
মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ও মুশফিকুর রহিম
মার্চ-এপ্রিল ১৯৯৭। কুয়ালালামপুরে আইসিসি ট্রফিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে নবদিগন্তের সূচনা হয়েছিল। ১৯৯৯ ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে প্রথমবার উড়েছিল লাল-সবুজের পতাকা। আকরাম খান, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, মোহাম্মদ রফিক, খালেদ মাহমুদ সুজন, খালেদ মাসুদ পাইলট, আতহার আলি খানÑ জ্বলজ্বলে একেকটি নাম।
আকরাম-বুলবুলরা যদি হন ইতিহাসের অংশ, তবে মাশরাফি বিন মুর্তজা, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদদের বলতে হবে আধুনিক টাইগার ক্রিকেটের পথ প্রদর্শক। অকালে ঝড়ে যাওয়া ফুল মোহাম্মদ আশরাফুলের সৌজন্যে বাংলাদেশের ক্রিকেট যে প্রথম গ্লোবাল স্টারের স্বাদ পেয়েছিল, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবালরা সেটিকে দিয়েছেন অন্যমাত্রা। শুরু হয়েছিল বহু আগে ২০০১ সালে পেসার মাশরাফিকে দিয়ে।
এরপর এলেন এক উইকেটকিপার, ১৫ নম্বর জার্সি গায়ে মুশি। এরপর একে একে যোগ দিলেন তামিম, সাকিব, মাহমুদুল্লাহ। ধীরে ধীরে তারা পাঁচ জন হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের পঞ্চপা-ব। কত সাফল্য, কত অর্জন, কত রেকর্ড, কত কীর্তিÑ নানা ঘটনা প্রবাহে মুশি-রিয়াদের বিদায়ে রঙিন পোশাকে শেষ হলো পঞ্চপা-ব অধ্যায়।
যার শুরু আছে, তার শেষও আছে, এটাই প্রকৃতির নিয়ম। দেশ-কাল-সংস্কৃতি ভেদে ক্রীড়াঙ্গনে শেষের এই চিত্রটা অবশ্য ভিন্ন। এবারের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেই যেমন ফর্ম ও ফিটনেস থাকা সত্বেও সেমিতে ভারতের কাছে হারের পর অবসর নেন স্টিভেন স্মিথ। অস্ট্রেলিয়ান তারকা ব্যাটার বলেন, ২০২৭ বিশ্বকাপ সামনে রেখে তরুণদের নিয়ে পরিকল্পনার এখই সময়। ৩৭ পেরিয়ে ৩৮Ñএ পা দিয়েছেন মুশফিক, মাহমুদুল্লাহ ৪০।
কিন্তু অফ-ফর্ম ও বয়স বিবেচনায় গত বিশ্বকাপের পর থেকেই সমালোচনার মুখে দুই তারকা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে হতাশ করেন। ভারত ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ০ ও ২ রানে অত্যন্ত দৃষ্টিকটু ভাবে আউট হন মুশফিক। কিউইদের বিপক্ষে একমাত্র ইনিংসে ১১ বলে ৪ রান করে মাহমুদুল্লাহ সাজঘরে ফেরেন আরও অবিবেচকের মতো। প্রশ্ন ওঠে আর কত? দুজনেই দেশে ফিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওয়ানডে থেকে অবসরের ঘোষণা দেন।
২০০৬ সালে প্রথম ওয়ানডে খেলা মুশফিক গত ১৯ বছরে খেলেছেন ২৭৪ ম্যাচ। ৯ সেঞ্চুরি ও ৪৯ ফিফটিতে ৩৬.৪২ গড়ে করেছেন মোট ৭৭৯৫ রান, যা বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তামিমের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ২০১১ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ দলকে ওয়ানডেতে নেতৃত্বও দিয়েছেন তিনি। গত কিছু দিন রানের মধ্যে ছিলেন না। গত বছরের মার্চে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অপরাজিত ৭৩ রানের পরের ৬ ইনিংসে ফিফটি করতে পারেননি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া অবসর ঘোষণায় মুশফিক লিখেছেন, ‘আমি ওয়ানডে ফরম্যাট থেকে অবসর ঘোষণা করছি। সবকিছুর জন্য আলহামদুলিল্লাহ। বৈশ্বিক পর্যায়ে আমাদের অর্জন সীমিত হতে পারে, তবে একটি বিষয় নিশ্চিত, যখনই আমি আমার দেশের জন্য মাঠে নেমেছি, নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে ১০০ ভাগের বেশি দিয়েছি।’
চ্যাম্পিয়নস ট্রফি থেকে বাংলাদেশ দলের জয়হীন বিদায়ের পর ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনায় থাকা এই ক্রিকেটার এরপর লিখেছেন, ‘গত কয়েক সপ্তাহ আমার জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল, এবং আমি বুঝতে পেরেছি যে এটাই আমার নিয়তি।’ আর মাহমুদুল্লাহ লিখেছেন, ‘সকল প্রশংসা কেবল সর্বশক্তিমান আল্লাহর। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি।’ তবে বিদায়টা যে মনের মতো হয়নি, সেটি বোঝা গেছে তার বিদায়ী বার্তার শেষদিকে, ‘সবকিছুর সমাপ্তি সবসময় নিখুঁত হয় না।
তবে হ্যাঁ-বলতে হয় এবং সামনে এগিয়ে যেতে হয়। শান্তি... আলহামদুলিল্লাহ। আমার দল ও বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য শুভকামনা।’ যে সংস্করণ সবার শেষে ছাড়লেন, সেই ওয়ানডে দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার পথচলা শুরু হয়েছিল মাহমুদুল্লাহর। ২০০৭ বিশ্বকাপের পর শ্রীলঙ্কা সফরে অভিষেক হয় তার। দলে নিয়মিত হয়ে ওঠেন ২০০৮ সালে। ২৩৯ ওয়ানডে খেলে চার সেঞ্চুরি ও ৩২ ফিফটিতে ৫ হাজার ৬৮৯ রান নিয়ে শেষ হলো তার ক্যারিয়ার, ব্যাটিং গড় ৩৬.৪৬।
হাত ঘুরিয়ে উইকেট নিয়েছেন ৮২টি। ৫০ টেস্ট খেলে ২০২১ সালে টেস্ট থেকে বিদায় নেন তিনি। গত অক্টোবরে ভারত সফর দিয়ে ইতি টানেন ১৪১ ম্যাচের টি২০ ক্যারিয়ারের। এবার ওয়ানডের বিদায় দিয়ে আন্তর্জাতিক অধ্যায়ের সমাপ্তি হলো।
মুশফিক-মাহমুদুল্লাহরা বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে অনেক স্মরণীয় জয় এনে দিয়েছেন। পঞ্চপা-বদের পরবর্তী প্রজন্ম কি তাঁদের দেখানো পথে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পারবেন কি না, সেই প্রশ্ন এখন বড় হয়ে সামনে আসছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের চেয়ারম্যান নাজমুল আবেদীন ফাহিম বলেন, ‘মাশরাফি, তামিম, মুশফিক, সাকিবদের মতো কিংবদন্তি ক্রিকেটাররা সহজে আসে না।
কিন্তু সময় এলে পুরনোদের তো যেতেই হবে। যারা এখন জাতীয় দলে আছে, তারা যোগ্যতা ও পারফরম্যান্সের মাধ্যমে নিজেদের জায়গা করে নেবে। আমাদের তাদের ওপর আস্থা রাখতে হবে।’ তানজিদ হাসান তামিম, তাওহিদ হৃদয়, রিশাদ হোসেনের মতো তরুণেরা এখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন নিয়মিত।
নাজমুল হোসেন শান্ত, সৌম্য সরকার, লিটন দাস, মুস্তাফিজুর রহমান, তাসকিন আহমেদ, লিটন দাস, মেহেদি হাসান মিরাজের মতো ক্রিকেটাররাও গড়ে ৯-১০ বছরের মতো খেলছেন বাংলাদেশের জার্সিতে। বিসিবির সাবেক নির্বাচক ও বর্তমান আবাহনী কোচ হান্নান সরকারের মতে তরুণদের হাত ধরেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ গড়া সম্ভব, ‘অনেকে বলে বাংলাদেশের পাইপলাইনে মানসম্মত ক্রিকেটার নেই।
আসলে ক্রিকেটার আছে। কিন্তু আমরা তাদের যথাযথভাবে গড়ে তোলার সুযোগ দিচ্ছি না। প্রস্তুতি সম্পন্ন না করেই জাতীয় দলে খেলানো হচ্ছে। তবু আমি বলব, বিসিবির তত্ত্বাবধানে বেশ কিছু প্রতিভাবান ক্রিকেটার রয়েছে, যারা সময়ের সঙ্গে নিজেদের প্রমাণ করবে।’ ডিপিএলে এখন নুরুল হাসান সোহান, মাহিদুল ইসলাম অঙ্কন, জাকের আলী অনিক, আফিফ হোসেন, শামীম হোসেন, আকবর আলী, ইয়াসির আলী চৌধুরীর মতো ক্রিকেটাররা আলো ছড়াচ্ছেন।
হান্নান বলেন, ‘ডিপিএলে কে কোন কন্ডিশনে কেমন খেলছে, সেটা বিশ্লেষণ করে জাতীয় দলে বাছাই করা হবে বুদ্ধিমানের কাজ। এভাবেই ভবিষ্যতের ব্যাকআপ ক্রিকেটার তৈরি করা সম্ভব।’ অবশ্য তামিম-মুশফিকদের মতো ক্রিকেটার সহসা তৈরি করা সম্ভব নয় বলেও মনে করেন তিনি, ‘তামিম, সাকিব, মাহমুদুল্লাহ, মুশফিকদের মতো ক্রিকেটার তৈরি করতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। বিসিবি ২০২৭ বিশ্বকাপকে সামনে রেখে পরিকল্পিতভাবে এগোচ্ছে।’