অনুশীলনে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড়রা
কোনো উঁচু দালান নির্মাণ করতে গেলে প্রথমেই তার ভিত্তি করতে হয় মজবুত। নইলে যতই উঁচু করে তৈরি করা হোক না কেন, সামান্য বা মৃদু ভূমিকম্পেই তা ধসে পড়ে। বাংলাদেশের নারী ফুটবলের কোনো অবকাঠামোই নেই, অথচ একটা ঘটনাতেই সেই ফুটবল এখন মুখ থুবড়ে পড়ার মতো অবস্থায় চলে গেছে! জাতীয় নারী ফুটবল দলের কোচ পিটার বাটলারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছেন ১৮ সিনিয়র নারী ফুটবলার।
এই ব্রিটিশ কোচের বিরুদ্ধে এনেছেন একাধিক গুরুতর-স্পর্শকাতর অভিযোগ। জানিয়েছেন এই কোচকে রাখা হলে তারা প্রয়োজনে সম্মান নিয়ে গণপদত্যাগ করবেন। কিন্তু যার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, সেই বাটলার জানিয়েছেন- এসব নিয়ে তিনি মোটেই ভাবিত নন। সিনিয়ররা যদি অনুশীলনে না আসে, তাহলে বাকি ১২ জুনিয়র এবং ক’দিন পর থেকে অনূর্ধ্ব-২০ ফুটবলারদের নিয়েই জাতীয় দলের কার্যক্রম চালিয়ে যাবেন তিনি। সেই সঙ্গে তিনি ছয় বিদ্রোহী সিনিয়র ফুটবলারকে ক্যাম্প থেকে বাদ দেওয়ারও সুপারিশ করেছেন বাফুফের কাছে, এমনটাও শোনা গেছে।
বাফুফে এই সমস্যা নিয়ে বেকায়দায় পড়েছে স্বভাবতই। সাবিনাদের সঙ্গে আলোচনা না করেই পিটারের মেয়াদ দুই বছর বাড়ানোর জন্য বাফুফেকেও এখন ফুটবলপ্রেমীদের অনেকেই গালমন্দ করছে। সংকট থেকে উত্তরণের জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে তারা। কমিটি কাজও শুরু করেছে। সোমবার পর্যন্ত তারা অধিকাংশ বিদ্রোহী ফুটবলারদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এরপর তারা নারী উইং, কোচিং স্টাফ এবং বাটলারকেও জিজ্ঞাসাবাদ করে বৃহস্পতিবারের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দেবে।
এর আগেও সাবিনা-রূপনা-ঋতুপর্ণারা বিদ্রোহ করেছেন। এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বিদ্রোহ করে আবারও আলোচনায় এলেন তারা। অথচ আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়ে দুটি ম্যাচ খেলতে যাওয়ার কথা রয়েছে মারিয়া-মনিকা-সানজিদাদের। সেখানে প্রথমে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে ২৬ ফেব্রুয়ারি ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচে, এরপর ২ মার্চ একটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার কথা রয়েছে কৃষ্ণা-তহুরা-সাগরিকাদের।
এখন তদন্ত কমিটির রায়ের পরেই পরিষ্কার হবে কোন পথে যাচ্ছে দেশের নারী ফুটবল। তবে বাফুফে দৃঢ়ভাবেই জানিয়েছে প্রয়োজনে বিদ্রোহীদের বাদ দিয়ে হলেও একটি দল যাবে আমিরাতে। সফর হবেই। এবং যাই হোক না কেন, বাটলারই কোচ থাকবেন।
গত ৩০ জানুয়ারি বাফুফে ভবনের নিচতলায় এসে গণমাধ্যমের সামনে এক অ-আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে এসে কোচ বাটলারের বিরুদ্ধে ‘গালিগালাজ করা’, ‘বডি শেমিং’, ‘মানসিক নির্যাতন’-এর মতো বেশকিছু গুরুতর অভিযোগ পেশ করেন সাবিনা-মনিকা-মারিয়ারা। সংবাদ সম্মেলনে নারী জাতীয় ফুটবল দলের হেড কোচ পিটার বাটলার ইস্যু নিয়ে আমাদের অবস্থান, প্রশ্ন এবং যত অভিযোগ’-এই শিরোনামে তিন পাতার আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বাটলারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে ধরেছিলেন মেয়েরা।
সেই বিবৃতিটি বাংলায় লেখা হলেও সেটার খসড়া ছিল ইংরেজিতে লেখা, যা তদন্ত কমিটির গোচরীভূত হয়। তখন গুজব ছড়িয়ে পড়ে বাফুফের সাবেক টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পল স্মলিই এটি লিখে দিয়েছিলেন সাবিনাকে, যার সঙ্গে এখনো সুসম্পর্ক বজায় আছে বাংলাদেশ অধিনায়কের। কিন্তু তদন্ত কমিটি পরে জানতে পেরেছে বিবৃতিটি সাবিনার অনুরোধে ইংরেজিতে লিখে দেন দলের অন্যতম ফুটবলার সুমাইয়া মাতসুশিমা, যিনি জাপানি বংশোদ্ভূত এবং ইংরেজিতে পারদর্শী। সুমাইয়া তদন্ত কমিটির সঙ্গে কথাও বলেছেন ইংরেজিতে। ফলে দূর হয় সব সন্দেহ।
এদিকে সাবিনাদের মিডিয়ার সামনে এসে কান্নাকাটি করাকে অনেক ফুটবলপ্রেমীই ভালোভাবে নেননি। একে তারা ‘নাটক করা’, ‘সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা’, ‘দুই বার সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কথা বলে সুবিধা ও ফায়দা লোটার চেষ্টা’, ‘ফর্ম-ফিটনেস অনুকূলে নেই বুঝতে পেরে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে আরও কিছুদিন ক্যাম্পে থাকার চেষ্টা’,... ইত্যাদি সব অভিযোগের তীর ছুঁড়ছেন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে।
আর এসবে বেশ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েও বেশ সমালোচিত হচ্ছেন নারী ফুটবলাররা। যেমন ঋতুপর্ণা চাকমা নিজের ইন্সটাগ্রামে বেশ অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করেছেন এক সমালোচনাকারীদের। হয় সাবিনারা ক্যাম্প ছেড়ে চলে যাবেন, নয়তো থাকবেন। কিন্তু বাফুফের একটা ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞÑ অবস্থা যেমনই হোক না কেন, বাটলার থাকবেন।
২০০৯ সালে বাংলাদেশ জাতীয় পুরুষ ফুটবল দলের কোচ করা হয় ব্রাজিলের ডিডোকে, যার প্রকৃত নাম ছিল এডসন সিলভা। দলের গুটিকয়েক ফুটবলারকে শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য শাস্তি দেন ডিডো। এরপর দলের সব ফুটবলার একজোট হয়ে ক্যাম্প বর্জন করেন। দাবি জানান, কোচকে বরখাস্ত করতে হবে। বাফুফে বাধ্য হয়ে ডিডোকে সরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সেই ঘটনার পরিণাম শুভ হয়নি।
বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলে ঠিক এরকমই কিছু একটা হচ্ছে বা হতে চলেছে। বাফুফে এখন পর্যন্ত বাটলারের পক্ষেই আছে। অর্থাৎ বাটলারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করতে ইচ্ছুক নয়। এ পর্যন্ত বাটলারের অধীনে একবারও অনুশীলন করেননি সিনিয়র ফুটবলাররা। তবে কোচ তাদের ওপর যে নির্ভরশীল নন, সেটা তা পরিষ্কার।
কেননা তাদের ছাড়াই বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ১৩ জুনিয়র ফুটবলার নিয়ে অনুশীলন করিয়েছেন। এই ১৩ জনই আবারও জিম সেশন করেন। বাটলার বলেছেন, তিনি সিনিয়র নন, জুনিয়র ফুটবলারদের নিয়েই কাজ করতে আগ্রহী।
কোনো সন্দেহ নেই, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে ‘হট ইস্যু’ হচ্ছে নারী ফুটবলে বিদ্রোহ। এ নিয়ে স্বভাবতই ক্রীড়াপ্রেমীদের মাঝে তৈরি হয়েছে তুমুল আলোড়ন। কেউ নারী ফুটবলারদের, কেউ জাতীয় নারী দলের হেড কোচ পিটার বাটলারের, আবার কেউবা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের পক্ষে বা বিপক্ষে কথা বলছেন।
বাংলাদেশ জাতীয় দলের ব্রিটিশ কোচ পিটার বাটলার ও ১৮ সিনিয়র ফুটবলারদের চরম দ্বন্দ্বে বিপাকে পড়েছে দেশীয় ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাফুফে। তারা চেষ্টা করছে বিষয়টি সমাধান করার। ৩০ জানুয়ারি রাতে বাফুফের জরুরি কমিটির সভা অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয়। এই জরুরি কমিটির সদস্য সভাপতি, সিনিয়র সহ-সভাপতি ও চার সহ-সভাপতি। বাফুফেকে এই কমিটি গঠনে অনুরোধ জানিয়েছিল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ।
এদিকে এই সমস্যা সমাধানে আত্মবিশ্বাসী বাফুফে সভাপতি তাবিথ আউয়াল। অনেক ফুটবলবোদ্ধা আবার বলছেন, নারী ফুটবলের এই সমস্যা এতদিন ধরে সমাধান না করে এটাকে জিইয়ে রাখার জন্য বাফুফের নারী উইংয়ের চেয়ারপারসন ও বাফুফে সদস্য মাহফুজা আক্তার কিরণ সবচেয়ে বেশি দায়ী। অনেকে আবার মনে করছেন এর জন্য বাফুফে সভাপতি তাবিথ আউয়ালও দায় এড়াতে পারেন না। কেননা তিনি রাজনৈতিক সফরে ইংল্যান্ডে রয়েছেন। রাজনীতি করাই যদি তার বেশি প্রাধান্য পায়, তাহলে তিনি বাফুফেতে নির্বাচন করে সভাপতি হয়েছেন কেন?
আবার আরেকটা গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। সেটা হচ্ছে- এই সংকটের জন্য দায়ী বাফুফের সহসভাপতি ইমরুল হাসান। তিনি বসুন্ধরা কিংসের সভাপতি। বসুন্ধরা কিংস নারী ফুটবল দলে টানা দুই মৌসুম খেলেন সাবিনা-মারিয়া-মনিকাসহ জাতীয় দলের বিদ্রোহ করা ১৮ ফুটবলারের অধিকাংশই। কিন্তু তৃতীয় মৌসুমে সাবিনা কিংসের হয়ে খেলার জন্য প্রায় দ্বিগুণ পারিশ্রমিক দাবি করলে কিংস এতে রাজি হয়নি। এবং দল গঠন না করে লিগেই অংশ নেয়নি।
সাবিনারা তাই অর্ধেক পারিশ্রমিকেই নাসরিন স্পোর্টস একাডেমির হয়ে খেলতে বাধ্য হন। কিন্তু সাবিনাদের ওপর কিংসের ক্ষোভটা রয়েই যায়। ইমরুল চান না সাবিনাসহ সিনিয়র ফুটবলাররা বাফুফে ভবনের ক্যাম্পে থাকুক। তাই তিনিই নাকি কিরণ-বাটলারকে ইন্ধন জুগিয়ে এই সংকটের সৃষ্টি করেছেন!
‘বাংলার বাঘিনী’ খ্যাত বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের এই মুহূর্তে কোনো খেলা নেই। তারপরও তারা ব্যাপকভাবে আলোচনায় আছে নেতিবাচক কারণে। হেড কোচের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে তার অধীনে খেলতে না চাওয়া, বেতনের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় চুক্তি নবায়ন না হওয়া, সাফে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরেও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাফুফে থেকে দেড় কোটি টাকা বোনাস না পাওয়া, আটটি আন্তর্জাতিক ম্যাচের ম্যাচ ফি না পাওয়া, বিদেশী লিগে খেলার প্রস্তাব পেলেও দুই খেলোয়াড়কে খেলার অনুমতি না দেওয়া... এসব ইস্যুতেই সরব হয়েছেন তারা।
কোনো নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা অভ্যুত্থানকে সাধারণভাবে ‘বিদ্রোহ’ বলা হয়ে থাকে। নানা দেশে, নানা যুগে নানা কারণে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় সেই দেশের সরকার, বাহিনী বা সংস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে বিদ্রোহ করেছে। এই যেমন বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের ফুটবলাররা বিদ্রোহীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এখন দেখার বিষয়, নারী ফুটবলার বনাম বাটলার দ্বন্দ্বের পরিণতি শেষ পর্যন্ত কি হয়।