ আর অনেক খেলোয়াড়কে শৃঙ্খলিত জীবন ভেঙ্গে যুদ্ধে নামতে বাধ্য করে। কিন্ত সে সময় নকিবের মোহামেডানপ্রীতি জন্মে যায়। মুক্তিযোদ্ধায় নাম লেখানোর সময় নীরবে তিনি অনেক কেঁদেছেন। তবুও ফুটবলের স্বার্থেই তাকে সাদা-কালো শিবির ছাড়তে হয়।
১৯৯৪ থেকে ’৯৯ সাল পর্যন্ত কাটান মুক্তিতে। অতঃপর আবার তার প্রিয় সাদা-কালো শিবিরেই ফিরে আসেন। ২০০০ থেকে টানা ২০০৭ পর্যন্ত খেলে তিনি অবসর নেন ঢাকা মোহামেডানে থেকেই। পায়ের কারুকাজ আর হেড এই দুয়ে টানা চারবার শীর্ষ গোলদাতার আসন দখল করেছেন নকিব। ঢাকা লীগে তার মোট গোলের সংখ্যা ১০৭টি। এ থেকেই বোঝা যায় কোন মাপের খেলোয়াড় ছিলেন তিনি।
ধারাবাহিক পারফর্মেন্সের সুবাদে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ জাতীয় দলে স্থান করেন নেন নকিব। দেশের হয়ে অনেকবার বিদেশ সফর করেছেন। মিয়ানমারের চার জাতি টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন হওয়া তার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা। তাছাড়া মালয়েশিয়া এবং তাইওয়ানের বিরুদ্ধে তার করা গোল সেরা বলে জানান। ঢাকা লীগে স্মরণীয় খেলা কোনটি এমন প্রশ্ন করলে হাসতে হাসতে নকিব বলেন, আমি মোহামেডান সমর্থকদের কাছে নায়ক এবং ভিলেন দুটোই। প্রিয় দল আবাহনীর বিরুদ্ধে ২০০০ সালের লীগের খেলায় জয় এবং ৯৭ সালের লীগে মুক্তিযদ্ধার হয়ে মোহামেডানের বিরুদ্ধে নিজের করা দুই গোলে জয়। এই দুটো ম্যাচের কথা কখনই ভুলব না আমি। তিনি বলেন, ওই ম্যাচ দু’টো আজও আমাকে শিহরিত করে।
তবে ২০০০ সালের খেলাটি শুধু নকিবেরই নয় সাদা-কালো ভক্তদের কাছেও একটা ঐতিহাসিক ম্যাচ হিসেবে থাকবে। নায়ক হয়ে থাকবেন নকিব মোহামেডান ভক্তদের মাঝে। কারণ ওই ম্যাচে নকিব করেছিলেন আবাহনীর বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক। যথাক্রমে ২-০ গোলে পিছিয়ে পড়ার পর প্রথম অর্ধের ৩৩ মিনিটে নকিব একটি গোল পরিশোধ করেন। পরে ৫২ এবং ৭০ মিনিটে গোল করে হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেন। একটা সময় ম্যাচ ৩-৩ গোলে ড্র। খেলার অন্তিম মুহূর্তে মতিউর মুন্নার গোল মোহামেডান শিবিরে আনন্দের বন্যা বইয়ে দেয়। ১৯৮৬ ফুটবল মৌসুমে আবাহনীর জার্সি চেপে ফেডারেশন কাপে শ্রীলঙ্কান স্ট্রাইকার প্রেমলালের হ্যাটট্রিক ছিল দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি ফুটবল যুদ্ধে একমাত্র দৃষ্টান্ত। ওই ম্যাচে হ্যাটট্রিক করে ইতিহাসে সংযোজিত হয়েছেন নকিব ।
১৯৯৭ সালের লীগের শেষ ম্যাচের কথা। নকিব তখন মুক্তিযোদ্ধার খেলোয়াড়। মোহামেডান দুই পয়েন্ট এগিয়ে মুক্তির চেয়ে। শেষ ম্যাচে ড্র হলেই মোহামেডান চ্যাম্পিয়ন আর মুক্তিকে চ্যাম্পিয়ন হতে হলে মোহামেডানকে হারিয়ে পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করতে হবে। মুক্তির পক্ষে নকিব করে বসেন দুই গোল। প্রথম গোলটা করে মোহামেডান সমর্থকদের বুকে পেরেক মারেন আর দ্বিতীয়টা যেন গজাল মেরে পুরো গ্যালারি একেবারেই ঠা-া করে দেন। সুদূর আমেরিকায় একটা টেলিফোন বুথ থেকে এক মোহামেডান ভক্ত এনাম মুরশেদ যখন দেশে ফোন করেই জানলেন মোহামেডান নকিবের দুই গোলে হেরে গেছে মুক্তির কাছে তখন তিনি সেই বুথেই স্তব্ধ হয়ে বসে পড়েন। সেই থেকেই এনাম মুরশেদসহ লাখো মোহামেডান সমর্থকদের কাছে নকিব যেন ভিলেন হয়ে আছেন।
বর্তমান খেলার মান প্রসঙ্গে নকিব বলেন, খেলার মান আগের চাইতে বেড়েছেম, তবে সেটা দলগত। বর্তমানে স্কিল খেলোয়াড়ের বড়ই অভাব। তার মতে, সাব্বির, কায়সার হামিদ, মোনেম মুন্না, রুমি এ রকম স্কিল খেলোয়াড় আজকাল মাঠে দেখা যায় না। একটা দলে কমপক্ষে দুজন স্কিল খেলোয়াড় প্রয়োজন। দেশের বাইরে নকিব ভারতে কলকাতা মোহামেডানের হয়ে খেলেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মোনেম মুন্না ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলে পুরো কলকাতাবাসী মন জয় করে নিয়েছিলেন। এমন অসাধারণ খেলোয়াড় ছিলেন মুন্না। আজও তারা তাকে স্মরণ করেন সবাই। একমাত্র মোনেম মুন্নাই বাংলাদেশী খেলোয়াড় হিসেবে ভিনদেশের মানুষের মন জয় করতে পেরেছিলেন। যা আজও নকিবকে বিস্মিত করে।
দেশের খেলার মান বাড়ানোর প্রসঙ্গে নকিব বলেন, বয়সভিত্তিক দল গঠন করার পাশাপাশি ট্যালেন্ট হান্টের মতো প্রোগ্রাম করতে হবে। দেশীয় ভাল কোচ তৈরির পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে । তবে এসবের মূল হচ্ছে অর্থ। সেক্ষেত্রে বড় বড় স্পন্সর কোম্পানিগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। আর একটা বিষয়ের উপর জোর দেন, তা হচ্ছে খেলার মাঠ। যে কোন মূল্যে প্রতিটা ক্লাবের মাঠ বের করতে হবে। কেন বর্তমানে মাঠে দর্শকখরা, আর মোহামেডান-আবাহনীর জৌলুশ কমে যাচ্ছে। এমন প্রশ্ন করলে নকিব বলেন, এখন সমমানের দল বেড়েছে। ৫-৬টি দল চ্যাম্পিয়ন রেসে থাকে। তারা শক্তিশালী দল গঠন করছে। সেখানে আবাহনী-মোহামেডান কুলিয়ে উঠতে পারছে না। তবে মোহামেডান-আবাহনী শক্তিশালী দল গঠন করলে দর্শক খরা কমে যাবে এবং খেলায় আবার প্রাণ ফিরে আসবে।
ম্যানেজার হিসেবে মোহামেডানের অবস্থা এমন তলানির দিকে কেন? জানতে চাইলে নকিব বলেন, মোহামেডান একটা দীর্ঘ প্লান নিয়ে এগুচ্ছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে অচিরেই আবার মোহামেডান শক্তিশালী দল গঠন করবে। সমর্থকরা তাদের পুরনো সেই মোহামেডান নতুনরূপে দেখতে পাবে। অস্ট্রেলিয়া ফুটবল দল বাংলাদেশে আসছে এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে নকিব বলেন, তারা আসছে তাদের তাগিদে। এতে করে আমাদের ফুটবলের আহামরি কোন উপকারে আসবে বলে মনে হয় না। আমাদের দেশের ফুটবলের মান কোথায় এই বিষয়টা চিন্তা করা প্রয়োজন। সমসাময়িক দল হলে আমাদের দেশের ফুটবলের জন্য উপকার হতো। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, যে অজুহাতে ক্রিকেট দল আসেনি তা তিনি মানতে নারাজ। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের নিশ্চিন্তেই বাংলাদেশে আসা উচিত ছিল।
স্ত্রী ডাঃ মেহজাবিন নাজ আর দুই ছেলে নিয়ে সুখের সংসার নকিবের। স্ত্রী বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে কর্মরত। বড় ছেলে ও লেভেলে আর ছোট-টা ক্লাস সিক্সে। মোহামেডানের সঙ্গে নিজেকে এখনও জড়িয়ে রেখেছেন। আছেন মোহামেডানের ম্যানেজার হিসেবে। যতদিন বাঁচবেন মোহামেডানের সঙ্গেই সম্পৃক্ত রাখতে চান নিজেকে।