মেসির ক্যারিয়ারের ৮৫০তম গোল করার দিনে হেরেছে তার দল ইন্টার মায়ামি
গায়ে-গতরে যেমন খুব একটা লম্বা নন, তেমনি খুব একটা স্বাস্থ্যবানও নন। ডান পায়ে ও মাথা দিয়ে তেমন খেলতে পারেন না। কিন্তু বল পায়ে তিনি যেন ফুটবলের এক জাদুকর, বিস্ময় মানব। তার বা পায়ের কারুকাজ দেখলে হয়ে যায় চোখের শান্তি, মনের শান্তি। ড্রিবলিং, পাসিং, শুটিং, বিগ চান্স ক্রিয়েট, প্লেমেকিং, গোল, এ্যাসিস্ট ... ফুটবলের সব ধরনের পরিসংখ্যানেই জুড়ে আছেন যিনি, বেশিরভাগ ফুটবলবোদ্ধা ও ফুটবলামোদীদের মতে সর্বকালের সেই সেরা ফুটবলারটি হচ্ছেন লিওনেল আন্দ্রেস মেসি।
অতিমানবীয়-অনুপম ফুটবলশৈলীর কারণে অনেকেই তাকে মজা করে ডাকেন লিওনেল ‘এলিয়েন’ মেসি! ৩৭ বছর বয়সী এই আর্জেন্টাইন গ্রেট পেশাদার-প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল খেলছেন ২০ বছর ধরে। এই সময়টায় তার সঙ্গে তুলনা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে অনেক ফুটবলারের। যেমন : কাকা, ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো, নেইমার, এমবাপ্পে, হালান্ড, লেভানডোস্কি, বেনজেমা, সুয়ারেজ, ভিনিসিউস প্রমুখ। সময়ে সময়ে বদল হয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বী, কিন্তু এলএম টেন রয়ে গেছেন স্বমহিমাতেই।
কি পাননি মেসি? ব্যক্তিগত ও দলীয় সব অর্জনই লুটোপুটি খেয়েছে তার পদতলে। রেকর্ডকে বানিয়ে ফেলেছেন ‘ডালভাত’। ক্যারিয়ারে ফুটবলার হিসেবে সবচেয়ে বেশি রেকর্ড গড়ার সুবাদে ‘গিনেজ বুক অব রেকর্ডস’-এ উঠে গেছে তাঁর নাম। সেটা অবশ্য অনেক আগেই। এজন্যই বোধকরি অনেক মেসিভক্তরা তার নাম রেখেছেন লিওনেল ‘রেকর্ড’ মেসি!
আজ রবিবার মেসি এক ম্যাচে গড়েছেন দু-দুটি রেকর্ড। সেটা ক্লাব দল ইন্টার মায়ামির জার্সিতে। আজ মেজর লিগ সকারের এমএলএস কাপের প্লে-অফ পর্ব পেরুতে ম্যাচে জয়ের বিকল্প ছিল না মেসিবাহিনীর। কিন্তু ঘরের মাঠে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এই খেলায় আটলান্টা ইউনাইটেডের কাছে ৩-২ গোলে হেরে যায় মায়ামি। ফলে প্লে-অফ পর্বের প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় হয় ইন্টার মায়ামির। লিগ পর্বে সবার ওপরে থাকা মায়ামি বিদায় নেয় প্রথম রাউন্ড থেকেই। আর আটলান্টা পৌঁছে যায় ইস্টার্ন কনফারেন্সের সেমিফাইনালে।
যে ম্যাচে মেসি গোল করেন, সাধারণত সে ম্যাচে তাঁর দল হারে না। কিন্তু আজ ছিল ব্যাতিক্রম। মেসি গোল করেছেন, তারপরও মায়ামিকে হারতে হয়েছে!
তবে হারলেও ব্যক্তিগত পরিসংখ্যানে উজ্জ্বল ছিলেন মেসি। করেছেন ক্যারিয়ারের (ক্লাব ও জাতীয় দল মিলে) ৮৫০তম গোল, যা কিনা ম্যাচের হিসেবে দ্রুততম। এটা ছিল তার ১০৮১তম ম্যাচ। এক্ষেত্রে তিনি ভেঙ্গে দিয়েছেন পর্তুগিজ চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর রেকর্ড। রোনাল্ডো ৮৫০তম গোল করেছিলেন ১১৭৯তম ম্যাচে (২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, আল নাসর বনাম আল হাজেম, সৌদি প্রো-লিগ)। অর্থাৎ এক্ষেত্রে সিআর সেভেনের চেয়ে ৯৮ ম্যাচ কম খেলেছেন এলএম টেন। তাছাড়া এটা মেসির ৭৩৮তম (৮৯২ ম্যাচে) ক্লাব গোল ও ইন্টার মায়ামির জার্সিতে ৩৪তম ও হেডের সাহায্যে ২৮তম গোল। বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, আজকের ম্যাচে মেসির একমাত্র গোলটি ছিল হেডে। অনেকদিন পর ‘মাথা খাটিয়ে’ গোল করলেন তিনি!
এখানেই শেষ নয়। ইন্টার মায়ামির জার্সিতেও আজ মেসি আরেকটি রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন, তবে সেটা যুগ্মভাবে। সেটা এ্যাসিস্টের। মায়ামির ফিনিশ সতীর্থ রবার্ট টেলর এতদিন ধরে ক্লাবটির হয়ে সবচেয়ে বেশি ১৮টি এ্যাসিস্টের মালিক ছিলেন। আজ আটলান্টার বিরুদ্ধে একটি এ্যাসিস্ট করে টেলরের পাশে গিয়ে বসলেন মেসি। তার এ্যাসিস্ট ১৮টি (ক্যারিয়ার এ্যাসিস্ট ৩৭৮, ক্লাব এ্যাসিস্ট ৩২১)। তবে একটা ব্যাপারে ঠিকই টেলরকে ছাড়িয়ে গেছেন মেসি। যেখানে টেলর এই এ্যাসিস্টগুলো করতে ১০৮ ম্যাচ খেলেছেন, সেখানে মেসির লেগেছে মাত্র ৩৮ ম্যাচ! অর্থাৎ ৭০ ম্যাচ কম। কোন সন্দেহ নেই, ক্যারিয়ারের গোধূলিলগ্নে চলে এসেছেন মেসি। কিন্তু চর্মগোলকের এই খেলাটি থেকে অবসর নেয়ার আগে ‘গ্রেটেস্ট অব অল টাইম’ এই ফুটবল জাদুকর আরও কত রেকর্ড গড়েন, সেটাই হবে দেখার বিষয়।
মেসির চোখ ধাঁধাঁনো কিছু রেকর্ড :
# একমাত্র ফুটবলার হিসেবে জাতীয় দল ও দুটি ক্লাব দল, অর্থাৎ তিনটি ভিন্ন দলের হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা
# ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি অফিসিয়াল শিরোপা জয় (৪৬টি)
# এক ক্লাবের হয়ে সবচেয়ে বেশি শিরোপা জয় (৩৫টি, বার্সেলোনা)
# সবচেয়ে বেশি ব্যালন ডি’র জয় (৮টি)
# টানা ব্যালন ডি’অর জয় (৪ বার, ২০০৯, ২০১০, ২০১১, ২০১২)
# একমাত্র ফুটবলার হিসেবে ভিন্ন তিনটি দশকে ব্যালন ডি’অর জয়
# সবচেয়ে বেশি গোল্ডেন বুট জয় (৬টি)
# এক পঞ্জিকাবর্ষে সবচেয়ে বেশি গোল (৯১)
# এক পঞ্জিকাবর্ষে এক ক্লাবের হয়ে সবচেয়ে বেশি গোল (৭৯, বার্সেলোনা, ২০১২ সালে)
# একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে ২ বার বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল জয় (২০১৪ ও ২০২২ সালে)
# একটি দলের হয়ে সবচেয়ে বেশি গোল (বার্সেলোনার হয়ে ৬৭২টি গোল)
# এক লিগে সবচেয়ে বেশি গোল (৪৭৪টি, লা লিগায়)
# একটি নির্দিষ্ট ক্লাবের হয়ে (বার্সেলোনা) চ্যাম্পিয়নস লিগে সবচেয়ে বেশি গোল (১২০)
# টানা লিগ ম্যাচে সর্বোচ্চ গোল (২১ ম্যাচে ৩৩ গোল, ২০১২-১৩, বার্সেলোনা)
# পেশাদার লিগে সব দলের বিরুদ্ধে একটানা গোল করা একমাত্র ফুটবলার
# ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি এ্যাসিস্ট (৩৭৮)
# বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ২১ গোলে অবদান রাখা (১৩ গোল, ৮ এ্যাসিস্ট)
# একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বকাপের ফাইনালে সবচেয়ে বেশি গোল (২টি, বনাম ফ্রান্স, ২০২২)
# বিশ্বকাপে প্রতি রাউন্ডে ম্যান অব দ্য ম্যাচ জেতা একমাত্র খেলোয়াড় (গ্রুপ, রাউন্ড অব সিক্সটিন, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল ও ফাইনাল; ২০২২ সালে)
# সবচেয়ে বেশি প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ হওয়া
# সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক হ্যাটট্রিক (১০টি, অংশীদার ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো)
# একমাত্র ফুটবলার যিনি লরিয়াস স্পোর্টসম্যান অব দ্য ইয়ার পুরস্কার জিতেছেন ২ বার
# সবচেয়ে বেশি নন-পেনাল্টি গোল করা
# পেনাল্টি ছাড়া সবচেয়ে বেশি হ্যাটট্রিক গোল
রুমেল খান/ টুম্পা