জীবদ্দশায় কোনদিনও কোন বিষয়ে একমত হতে পারেননি পেলে-ম্যারাডোনা
কি আশ্চর্য, দুই মহান ফুটবলার পেলে ও ডিয়েগো ম্যারাডোনার জন্ম একই মাসে! পেলের জন্ম ২৩ অক্টোবর। আর ম্যারাডোনারটা আজ ৩০ অক্টোবর। তাঁরা যদিও দুজন ভিন্ন সময়ের ফুটবলার, কেউ কোনদিন কারোর সঙ্গে বা বিরুদ্ধে খেলেননি, দুজনের প্লেয়িং পজিশনও ভিন্ন; তারপরও তাঁদের দুজনের মাঝে রয়েছে অনেক মিল।
যেমন : দুজনেই লাতিন আমেরিকান। দুজনেই ১০ নম্বর জার্সি পড়ে খেলেছেন। দুজনেই জিতেছেন বিশ্বকাপ। জন্মেছেন অক্টোবরে ও বস্তিতে। খেলেছেন ১০ নম্বর জার্সি পড়ে। একবারও জেতেননি কোপা আমেরিকা ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ট্রফি। পেলে ও ম্যারাডোনার জন্মের পরেই ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা তাদের প্রথম বিশ্বকাপ জেতে।
কিন্তু এত মিল থাকার পরও জীবদ্দশায় কিন্তু এই দুই গ্রেট ফুটবলারের মাঝে মনের মিল ছিল না (ম্যারাডোনা ২০২০ ও পেলে ২০২২ সালে পরলোকে পাড়ি জমান)।এক্ষেত্রে বিশেষ করে ম্যারাডোনাই ছিলেন এগিয়ে। কখনোই বিন্দুমাত্র ছাড় দিতেন না পেলেকে।
‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত।’ পেলেকে কথার মারপ্যাঁচে বেকায়দায় না ফেলা পর্যন্ত যেন ক্লান্ত আর শান্ত হতেন না তিনি। কে? কে আবার, ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা। পেলে যদি মারতেন ঢিল, ম্যারাডোনা তখন মারতেন কিল। পেলে যদি মারতেন গুল, ম্যারাডোনা তখন ফুটাতেন হুল! পেলে যদি ছুঁড়তেন বন্দুকের গুলি, ম্যারাডোনা তখন দাগাতেন কামান। পেলে যদি দাগাতেন কামান, ম্যারাডোনা তখন ছুঁড়তেন স্কাড মিসাইল!
এভাবেই তাঁদের দ্বৈরথ চলেছে বহু বছর। খেলার মাঠে কখনই পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না ফুটবলের এ দুই মহানায়ক। অনেক আগে বিদায় জানিয়েছেন ফুটবলকে। কিন্তু তারপরও কথার লড়াইয়ে দুজনের বাগযুদ্ধ লেগেই থাকতো। ফুটবলপ্রেমীদের কাছে দারুণ আকর্ষণীয় ও বিনোদন মনে হতো বিষয়টি।
পেলে কোন কিছু নিয়ে মন্তব্য করলেই, সবাই বুঝে যেতেন— চব্বিশ ঘণ্টা পার হতে না হতেই প্রত্যুত্তর দেবেন ম্যারাডোনা। এবং সেটা অনেক ঝাঁঝালো ভাষায়।
বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিবাদের অনেক নজির আছে। কিন্তু পেলে-ম্যারাডোনা দ্বন্দ্বকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি অন্য কোনটাই। পাঠক বা ফুটবলপ্রেমীরা সবসময়ই উন্মুখ হয়ে থাকতেন কবে আবারও ম্যারাডোনা-পেলে ডুয়েল শুরু হয়। আচ্ছা, ম্যারাডোনা এ পর্যন্ত পেলেকে নিয়ে কী কী মধুর ভাষায় ‘বাণী’ প্রদান করেছেন, সেগুলো যদি একসাথে করা হয়, তাহলে কেমন হবে? তাহলে শুরু করা যাক—
১. ‘বিথোভেন! আমি কখনও বিথোভেনের গান শুনিনি। মাঠে তো নয়ই! কারণ মানসিক রোগীদের মানসিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে বিথোভেনের সংগীত শোনানো হয়। পেলে যে কেন বিথোভেন পছন্দ করেন, সেটা তো সহজেই অনুমান করা যায়! পেলে যদি বিথোভেন হন, তাহলে আমি হচ্ছি রন উড, কেইথ রিচার্ডস ও বোনোর সংমিশ্রণ।’
২. ‘ফিফার এক বিশেষ তল্পিবাহকের নাম হচ্ছে পেলে!’
৩. ‘মনে হচ্ছে তিনি (পেলে) ভুল বড়ি খেয়েছেন। ঘুমাতে যাওয়ার আগে যে বড়ি খাওয়ার কথা, সেই বড়ি তিনি খেয়েছেন সকালে। আর এ জন্যই তিনি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। কী বলছেন তা তিনি নিজেই জানেন না। এতো পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়! আমার মনে হয় এরপর পেলে যদি কোন কথা বলতে চান, তাহলে আগে তার সঠিক ওষুধ খাওয়া উচিত। শুধু তাই নয়, আমি পরামর্শ দিচ্ছি চিকিৎসক পাল্টানোর। নইলে আবার কি বলতে কী সব উল্টোপাল্টা বলে বসবেন, তার কোন ঠিক-ঠিকানা থাকবে না। আমরা তাঁর এসব উদ্ভট প্রলাপ শুনতে চাই না।’
৪. ‘ফুটবলপ্রেমীরা আমাকে ভোট দিয়ে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফুটবলার নির্বাচিত করেছে। পেলে হয়েছেন দ্বিতীয়। তিনি তো নিজের দেশেই এক নম্বর জনপ্রিয় ক্রীড়াবিদ নন! জরিপে দেখলাম ব্রাজিলের সর্বশীর্ষ জনপ্রিয় ক্রীড়াবিদ হচ্ছেন কার রেসার আয়ারটন সেনা। সেনার পর হচ্ছেন পেলে।’
৫. ‘পেলে গত ২০ বছর ধরে কিছুই করছেন না। তাকে জাদুঘরে পাঠিয়ে দেয়া উচিত।’
৬. ‘পেলে হচ্ছেন ফিফা প্রেসিডেন্ট সেপ ব্লাটারের চাবি দেয়া পুতুল!‘ ৭. ‘আপনার আমাকে পেলের সঙ্গে তুলনা করছেন কেন? আমার মা বলতেন, আমিই সবার সেরা।’
৮. ‘আগে লোকে ম্যারাডোনা-পেলেকে নিয়ে আলোচনা করতো, এখন আলোচনা করে ম্যারাডোনা-মেসিকে নিয়ে।’
৯. ‘টোগো ফুটবল দলের ওপর যখন সন্ত্রাসী হামলা হলো, তখন পেলে বলেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হওযা উচিত না। আজ দক্ষিণ আফ্রিকানরা বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সফলভাবে করে দাঁতভাঙ্গা জবাব দিল ওই বুড়ো ভামটাকে!’
১০. ‘পেলের চরিত্র কেমন, সেটা সবাই জানে। কাজেই আমি আর নতুন করে বলতে চাই না টিনেজ বয়সে তিনি যে নিজ বাড়ির কাজের ছেলের কাছে কৌমার্য বিসর্জন দিয়েছিলেন!’
১১. ‘ম্যারাডোনা এবং পেলের মধ্যে সবচেয়ে বড় তফাত হলো— ম্যারাডোনা একজন বাদে বিশ্বের বাকি সব ফুটবলারকে শ্রদ্ধা করে। পেলে সেটা করেন না। তিনি সেই শ্রদ্ধা জমিয়ে রাখেন নির্দিষ্ট কিছু বিতর্কিত ব্যক্তিদের জন্য, যাদের আবার ম্যারাডোনা শ্রদ্ধা করে না!’
মজার ব্যাপার— এ দুজনের মধ্যে তুলনা করা হয় প্রায়ই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এরা কেউ কোনদিন পরস্পরের বিরুদ্ধেই খেলেননি! শুধু তাই নয়, পেলে ছিলেন স্ট্রাইকার, ম্যারাডোনা মিডফিল্ডার। পেলে ইউরোপে না খেললেও ম্যারাডোনা খেলেছেন। তেমনি ম্যারাডোনা অধিনায়কত্ব ও কোচিং করলেও পেলে করেননি।