ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১

তৈলাক্ত বাঁশে ওঠানামায় দেশের ফুটবল

পুরনো ব্যাধি, সারিবে কিভাবে?

রুমেল খান

প্রকাশিত: ০০:২২, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

পুরনো ব্যাধি, সারিবে কিভাবে?

এই হাসি মাঠে দেখাতে পারছেন না বাংলাদেশের ফুটবলাররা

‘জীর্ণতা বাসা বেঁধেছে আজি এ অন্তরালে/অসুস্থতা তুমি মোরে করেছ পরাজিত/নিথর দেহখানি পড়ে রয়েছে/ সমস্ত পৃথিবীটা আজ অন্তঃসারশূন্য।’ কবির লেখা এই কবিতার মতোই আজ আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল! সেটা এক পুরনো রোগ আবারও ফিরে আসার কারণে। অথচ বাংলাদেশী অগণিত ফুটবলপ্রেমীরা ধরেই নিয়েছিলেন এই ব্যধিটি দূর হয়ে গেছে ভালমতোই। কিন্তু ‘যেই লাউ, সেই কদু’র মতো হয়ে গেছে ব্যাপারটা। আজ এটা নিয়েই কিঞ্চিত বাতচিতের অবতারণা।
‘শুধু দেশপ্রেম থাকলেই আর দেশবাসীর কাছে দোয়া চাইলেই হবে না, জেতার জন্য ভালো খেলতে জানতে হবে।’ ফেসবুকে এক ফুটবলপ্রেমী এমনই এক ব্যাঙ্গাত্মক স্ট্যাটাস দিয়েছেন। বলাই বাহুল্য, পাঠকরা নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন এই স্ট্যাটাসটা দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলকে নিয়ে, যারা গত ৯ আগস্ট বিমানযোগে ঢাকায় সকালে ফিরে এসেছেন।

র‌্যাংকিংয়ের উন্নতি ও সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে লাল-সবুজ বাহিনী ভুটানে গিয়েছিল দুটি ফিফা আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ খেলতে। একটি ম্যাচে তারা জিতেছে ও অন্য ম্যাচে হেরেছে। ফলে সিরিজ ড্র হয়েছে ১-১ ব্যবধানে। জেতা ম্যাচেও বাংলাদেশ যে খুব একটা ভালো খেলেছে, এমনটা বলা যাবে না। বরং প্রতিপক্ষ ভুটানই শ্রেয়তর নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছিল।

বাংলাদেশ মূলত জিতেছিল শেখ মোরসালিনের ‘লাকি’ গোলে! কিন্তু দ্বিতীয় ও শেষ ম্যাচে সেই ‘লাক’টা আর ফেভার করেনি তাদের ক্ষেত্রে। বরং ম্যাচের প্রায় শেষদিকে গিয়ে ডিফেন্সের ভুলে গোল হজম করে হারের তেতো স্বাদ পায়।
বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের বিশেষ একটি রোগ ছিল। সেটা হলো খেলার শেষদিকে গোল হজম করে হেরে যাওয়া। তবে গত ৩-৪ বছর ধরে সেই রোগের বেশ ভালোই উপশম ঘটেছিল। কিন্তু গত ৮ আগস্ট দ্বিতীয় ম্যাচে সেই পুরনো রোগ আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে! এই ম্যাচে চোটের কারণে বাংলাদেশের রাকিব হোসেন এবং বিশ্বনাথ ঘোষ খেলেননি।

নিয়মিত অধিনায়ক জামাল ভুঁইয়াকেও প্রথম একাদশে রাখা হয়নি প্রথম ম্যাচের মতো। দুটি ম্যাচেই বাংলাদেশ খেলে ছন্নছাড়া ও অপরিকল্পিত ফুটবল। এই জয়ের ফলে ভুটান বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আট বছর পর আবারও জয়ের স্বাদ পায়। ২০১৬ সালে একই ভেন্যুতে তারা বাংলাদেশকে হারিয়েছিল ৩-১ গোলে। ১৬ ম্যাচে বাংলাদেশ জিতেছে ১২ ম্যাচে, ভুটানের জয় ২ ম্যাচে, ড্র হয়েছে ২ ম্যাচে।  
বাংলাদেশ কোচ জাভিয়ের ক্যাবরেরা তার দল সম্পর্কে বলেন, ‘আমরা ভুটানের ভালো কন্ডিশনে প্রস্তুতি নিতে পেরেছি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতার মতো চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে খেলাও দলের জন্য ভালো। আমার মনে হয়, সবসময় খেলার মধ্যে থাকা দলের জন্য ভালো এবং আমাদের একই লক্ষ্য থাকে সব উইন্ডোতে। আমাদের খেলায় আরেকটু উন্নতি করতে হবে।’

শেষ মিনিটে গোল খাওয়া নিয়ে ক্যাবরেরার ভাষ্য, ‘রক্ষণে আমাদের ভুল হয়েছে। বল ড্রপ এলাও এবং পরেই গোল হওয়া। দুই ক্ষেত্রেই ভুল আছে। যে গোলটি খেলাম, সেটা হয়তো আমরা আটকাতে পারতাম, কিন্তু পারিনি। ঠিক আছে, ফুটবলে এমন কিছু হতেই পারে। হার মেনে নিতে হয়।’
দ্বিতীয় ম্যাচে বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে দৃষ্টিকটু দিক ছিল ডিফেন্ডার তপু বর্মণের ভুল। তা হলোÑ শেষ মুহূর্তে করা ভুটানের গোলের সময় প্রতিপক্ষ ফুটবলারকে না আটকে বরং সহকারী রেফারিকে অফসাইডের পতাকা তোলার ইঙ্গিত দেওয়া! এই দৃশ্যটি ফেসবুকের মাধ্যমে ভাইরাল হলে অনেকেই সমালোচনায় মেতে ওঠেন। যদিও তপু দাবি করেছেন- ওই মুহূর্তে তার নাকি কিছুই করার ছিল না, ‘মনোযোগের ঘাটতি ছিল।

প্রথমেই আমাদের বলটা বিপদমুক্ত করা উচিত ছিল এবং সেটা জটলা থেকেই। কিন্তু তা করতে পারিনি বলেই তাদের কাছে বলটা চলে যায়। তারা দুই টাচে বলটা জালে পাঠিয়ে দেয়। ওই জায়গায় শুধু ডিফেন্স লাইনের প্লেয়ারই ছিল না, পুরো দলের সবাই ছিল। আমি মনে করি, ওই পরিস্থিতিতে বলটা ক্লিয়ার করার প্রয়োজন ছিল, যেটা করতে পারিনি।’
তপু আরও বলেছেন, ভুটানের খেলোয়াড়ের সঙ্গে তার দূরত্ব প্রায় ১৫-২০ মিটার ছিল। ১ সেকেন্ডে তিনি এই দূরত্ব কাভার করতে পারেননি।

সবশেষে বলেন, ‘এই হারের দায়টা আমাদের নিতেই হবে। আমরা জয়ের একটা সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করেছি।’ ম্যাচে হারার পর বাংলাদেশ হয়ে গিয়েছিল ‘অধিক শোকে পাথর’! সবাই নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন। সবাই হতাশায় হন নিমজ্জিত। ওই রাতে ভালো করে ঘুমাতে পারেননি কেউই! র‌্যাঙ্কিংয়ে উন্নতির জন্য যে উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ভুটান সফর করেছিল, তা সফল হয়নি (ভুটান ১৮২, বাংলাদেশ ১৮৪)।

এখন যদি তিন মাস খেলার বাইরে, ভুটানের উচ্চতা, টার্ফের মাঠ, ঠা-া আবহাওয়া... এসব অজুহাত দেওয়ার চেষ্টা করে বাংলাদেশ দল, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তা কারোর কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। বাংলাদেশ কোচ স্পেনের জাভিয়ের ক্যাবরেরাকে নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। কেননা তিনি দলকে এখনো প্রত্যাশিত মানে নিয়ে যেতে পারেননি। বসুন্ধরা কিংসের সাবেক স্প্যানিশ কোচ অস্কার ব্রুজোনের পরামর্শ মতো নাকি ক্যাবরেরা দলগঠন করেন, এমন অভিযোগ তার বিরুদ্ধে অনেক আগেই উঠেছিল।

এটা ঠিক, বিগত সময়ের চেয়ে এখন জাতীয় ফুটবল দলের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু ফলাফল যে অশ্বডিম্ব! একসময় বাংলাদেশ দল মালদ্বীপকে হেসে খেলে ‘হালি দুয়েক’ গোল উপহার দিত। আর এখন তাদের হারাতেই পারে না। যে ভুটানকে বাংলাদেশ আগে পাত্তাই দিত না, সময়ের পরিক্রমায় সেই ভুটানও আজ র‌্যাংকিংয়ে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ।

×