
রাওয়ালপিন্ডিতে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে রানআউট হয়ে হতাশায় মাঠে বসে পড়েন টাইগার ব্যাটার জাকের আলি।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ব্যাটিং কোচ হিসেবে নিল ম্যাকেঞ্জি গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজে হাত দিয়েছিলেন। যেহেতু বাংলাদেশী ক্রিকেটারদের পেশিশক্তির ঘাটতি রয়েছে তাই সেভাবে হার্ডহিটার পাওয়া যায় না। এ কারণে ‘রানিং বিটুইন দ্য উইকেট’ তত্ত্বে বলে বলে রান নেওয়ার কৌশলে ব্যাটারদের নিয়ে কাজ করেছেন। তার তত্ত্ব অনুসারে প্রতি ওভারে ব্যাটারদের নির্দিষ্ট পরিমাণে রান করার টার্গেট দেওয়া হতো অনুশীলনে।
সেটি চার-ছক্কা হাঁকিয়ে নয়, বরং প্রতিবলে যেন সিঙ্গেলস কিংবা ডবলস নেন ব্যাটাররা সেই ফর্মুলা কার্যকর করতে চেয়েছেন ম্যাকেঞ্জি। প্রায় দুই বছর কাজ করে ২০২০ সালে স্বেচ্ছায় দায়িত্ব ছাড়েন তিনি। এখন বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং নিয়েই যত সমস্যা। এবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বাংলাদেশী ব্যাটাররা যে মনোভাব নিয়ে ব্যাটিং করেছেন তা বিশ^ব্যাপীই নানা প্রশ্ন তুলেছে। টানা দুই ম্যাচ বাংলাদেশ হেরে বিদায় নিয়েছে মূলত দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাটিংয়ের জন্যই।
সাফল্যের অন্তরায় হয়ে উঠেছে অতিমাত্রায় ‘ডট বল’! ভারতের বিপক্ষে ২৯৮টি বৈধ বল ব্যাট করে ১৫৯টিই ডট এবং নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৩০০টি বৈধ বলের মধ্যে ১৮১টি ডট বল খেলেছেন বাংলাদেশী ব্যাটাররা। ফলে বাংলাদেশ দল পড়ে গেছে ঘোর অমানিশায়।
এবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে খেলতে গেছে বাংলাদেশ। কারণ ৮ বছর আগের সর্বশেষ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে রানার্সআপ হয়েছে তারা। কিন্তু সাম্প্রতিক ফর্ম ক্রমেই বাংলাদেশ দলকে নিচের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ওয়ানডেতে এক সময় বিশে^র সেরা দলগুলোর জন্য ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠা বাংলাদেশ দল এমনকি উদীয়মান আফগানিস্তানের কাছেও সিরিজ হারছে।
আইসিসি র্যাঙ্কিংয়ে তাই বাংলাদেশ ৯ নম্বরে আর আফগানিস্তান আটে। গত দুই বছরে বাংলাদেশ ৪৩ ওয়ানডে খেলে মাত্র ১৪টি জিততে পেরেছে, হেরেছে ২৬টি (৩টি পরিত্যক্ত হয়েছে)। একই সময়ে আইসিসির পূর্ণ সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ম্যাচ জেতার অনুপাতে শুধু আয়ারল্যান্ড নিচে বাংলাদেশের। জয়-পরাজয়ের অনুপাত বিবেচনায় বাংলাদেশ ০.৫৩৮ ও আয়ারল্যান্ড ০.৫৩৩।
বাকি ১০ দল বাংলাদেশের উপরে। এখান থেকেই স্পষ্ট কতটা নি¤œমুখী হয়েছে বাংলাদেশ দলের পারফর্ম্যান্স। এর পেছনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যাটিং দৈন্যতাকে দায়ী করেছেন সবাই। ব্যাটিং সহায়ক উইকেটেও বাংলাদেশী ব্যাটারদের যে মনোভাব তা অনেক সময়ই বিস্মিত করেছে সবাইকে। যার কারণে আইসিসি ইভেন্ট কিংবা এশিয়া কাপের মতো বড় টুর্নামেন্টে প্রতিপক্ষরা যেখানে বাংলাদেশকে মোকাবিলায় হিসাব-নিকেশ করত, এখন তা করতে হয় না।
২০২৩ সালের বিশ^কাপ থেকেই চরম বাজে পারফর্ম্যান্সের শুরু। সেবার ভারতের মাটিতে হওয়া বিশ^কাপে রানের বন্যা বয়ে গেছে প্রতিটি ম্যাচে। কিন্তু বাংলাদেশী ব্যাটাররা সেই ছন্দে তাল মেলাতে পারেননি। এটি শুধুই পেশিশক্তিতে ঘাটতি নয়, বরং টেকনিক ও ব্যাটারদের ইন্টেন্ট, স্কিলের সমস্যা বলেই চিহ্নিত করেছেন সবাই।
এজন্য ২০২২ সালের টি২০ বিশ^কাপের আগে ভারতের খ্যাতিমান কোচ শ্রীধরন শ্রীরাম এই ব্যাটিং ইন্টেন্ট ও যতক্ষণ কোনো ব্যাটার ক্রিজে থাকবেন তার ইমপ্যাক্ট নিয়েই কাজ করেছেন। যাতে রান কম হওয়ার সমস্যায় না ভোগে বাংলাদেশ। অথচ এখন প্রায় প্রতিটি ম্যাচ হারের পর অধিনায়ক ও ক্রিকেটাররা আক্ষেপের সুরে বলেন ২০/৩০ রান কম হয়েছে। সেটি ২০২৩ বিশ^কাপে প্রকটভাবেই দেখা গেছে।
৯ ম্যাচ খেলে একটিতে বাংলাদেশ দল ৩০০+ রান করতে পেরেছে (দুটি ২৫০+)। এমন ব্যাটিংয়ের জন্যই ৭টি ম্যাচই হেরেছে বাংলাদেশ। সবমিলিয়ে ৯ ম্যাচে ২৪৪৯টি বৈধ বল মোকাবিলা করেছেন বাংলাদেশের ব্যাটাররা। এর মধ্যে ডটই দিয়েছেন ১৩৯৩টি বল। অর্থাৎ ব্যাট করা ৪০৮.১ ওভারের মধ্যে রানই হয়নি ২৩২.১ ওভার! রান হয়েছে ২০৫৩।
একেবারে ফুলটস বলেও চার-ছক্কা হাঁকাতে না পারা, ফ্রি-হিটের সদ্ব্যবহার করতে না পারার উদাহরণ অনেক। একই অবস্থা চলমান চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দুই ম্যাচে। ভারতের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ ৪৯.৪ ওভারে ২২৮ রানে গুটিয়ে গেছে। ১৫৯টি ডট বল (২৬.৩ ওভার) বাকি ১৩৯ বলে (২৩.১ ওভার) রান এসেছে। উইকেটের চরিত্র কিছুটা কঠিন ছিল। কিন্তু ভারতীয় দলের রোহিত শর্মা ব্যতীত বাকি ব্যাটাররা চার-ছক্কার আশায় না থেকে ফাঁক-ফোকরে বল ঠেলে রান নিতেই মনোযোগী হয়েছেন।
একই কাজ তারা করেছেন পাকিস্তানের বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচেও। আর রাওয়ালপিন্ডির দারুণ উইকেটে বাংলাদেশী ব্যাটাররা আরও হতাশাজনক ব্যাটিং করেছেন। ১৮১ বলই ডট (৩০.১ ওভার) দিয়েছেন তারা ৫০ ওভার ব্যাট করে। তাই রান হয়েছে মাত্র ২৩৬! আধুনিক ক্রিকেটে টেস্টেও ‘বাজ বল’ ছন্দে ধুন্ধুমার ব্যাটিং করছে সব দল। বর্তমান সময়ে ২৮০-৩০০ রানের নিচে ওয়ানডে স্কোর দেখাটাই বিরল হয়ে গেছে।
কিন্তু সেখান থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ নেই ব্যাটারদের অতিমাত্রায় ‘ডট বল’ খেলার কারণে। এ নিয়ে অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত বলেছেন, একটা সময় ৫-১০ ওভার পরপরই আমাদের উইকেট পড়েছে। এটা ডট বল বেশি হওয়ার একটা কারণ। বড় জুটি গড়তে পারলে এত বেশি ডট বল হয়ত হতো না।
কিন্তু ব্যাটিংয়ের এই বেহাল অবস্থা আর ‘ডট বলই’ বাংলাদেশের সাফল্যে অন্তরায় হয়েছে। কিউইদের বিপক্ষে ডেথ ওভারেও বাংলাদেশ রান তুলতে পারেনি। ৪৫তম ওভার মেডেন হয়েছে। প্রথম ২৫ ওভারেই ১০০ বল ডট হয়। এমন ব্যাটিংয়ে জেতা যায় না তা পরে হারটাই প্রমাণ করেছে।