ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ফুটবলার-কমকর্তাদের সঙ্গে কোচ আলফাজ আহমেদ (বাঁ থেকে দ্বিতীয়)
দীর্ঘ ১৪ বছর পর ফেডারেশন কাপ ও ২০১৪ সালের পর প্রথম ট্রফি জয় করে উড়ছে ঢাকা মোহামেডান স্পোর্র্র্টিং ক্লাব লিমিটেড। কুমিল্লা থেকে চোখ ধাঁধানো সাফল্যের পর মোহামেডানের প্রত্যাশা আরও বেড়ে গেছে। এখন বিখ্যাত সাদা-কালো জার্সিধারীদের সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ। আর এটা করতে বদ্ধপরিকর দলটিকে বদলে দেওয়ার কারিগর কোচ আলফাজ আহমেদ।
দেশের ক্রীড়া ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি ক্লাবের নাম ঢাকা মোহামেডান ও ঢাকা আবাহনী লিমিটেড। আকাশী-নীল জার্সিধারী আবাহনী নিজেদের দাপট ধরে রাখলেও বিখ্যাত সাদা-কালোরা যেন হারিয়েই গিয়েছিল। একটা শিরোপার জন্য মতিঝিল পাড়ার ক্লাবটির কত সাধনা, কত অপেক্ষা, কত হাপিত্যেশ। অবশেষে সাফল্যের সেই সোনার হরিণ ধরা দিয়েছে মোহামেডানের তাবুতে। গত ৩০ মে কুমিল্লার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে ফেডারেশন কাপ ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনীকে ভাগ্যনির্ধারণী টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে হারিয়ে দীর্ঘ ১৪ বছর পর ফেডারেশন কাপ এবং ২০১৪ সালের পর প্রথম শিরোপা জয়ের উৎসব করেছে কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসার দল ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান।
সাদা-কালোদের রঙিন এই সাফল্যের পর দেশের মৃতপ্রায় ফুটবল আবারও চাঙ্গা হয়ে উঠবে বলে বিশ্বাস ফুটবল সংশ্লিষ্টদের। চাতকপাখির মতো অপেক্ষা শেষে এমন সাফল্যে মোহামেডান ক্লাবে এখন চলছে উৎসব-আনন্দ। ৮৭ বছরের ক্লাবটি এই সাফল্যেকে পুঁজি করে হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন বুনছে। মোহামেডানের এমন রঙিন সাফল্যের অন্যতম কারিগর আলফাজ আহমেদ। ভারপ্রাপ্ত কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার প্রায় তিন মাসের মাথাতেই তিনি মোহামেডানকে ফিরিয়েছেন কক্ষপথে। বাংলাদেশ জাতীয় দল ও মোহামেডানের সাবেক স্ট্রাইকার এই সাফল্য ধরে রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
ধর্মসাগর পাড়ে সাদা-কালোদের সাফল্যের পর ৪৯ বছর বয়সী আলফাজ মনে করেন কেবল মোহামেডানের নয়, এতে করে দেশের ফুটবলেরও জয় হয়েছে। সোনালি দিন হারিয়ে ফেলা মোহামেডান ফুটবলের আঙিনায় ধুঁকছে অনেক বছর ধরে। শিরোপা খরা চলছিল সেই ২০১৪ সাল থেকে। এবারের মৌসুমের মাঝপথে কোচ শফিকুল ইসলাম মানিককে বিদায় করে দিয়ে আলফাজের হাতে দায়িত্ব তুলে দেন মোহামেডানের কর্মকর্তারা। সাবেক এই তারকা স্ট্রাইকারের হাত ধরেই মোহামেডান ধীরে ধীরে নিজেদের হারানো গৌরব ফিরে পেতে চলেছে। ১৪ বছর পর মোহামেডানকে ফেডারেশন কাপের ফাইনালে তোলার পর আলফাজ বলেছিলেন, একটি জয় মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে তাদের।
শিরোপা জয়ের পর তিনি বলেন, এর আগেও আবাহনীর বিরুদ্ধে এমন ফাইনাল মোহামেডান খেলেছে। আমি নিজেও সেই ম্যাচে খেলেছি। কিন্তু আমি সেই ম্যাচটাকে এগিয়ে রাখব না। এই ম্যাচে শুধু মোহামেডানের জয় হয়নি; জয় হয়েছে বাংলাদেশের ফুটবলের। অবশ্যই এটা আমার জীবনের স্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে। খেলোয়াড় হিসেবে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম, কোচ হিসেবেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। মধুর স্মৃতি হয়ে থাকবে। এই ট্রফির মাধ্যমে মোহামেডান এগিয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
১৯৯৫ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে ৬২ ম্যাচ খেলে ১১ গোল করা আলফাজ বলেন, মোহামেডানের খেলাটা আমার কাছে মনে হয়েছে বিশাল একটা ফুটবল ম্যাচ। যেভাবে ব্যাকফুটে থেকে সমতায় ফেরা, এগিয়ে যাওয়া, আবার সমতা ফেরা, আবার লিড নেওয়া, সমতা ফেরা, টাইব্রেকারে যাওয়া। সবমিলিয়ে বোঝা যাচ্ছিল না ম্যাচটা কে জিতবে। খেলোয়াড়েরা সবাই কমিটেড ছিল, সুলেমান দিয়াবাতের পারফর্মেন্স অসাধারণ। মুজাফফরভের হাত ভেঙে গেলেও সে দলের জন্য খেলেছে। আসলে আমি বলব এই প্রশংসার দাবিদার খেলোয়াড়রা। তারা তাদের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে মোহামেডানের জন্য খেলেছে এবং চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
অথচ গত মার্চে আলফাজ যখন মোহামেডানের প্রধান কোচের দায়িত্ব নেন, তখন সাদা-কালোদের অবস্থা একেবারেই রুগ্ন। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে ১০ ম্যাচে ১২ পয়েন্ট নিয়ে তালিকায় মোহামেডানের অবস্থান ছিল ছয় নম্বরে। জয় ছিল মাত্র তিনটি। সেই মোহামেডানই সেমিফাইনালে বসুন্ধরা কিংস ও ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনীকে হারিয়ে ফেডারেশন কাপ জিতেছে। শুধু তাই নয়, লিগেও দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে পয়েন্ট তালিকার তিন নম্বরে উঠে এসেছে। লিগে এই স্থানটা এখন ধরে রাখার লক্ষ্য মোহামেডান কোচের। আলফাজ এ প্রসঙ্গে বলেন, আমরা পরে অনেক এগিয়েছি। এখন তিন নম্বরে আছি। এখানে থাকাটা এখনো নিশ্চিত নয়। হাতে তিনটি ম্যাচ আছে, এই তিন ম্যাচ জিততেই হবে। কোচ হিসেবে মোহামেডানকে কক্ষপথে ফেরানো আলফাজ ক্লাবটির জার্সিতে খেলোয়াড় হিসেবেও ছিলেন দারুণ সফল। ১৯৯৫ সালে প্রথমবার মোহামেডানে এসেই জিতেছিলেন ডামফা কাপ ও ফেডারেশন কাপ। একাধিকবার জিতেছেন ঢাকা লিগ, জিতেছেন জাতীয় লিগের শিরোপাও।
চোখ ধাঁধানো সাফল্যের পর ভারপ্রাপ্ত থেকে আলফাজকে স্থায়ীভাবে মোহামেডানের প্রধান কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া সময়ের ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছে। আলফাজ যেমন এমনটি চাচ্ছেন তেমনি ক্লাবটির সমর্থকরাও মনেপ্রাণে এটাই প্রত্যাশা করছেন। তবে পরের মৌসুমে মোহামেডান তাঁবুতে আসতে পারে বিদেশী কোচ। সেক্ষেত্রে আলফাজের ভূমিকা কি হবে সেটা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। সঙ্গতকারণেই ফুটবল অঙ্গনে এখন আলোচনায় আলফাজ। যার কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছেন বেশ কয়েক বছর ধরে বসুন্ধরা কিংসের কোচের দায়িত্ব পালন করা স্প্যানিশ কোচ অস্কার ব্রুজেন ও আবাহনীর কোচ মারিও লেমোস। প্রো-লাইসেন্সধারী দুই কোচের কাছ থেকে ফেডারেশন কাপটা ছিনিয়ে নিয়েছেন ‘এ’ লাইসেন্সধারী কোচ আলফাজ।
২০১৫ সালে নারী দলের দায়িত্ব নিয়ে মোহামেডানের কোচ হিসেবে অভিষেক হয়েছিল আলফাজের। তার নেতৃত্বে মোহামেডান নারী লিগে রানার্সআপ হয়েছিল। তারপর তিন বছর কোচের দায়িত্ব পালন করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দলে। সেখান থেকে ২০১৯ সালে তার বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে অভিষেক হয় উত্তর বারিধারার ডাগআউটে দাঁড়িয়ে। টানা তিন মৌসুম ধরে তিনি বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে মোহামেডানের সহকারী কোচের দায়িত্ব পালন করছিলেন। এর মধ্যে দুই মৌসুম ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান শন লেনের অধীনে। এবারের মৌসুমের অর্ধেক সময় ছিল শফিকুল ইসলাম মানিকের অধীনে।
আগামী মৌসুমেও সাদা-কালো ডাগউটে দেখা যাবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে আলফাজ বলেন, চলতি মৌসুম পর্যন্ত সহকারী কোচ হিসেবে মোহামেডানের সঙ্গে আমার চুক্তি আছে। লিগের মাঝপথে আমি প্রধান কোচের দায়িত্ব পালন করেছি। ক্লাবের সঙ্গে এ নিয়ে আমার কোনো কথা হয়নি। এখনো লিগের খেলা বাকি আছে। আমি ক্লাবের দিকে তাকিয়ে আছি।
ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় ২০২৪ সালে এএফসি কাপ খেলার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে মোহামেডানের। দেড় যুগ পর আন্তর্জাতিক আসরে খেলতে হলে মোহামেডানকে এএফসির ক্লাব লাইসেন্সিং করতে হবে। তখন ক্লাবকে একজন প্রো-লাইসেন্সধারী কোচ নিয়োগ দিতেই হবে।
এ প্রসঙ্গে আলফাজ বলেন, ক্লাব বিদেশী কোচ আনার পর আমাকে থাকতে হলে তো সহকারী হিসেবেই থাকতে হবে। কথাবার্তায় বনিবনা হলে থাকতে সমস্যা নেই। ক্লাব যদি আমার চাহিদা পূরণ না করে বা মূল্যায়ন না করে তাহলে আমাকে নিজের পথ দেখতে হবে। তবে এখনো লিগ শেষ হয়নি। তাই আপাতত এসব নিয়ে ভাবছি না। দেখি ক্লাব কি বলে। আলফাজ জানিয়েছেন, তার প্রো-লাইসেন্স করার পরিকল্পনাও আছে।