নারী ফুটবলে ফের বিদ্রোহ
কোন নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা অভ্যুত্থানকে সাধারণভাবে ‘বিদ্রোহ’ বলা হয়ে থাকে। নানা দেশে, নানা যুগে নানা কারণে কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় সেই দেশের সরকার, বাহিনী বা সংস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে বিদ্রোহ করেছে। এই যেমন বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের ফুটবলাররা বিদ্রোহীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।
তাদের বিদ্রোহের কারণ মূলত দুটি। পূর্ব তিক্ত সম্পর্কের জের ধরে দলের হেড কোচ ব্রিটেনের পিটার বাটলারের অধীনে খেলতে না চাওয়া এবং বেতনের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় চুক্তি নবায়ন না হওয়া। এ ঘটনায় স্বভাবতই দেশের ফুটবলাঙ্গনে ঝড় উঠেছে।
অবশ্য এর আগেও সাবিনা-রূপনা-ঋতুপর্ণারা বিদ্রোহ করেছেন। এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বিদ্রোহ করে আবারও আলোচনায় এলেন তারা। তারা ইতোমধ্যেই অনুশীলন বর্জন বা বয়কট করেছেন। অথচ আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়ে দুটি ম্যাচ খেলতে যাওয়ার কথা রয়েছে মারিয়া-মনিকা-সানজিদাদের। সেখানে প্রথমে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে ২৬ ফেব্রুয়ারি ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচে, এরপর ২ মার্চ একটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার কথা রয়েছে কৃষ্ণা-তহুরা-সাগরিকাদের।
এই দুটি ম্যাচ ও জুনের এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে গত ১৫ জানুয়ারি থেকে জাতীয় নারী দলের ক্যাম্প শুরু হয়েছে। এতদিন সহকারী কোচ মাহবুবুর রহমান লিটুর অধীনেই ঠিকঠাক অনুশীলন হচ্ছিল। হেড কোচ বাটলার লম্বা ছুটিতে ছিলেন ইংল্যান্ডে। সেখান থেকে তিনি ঢাকায় আসেন সোমবার রাতে। জানা গেছে তিনি আসার পরই দৃশ্যপট পাল্টে যায়।
মঙ্গলবার তার অধীনে অনুশীলনে অংশ নেননি সিনিয়র ফুটবলাররা। এ প্রেক্ষিতে মাসুরা-সুমাইয়া-আফঈদাদের সঙ্গে বৈঠকেও বসতে চেয়েছিলেন বাটলার। কিন্তু তার এমন প্রস্তাবেও সাড়া দিতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাননি সাবিনারা। বুধবারও কেউ অনুশীলন করেননি। ফলে অনুশীলন বাতিল করা হয়।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে শুধু বাটলার ইস্যুতেই বিদ্রোহ করেননি নারী ফুটবলাররা। আরেকটি কারণ আছে। তাদের বড় ক্ষোভ আছে বেতন-ভাতা নিয়ে। অক্টোবরের পর থেকে আর কোন বেতন পাননি তারা। কারণ তাদের সঙ্গে বেতন প্রদান নিয়ে বাফুফের চুক্তিই ছিল অক্টোবর পর্যন্ত। ফলে ফলে প্রায় তিন মাস ধরে তারা বেতনহীন অবস্থায়। বাফুফের নতুন কমিটি দায়িত্ব নিয়ে মেয়েদের সঙ্গে দেখা করে তাদের সঙ্গে নতুন করে চুক্তি নবায়নের আশ্বাস দিয়েছিল।
কিন্তু তাবিথ আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নতুন কমিটি সেই আশ্বাস এখনো বাস্তবায়ন করেনি। এ নিয়ে বেজায় ক্ষুব্ধ নারী ফুটবলাররা। তারা চাচ্ছেন, আগে চুক্তি নবায়ন, তারপর অনুশীলন। এ ছাড়া গত বছরের অক্টোবরে নেপালে গিয়ে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা অক্ষুণœ রাখার পর বাফুফের নতুন কমিটি সাবিনাদের আর্থিক বোনাস দেওয়ার ঘোষণা দিয়েও সেটা বাস্তবায়ন করেনি। এটাও একটা ব্যাপার।
গত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ থেকেই কোচ বাটলারের সঙ্গে সাবিনাদের তিক্ততা প্রকাশ্যে চলে আসে। একপর্যায়ে বাটলারকে কোচ হিসেবে চাননি মেয়েরা। কিন্তু দল চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাওয়ায় বাফুফের নতুন কমিটি বাটলারকেই আরও দুই বছরের জন্য রেখে দেয়। এটাকে ভালোভাবে নিতে পারেননি সাবিনারা। এ নিয়ে তারা বাফুফে সভাপতির সঙ্গে আলোচনায় বসতে চান বলে জানা গেছে। কিন্তু বাফুফে সভাপতি এখন ইংল্যান্ড সফরে। তিনি ঢাকায় আসা পর্যন্ত তার জন্য অপেক্ষা না করেই সাবিনারা অনুশীলন বর্জন করার মতো গুরুতর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এর আগে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে একবার ক্যাম্প বয়কট করেছিলেন সাবিনারা। দুই পক্ষের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের নারী উইংয়ের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ। কোচ বাটলার এ নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
এর আগে বাফুফে এলিট একাডেমির কোচের দায়িত্বে ছিলেন বাটলার। সেখান থেকে সরিয়ে তাকে গত বছরের মার্চে জাতীয় নারী ফুটবল দলের হেড কোচের দায়িত্ব দেয় বাফুফে। তখন থেকেই তিনি দলের সিনিয়র খেলোয়াড়দের কোণঠাসা করছেনÑ এমন গুঞ্জন ওঠে। সাফের আগে বাংলাদেশ যে কটি প্রীতি ম্যাচ খেলেছে, সেগুলোতে অধিনায়ক সাবিনা খাতুনকে একাদশে রাখতেন না। কোচের এমন কথায় দলে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে ধীরে ধীরে। সেটার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ২০২৪ নারী সাফে বাংলাদেশের প্রথম গ্রুপ ম্যাচে।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচে কোচ প্রথম একাদশে খেলাননি সাবিনা, মাসুরা মারিয়া, সানজিদাদের। দল হারতে হারতে শেষ মুহূর্তে গোল করে ম্যাচটা কোনমতে ড্র করে। ম্যাচের পরেই দলের খেলোয়াড়রা সরাসরি অভিযোগ করেন বাটলারের বিরুদ্ধে, ‘কোচ দলের সিনিয়র পছন্দ করেন না। তাদের খেলাতে চান না।’ বাটলারের কানে এ কথা গেলে তিনিও পাল্টা অভিযোগ তোলেন, ‘ওরা তো খেলার চেয়ে টিকটক করতেই বেশি আগ্রহী!’
সবকিছু নিয়ে সিনিয়র খেলোয়াড়দের সঙ্গে বাটলারের দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওটে। পরে অবশ্য উভয়পক্ষই গণমাধ্যমে সেটা অস্বীকার করে। এত সমস্যার পরও বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত সাফের শিরোপা জেতায় ফুটবলবোদ্ধারা অবাক হন।
বাটলারও দ্বন্দ্বের বিষয়টা নিয়ে যে ক্ষুব্ধ, সেটা বুঝিয়ে দেন দল চ্যাম্পিয়ন হবার পর আর বাংলাদেশ কোচ হিসেবে দায়িত্ব থাকবেন না সেটা জানিয়ে দিয়ে। কিন্তু পরে তাবিথের সঙ্গে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত বদলান। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে তিনি সাবিনাদের কোচ হিসেবে কাজ করতে পারবেন কি না, সেটাই হচ্ছে দেখার বিষয়।