
লাহোরে মেয়েদের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে স্বমহিমায় উজ্জ্বল ছিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতি
১৯৭৩ সালে শুরু মেয়েদের ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ প্রথম সুযোগ পায় ২০২২ সালে। চূড়ান্ত পর্বে জায়গা করে নিতে সেবার ২০২১ সালে জিম্বাবুয়েতে বাছাইপর্ব খেলতে যেতে হয়েছিল। কিন্তু তিন ম্যাচ খেলার পর করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের প্রাদুর্ভাবে বাছাইপর্ব বাতিল ঘোষণা করে আইসিসি। নিয়ম অনুযায়ী ওয়ানডে র?্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকার সুবাদে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের মূল পর্বে জায়গা করে নেয় টাইগ্রেসরা। এবার আর সেই সুযোগ হয়নি।
লাহোরে সদ্য ছয় দেশ নিয়ে অনুষ্ঠিত বাছাই পর্বের সেরা দুইয়ে থাকার সুবাদে টানা দ্বিতীয়বারের মতো শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে বাংলাদেশ। নারী ক্রিকেটের জন্য নিশ্চয়ই বড় অর্জন। কিন্তু এবারও মেয়েরা সুযোগটা পেয়েছে ‘ভাগ্যের চাকায়’ ভর করে। টানা তিন জয়ের পর উইন্ডিজ ও পাকিস্তানের কাছে বড় হারে নিগার সুলতান জ্যোতিদের ভাগ্য ঝুলে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ-থাইল্যান্ড ম্যাচে। এক পর্যায়ে সমীকরণ দাঁড়ায়, ক্যারিবীয়রা ১০.১ ওভারের মধ্যে ১৬৭ রান স্পর্শ করতে না পারলে টিকিট পাবে বাংলাদেশ। ছক্কা হাঁকানো সাপেক্ষে উইন্ডিজের সুযোগটা ১১ ওভার পর্যন্ত, তবে সেক্ষেত্রে চার মারতে হবে পঞ্চম বলে, আর ষষ্ঠ বলে ছক্কা! কিন্তু পঞ্চম বলেই ছক্কা হয়ে যায়!
৬ উইকেটের জয় সত্ত্বেও নেট রান রেটে ভগ্নাংশেরও কম ব্যবধানে পিছিয় থাকায় কপাল পোড়ে ওস্টে ইন্ডিজের (০.৬২৬)। শঙ্কা আর দাত কামড়ানো উৎকণ্ঠার পর বিশ্বকাপে বাংলাদেশের (০.৬৩৯) মেয়েরা। ‘আমরা প্রথমদিকে ভালোই করেছিলাম। যেহেতু শেষ দিকে আমাদের ওই সুযোগটা ছিল যে আমরা কোয়ালিফাই করতে পারব। শুরুতে আমরা ভালো চেষ্টা করেছি, তো স্টিল প্রথম তিন ম্যাচে ভালো করার ফলে কিন্তু আমরা সুযোগ পেয়েছি। তবে দুইটা ম্যাচ ভালো করতে পারিনি।
থাইল্যান্ডের রান দেখে মনে এতটুকু বিশ্বাস ছিল যে সবকিছু যদি ঠিকঠাক থাকে তাদের যে টার্গেট ছিল হিউজ। তো স্টিল তারা যেভাবে করেছে, আল্লাহ আসলে কপালে না রাখলে হতো না।’ বিশ্বকাপের টিকিট নিয়ে দেশে ফিরে বলছিলেন জ্যোতি। বাছাই খেলতে যাওয়ার আগে প্রধান কোচ সারওয়ার ইমরান বলেছিলেন, এই দলের নিয়মিত ২৮০ রান করার সামর্থ্য আছে। থাইল্যান্ড (২৭৩/৩) ও স্কটল্যান্টের (২৭৬/৬) বিপক্ষে সেটা পারলেও বাকি ম্যাচে ব্যর্থ তারা। আসরে শুরুটা বেশ ভালোই করেছিল জ্যোতির দল। রান-উইকেটের একাধিক রেকর্ড গড়ে উড়িয়ে দিয়েছিল থাইল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডকে। আইরিশদের বিপক্ষে এসেছিল ২ উইকেটের নাটকীয় জয়।
কিন্তু ব্যাটিং ব্যর্থতায় উইন্ডিজ ও পাকিস্তানের কাছে ৩ ও ৭ উইকেটের হারে রান রেটের মারপ্যাঁচে পড়তে হয়। সতীর্থদের পারফর্ম্যান্সের উত্থান-পতনে ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পরেনি মেয়েরা। তবে অধিনায়ক ঠিকই বুঝিয়ে দিয়েছেন কেন তিনি নিজ সময়ের অন্যতম সেরা। এক সেঞ্চুরি ও দুই ফিফটিতে ৬০ গড়ে করেছেন আসরের তৃতীয় সর্বোচ্চ ২৪১ রান জ্যোতির। থাইল্যান্ডের বিপক্ষে ১০১ রানের পথে ৭৮ বলে শতক ছুঁয়ে দেশের হয়ে গড়েন দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ৫১ ও স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে অপরাজিত ৮৩।
লাহোরে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে ব্যাটিংয়ে একগাদা রেকর্ড গড়ে ২৭১ রান তোলে বাংলাদেশ। বোলিংয়ে তো বিশ্বরেকর্ডই হয়ে যায়। দুই স্পিনার ফাহিমা খাতুন ও জান্নাতুল ফেরদৌস সুমনার দারুণ বোলিংয়ে মাত্র ৯৩ রানে গুটিয়ে যায় থাইল্যান্ড। ওয়ানডেতে এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয়। গত নভেম্বরের আয়ারল্যান্ডকে ১৫৪ রানে হারিয়েছিল তারা। ৫টি করে উইকেট নেন ফাহিমা ও সুমনা। নারী ওয়ানডের ইতিহাসে এক ইনিংসে দুই বোলারের ৫ উইকেট নেওয়ার প্রথম কীর্তি এটি।
এই দুজনের আগে ওয়ানডেতে বাংলদেশের হয়ে ৫ উইকেট নিতে পেরেছিলেন শুধু খাদিজাতুল কুবরা ও নাহিদা আক্তার। ম্যাচের ২৭১ ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ। আগের সর্বোচ্চ আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ২৫২ রান। অবশ্য স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে তৃতীয় ম্যাচেই সেটি ছাড়িয়ে ৬ উইকেটে ২৭৬ রান করে মেয়েরা। ৫৯ বলে অপরাজিত ৮৩ রান করে ম্যাচসেরা হন জ্যোতি। থাইল্যান্ডের বিপক্ষে ৭৮ বলে সেঞ্চুরি ছুঁয়ে দেশের হয়ে দ্রুততম শতরানের রেকর্ড গড়ে ১০১ রানের ইনিংস খেলেন অধিনায়ক। শারমিন অপরাজিত ৯৪।
তৃতীয় উইকেটে দুজনে গড়েন ওয়ানডেতে দেশের হয়ে রেকর্ড সর্বোচ্চ ১৫২ রানের জুটি। গত ডিসেম্বরে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ফারজানা ও শারমিনের ১৪৩ রানের জুটি ছিল আগের রেকর্ড। জ্যোতি, শারমিনের আগে পঞ্চাশছোঁয়া ইনিংস খেলেন আরেক অভিজ্ঞ ব্যাটার ফারজানা হক। এক ইনিংসে বাংলাদেশের তিন ব্যাটারের ফিফটির ঘটনাও এটিই প্রথম। ফারজানার সঙ্গে শারমিনের দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে আসে ১০৪ রান। একই ওয়ানডেতে বাংলাদেশের শতরানের দুটি জুটির প্রথম নজিরও এটি। শারমিনের কথাও আলাদা না করে বললেই নয়।
তিন ফিফটিতে তার রান ২৬৬ রান, যা আসরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তিন জয়ে শুরুর পর কোয়ালিফায়ার টুর্নামেন্টে বড় দুটি দলের বিপক্ষেই হেরে গেছে বাংলাদেশের নারীরা। এ নিয়ে জ্যোতিদের ব্যাটিং কোচ ডেভিড হেম্প বলেন, ‘যে দুই ম্যাচের কথা বললেন উভয় খেলাতেই আমরা মাঝে মাঝে বেশ ভালো পজিশনে ছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অন্যান্য সময়ে আমাদের অধারাবাহিকতার কারণে প্রতিপক্ষ দল আবার খেলায় ফিরে যায়। তবে খেলোয়াড়দের এই টুর্নামেন্ট থেকে সাহসী এবং আত্মবিশ্বাস হওয়া উচিত।
কারণ সামগ্রিকভাবে তারা ব্যক্তিগত এবং সম্মিলিতভাবে খুব ভালো ক্রিকেট খেলেছে।’ নির্বাচক সাজ্জাদ আহমেদ শিপন বলেন, ‘অনুভূতি তো অবশ্যই ভালো, কোয়ালিফাই করছি ভালো লাগা থাকবেই। গতবারও কিন্তু আমরা কোয়ালিফাই খেলে তারপর বিশ্বকাপে গিয়েছিলাম। এরকম একটা কঠিন ম্যাচের পরিবেশ পার করে তারপে গিয়েছিলাম। এ বছর আমরা প্রথম তিনটা ম্যাচ ভালো করেছিলাম। শেষ দুইটা ম্যাচ ভালো করতে পারি নাই, বড় দলের বিপক্ষেই হারতে হয়েছে। আমরা এখানেই ফেল করছি, এটা নিয়ে অনেক কাজ করতে হবে, কাজের অনেক সুযোগ রয়েছে।’
অবশ্য দলের ফিল্ডিং এবং বোলারদের নিয়ে বার্তা দিয়ে শিপন আরও যোগ করেন, ‘ফিল্ডিংয়ের অনেক উন্নতির জায়গা রয়েছে। ভালো বোলিং সাইড দলের বিপক্ষে রান করার উন্নতির দরকার রয়েছে। এটা নিয়ে অনেক কাজ করতে হবে। এ ছাড়া সিঙ্গেল বের করার ক্ষমতাটা রাখতে হবে। আমাদের দলের বিপক্ষে বিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানরা গ্যাপ বুঝে বুঝে খেলছে, সেই রানগুলো আমরা ঠেকাতে পারিনি।’