মাঠে ও মাঠের বাইরে সব জায়গাতেই এক বর্ণিল চরিত্র ছিলেন ম্যারাডোনা
বর্ণিল এক চরিত্র ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা। নিন্দিত-নন্দিত হয়েছেন বহুবার। সবসময়ই ভালবাসেন ঘটনার জন্ম দিতে ও সংবাদমাধ্যমের প্রধান শিরোনাম হতে। ক্যারিয়ারের সূচনালগ্ন থেকে জীবনের অন্তিম লগ্ন পর্যন্ত অনেক ঘটনাই ঘটিয়েছেন।
যেমন— স্বদেশী সাংবাদিকদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে তাদের এয়ারগান দিয়ে গুলি করেছেন, সাংবাদিক-প্রতিপক্ষ কোচকে গালি দিয়ে জরিমানার শিকার হয়েছেন, সাবেক মার্কিন পেসিডেন্ট জর্জ বুশকে ‘খুনি’ বলেছেন, ৮৬’ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে হাত দিয়ে গোল করেছেন (যাকে তিনি অভিহিত করেছিলেন ‘হ্যান্ড অব গড’ বলে), ফিফার সমালোচনা করেছেন, পেলের সঙ্গে কথার দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়েছেন, মাদকসেবনে জীবন সঙ্কটাপন্ন করেছেন, ফিডেল ক্যাস্ট্রোর আতিথ্য নিয়েছেন, নিজের হাতে বিশ্বখ্যাত বিপ্লবী চে গুয়েভারার উল্কি এঁকেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছেন, টিভি শো ‘নাম্বার টেন’ টক শো’র উপস্থাপক হয়ে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েয়ছেন, বিশ্বকাপে জাতীয় দলের পরাজয়ে কেঁদে আপ্লুত হয়েছেন, অভদ্র ফুটবল দর্শককে লাথি মেরেছেন, প্রিয় কুকুরের কামড় খেয়েছেন, ইতালিতে আয়কর ফাঁকি দিয়েছেন... আরও কত কি! ম্যারাডোনার চার্চে তার নামের ধর্মের অনুসারীরা।
ম্যারাডোনা। স্বনামেই বিশ্বের কোটি মানুষের কাছে পরিচিত। ফুটবলারদের মধ্যে সর্বকালের সেরা দু’জনের মধ্যে একজন। জীবনটা তাঁর রূপকথার মতো। উত্থান-পতনে পরিপূর্ণ। লানুসের এক বস্তিতে তাঁর জন্ম ৩০ অক্টোবর, ১৯৬০ সালে। পরিবার ছিল চরম দারিদ্রতার কষাঘাতে ক্লিষ্ট। ম্যারাডোনার পরিবার এতটাই গরীব ছিল, দু’বেলা তো দূরের কথা— প্রায়ই তাদের একবেলাও খাওয়া জুটতো না। জন্মদিন পালন করা, ক্রিসমাস ডে উদ্যাপন করা, নতুন জামা-জুতো পরা, স্কুলে যাওয়া— এসব কোনদিনই জোটেনি ম্যারাডোনার কপালে। একবার তো বস্তির পাশে এক গভীর নর্দমায় পড়ে প্রাণটা খোয়াতে বসেছিলেন হামাগুড়ি দিতে শেখা শিশু ম্যারাডোনা। ছোট চাচার চোখে পড়ায় রক্ষা। তিনি তড়িৎ বেগে উদ্ধার করেন তাঁকে। বেঁচে যান ম্যারাডোনা। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা জাতীয় দলের অধিনায়ক ছিলেন। সেবার স্রেফ একক নৈপুণ্যে দলকে শিরোপা জিতিয়ে দিয়ে ফুটবলবিশ্বকে হতবাক করে দেন। সবাইকে ভাবতে বাধ্য করেন, ব্রাজিলের পেলে নন, তিনিই এই ধরণীর শ্রেষ্ঠ ফুটবলার। পরে স্বদেশী লিওনেল মেসি ছাপিয়ে যান তাঁকে।
ম্যারাডোনাকে ফুটবলের ঈশ্বর বলে ডাকা হয়। শুধু তাই নয়, তার নামে আছে ধর্ম এবং আলাদা একটি চার্চও।
আর্জেন্টাইনদের মনে ম্যারাডোনার অবস্থান কোন স্থানে, তারই উদাহরণ হচ্ছে ম্যারাডোনিয়ান চার্চ। ১৯৯৮ সালে ম্যারাডোনার ৩৮তম জন্মদিনে চার্চটি প্রতিষ্ঠিত হয়। যারা এই ধর্মের অনুসারী তাদের ম্যারাডোনিয়ান হিসেবে অভিহিত করা হয়।
ম্যারাডোনিয়ান চার্চটি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এইরেস থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে রোজারিওতে অবস্থিত। এখানে সবাই ১০ নম্বর জার্সি পরে প্রার্থনা করতে আসে। সেখানে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে পড়ানো হয় ম্যারাডোনার আত্মজীবনী। সারা বিশ্বে দুই লাখ ভক্ত এই চার্চের অনুসারী।
চার্চের ট্রাস্টি বোর্ডে রয়েছেন আর্জেন্টিনার সাবেক ফুটবলার আলেজান্দ্রো ভেরন। তিনি স্মৃতিচারণে বলেন, একবার ২৯ অক্টোবর মাঝরাতে একটা ফোন পান। ট্রাস্টি বোর্ডের এক সদস্যই তাকে ফোন করে বলেন, ‘মেরি এক্স-মাস’। ভেরন বলেন, ‘তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? আজ তো আমরা সবে ৩০ অক্টোবরে পড়লাম।’
ফোনকারী সোজা উত্তর দিয়ে বলেন, ‘ঠিক তাই। আমাদের যিশু তো ৩০ অক্টোবরই জন্মেছেন।’ এই কথা থেকেই অনুমান করা যায় আর্জেন্টিনার জনমনে ম্যারাডোনার অবস্থান কেমন ছিল। এই কিংবদন্তি না থাকলেও থেকে যাবে তার স্মৃতি। সবার মনে ভালোবাসার একজন হিসেবেই থাকবেন ডিয়েগো।
ইগলেসিয়া মারাদোনিয়ানা ধর্মের ১০টি নৈতিক হিতোপদেশ নিম্নরূপ :
১। বল নিজেকে অসম্মান করে না, যেমনটা ডি১০ তাঁর বইয়ে ঘোষণা করেছেন।
২। অন্য সবকিছুর উপরে ফুটবলকে ভালবাসো।
৩। ডিয়েগো এবং ফুটবলের সৌন্দর্যের জন্য নিঃশর্ত ভালবাসা ঘোষণা করুন।
৪। আর্জেন্টিনার (জাতীয় ফুটবল দলের) জার্সি রক্ষা করুন।
৫। ডিয়েগো'র অলৌকিকতার সংবাদ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিন।
৬। ডিয়েগো'র খেলার স্থান, এবং তার পবিত্র জার্সিকে সম্মান করুন।
৭। ডিয়েগোকে কোনও একক দলের সদস্য হিসাবে ঘোষণা করবেন না।
৮। ম্যারাডোনিয় গির্জার নীতি প্রচার করুন ও ছড়িয়ে দিন।
৯। আপনার মধ্যনাম 'ডিয়েগো' রাখুন এবং আপনার প্রথম ছেলের নাম 'ডিয়েগো' রাখুন।
১০। বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বেঁচে থাকবেন না এবং অকেজো হবেন না।
১৯৯৭ সালে নিজের ৩৭তম জন্মদিনে তিনি অশ্রুজলে বিদায় জানান আন্তর্জাতিক ফুটবলকে। জাতীয় দলের হয়ে ৯১ ম্যাচে ৩৪ গোল করেন এই কালজয়ী ফুটবলার। আজ তাঁর জন্মদিন। বিশ্বের কোটি কোটি ম্যারাডোনা ভক্তদের হৃদয়ে গেঁথে আছেন তিনি।
রিয়াদ