বাংলাদেশের জার্সিতে এভাবে আর সাকিবকে না দেখার সম্ভাবনাই বেশি
মানুষের জীবন অনেকটা নাটকের মতো। ক্ষণে ক্ষণে ঘটে পটপরিবর্তন। কখনো সাফল্য, কখনো ব্যর্থতা, কখনো বা আলো আবার কখনো বা অন্ধকার। বাংলাদেশের ক্রিকেটের অহংকার, সাবেক বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের ক্ষেত্রেও এমন বলা যায় অবলীলায়। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে সাবেক বাংলাদেশ অধিনায়কের সঙ্গী হয়েছে সুখ-দুঃখ, সাফল্য-ব্যর্থতা সবই।
মাঠের পারফরমেন্স দিয়ে যেমন ক্রিকেট বিশ্বকে শাসন করেছেন তেমনি বারংবার বিতর্কিত কর্মকা-ের জন্য সমালোচিতও কম হননি। সব মিলিয়ে বর্ণময় চরিত্রের অধিকারী সাকিব তার ঢঙেই একের পর এক চমক দিয়েছেন। ৩৭ বছর বয়সী এই মহাতারকা গত সেপ্টেম্বরে অনেকটা চমক দিয়েই টেস্ট ও টি২০ ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন।
যে কারণে বাংলাদেশের হয়ে শুধু ওয়ানডে খেলার সুযোগ আছে সাকিবের। কিন্তু গত কয়েক মাসে নানা নাটকীয়তা ও সবশেষ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বোলিংয়ে নিষিদ্ধ হওয়ায় তাঁর ক্যারিয়ারে নেমে এসেছে ঘোর অমানিশা। এখন আর বাংলাদেশের জার্সিতে সাকিবের খেলার সম্ভাবনা খুব একটা নেই। আগামী ফেব্রুয়ারিতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দলেও জায়গা না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এমন ইঙ্গিতই দিয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু।
যে কারণে এখন অনেকটাই নিশ্চিত, বাংলাদেশের ক্রিকেটে সাকিব অধ্যায় শেষ হয়ে গেছে! গত আগস্টে দেশে রাজনৈতিক পালাবদলের পর সাকিবের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। মামলা হওয়ার সময় সাকিব ছিলেন বাংলাদেশ দলের সঙ্গে পাকিস্তান সফরে। ওই সফরের পর তিনি আর দেশে ফেরেননি। পাকিস্তান থেকে ইংল্যান্ডে যান কাউন্টি ক্রিকেটে খেলতে। সেখান থেকেই সরাসরি যান ভারত সফরে। এরপর দেশে ফেরার ইচ্ছা থাকলেও এখন পর্যন্ত সেটা সম্ভব হয়নি।
বর্ণময় ক্যারিয়ারে অন্ধকার সরিয়ে সাকিব বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। নিজের কাজে পারিপার্শ্বিক কোনোকিছুই প্রতিবন্ধক হতে পারেনি। যে কারণে নিজেকে নিয়ে যান সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। পৌঁছে যান আকাশছোঁয়া উচ্চতায়। মাঠের ধারাবাহিক পারফরমেন্স দিয়েই তিনি হয়েছেন বাংলাদেশের অহংকার, গৌরব। তারকা এই অলরাউন্ডারের অতিমানবীয় কীর্তিতে বাংলাদেশের নাম জ্বলজ্বল করে জ্বলেছে ক্রিকেটবিশ্বে। কারও কাছ থেকে দুঃখ বা কষ্ট পেলে অনেকেই মুষড়ে পড়েন।
প্রভাব পড়ে তার ব্যক্তিজীবন বা কর্মজীবনে। কিন্তু সাকিব আল হাসান এসবের ধার ধারেন না। কোনোকিছুই তাকে বিচলিত করতে পারে না। কষ্টের যাতনা আছে তাঁর মধ্যেও, দুঃখ পেলে মন খারাপ হয়। কিন্তু অদম্য মানসিকতার সাকিব এসবকে পাত্তা দেন না। নিজের কাজটা করে যান নিষ্ঠার সঙ্গে। বাংলাদেশের জার্সি গায়ে ক্রিকেট মাঠে এমনই করেছেন বছরের পর বছর। ক্রিকেট সাকিবের কাছে ইবাদতের মতো। মাঠ তীর্থস্থানের মতো।
দেশের পতাকা সমুজ্জ্বল রাখতে যে কোনো মূল্যে তিনি আপোসহীন। অনেক সমালোচনা, দুঃখ, কষ্ট পেয়েছেন কিন্তু তাতে কর্ণপাত করেননি মাগুরার ছেলে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেই সাকিবকে এবার সত্যি সত্যিই থামতে হচ্ছে। দেশের ঘরোয়া ক্রিকেট বাদে সব জায়গায় বোলিং নিষিদ্ধ হওয়ায় আরও বিপাকে পড়েছেন সাকিব। সদ্যই ইসিবির বোলিং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ও দেশের বাইরে সবধরনের ঘরোয়া টুর্নামেন্টে শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলতে হবে।
কাউন্টি ক্রিকেট খেলতে গিয়ে ধরা পড়া ত্রুটিপূর্ণ বোলিং অ্যাকশনে ইংল্যান্ড ও ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের (ইসিবি) প্রতিযোগিতা তো বটেই, দেশের ঘরোয়া ক্রিকেট বাদে সব জায়গায় নিষিদ্ধ হয়েছে সাকিবের বোলিং। ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসির অবৈধ বোলিং অ্যাকশনের নীতিমালার ১১.৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এখন আবার আইসিসি অনুমোদিত কোনো পরীক্ষাগারে নিজের বোলিং অ্যাকশনের পরীক্ষা দিতে হবে সাকিবকে।
ওই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলে আবারও বোলিংয়ের অনুমতি মিলবে। এর আগ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ও দেশের বাইরে যে কোনো প্রতিযোগিতায় শুধু ব্যাটার হিসেবে খেলতে হবে সাকিবকে। এক্ষেত্রে আইসিসির নীতিমালায় দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে বোলিং করার ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া আছে। যেন অভিযুক্ত বোলার নিজ দেশের ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় খেলে নিজের বোলিং অ্যাকশন শোধরানোর কাজ করতে পারেন। বর্তমানে গল মার্ভেলসের হয়ে লঙ্কা টি১০ লিগে খেলছেন সাকিব। ইসিবির শাস্তি পাওয়ার পর দলটির হয়ে বোলিং করতে পারছেন না।
গত সেপ্টেম্বরে ভারত সফরে টেস্ট সিরিজ খেলার পর থেকেই জাতীয় দলের বাইরে আছেন সাকিব। দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে আর খেলা হয়নি বিশ্বসেরা তারকার। যে কারণে ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে অভিজ্ঞ অলরাউন্ডারের জাতীয় দলে ফেরার সম্ভাবনা। সামনের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে তাঁকে দেখা যাবে কি না, সে বিষয়ে কোনো বার্তা এখন পর্যন্ত দেয়নি বিসিবি। নির্বাচক কমিটিও জানে না সাকিবের জাতীয় দলে ফেরার ব্যাপারে সবশেষ অবস্থা কী।
মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের প্রদর্শনী ম্যাচ শেষে নানা প্রসঙ্গে কথা বলেন গাজী আশরাফ হোসেন লিপু। সেখানে আসে সাকিবের কথাও। এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচক বলেন, ‘কিছু প্রশ্নের উত্তর সরাসরি আমার কাছে নেই। সাকিব আল হাসানের বিষয়ে আপনারাই অবহিত আছেন। এই মুহূর্তে আমি সরাসরি পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারব না, তার দলে অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারটা। সাকিবের বর্তমান অবস্থা পুরোপুরি ভিন্ন ইস্যু। এটা গতানুগতিক কোনো বিষয় নয়। এটা অস্বাভাবিক একটা বিষয়, যেটা সাকিব আল হাসানের ক্ষেত্রে হচ্ছে।’
গত সেপ্টেম্বরে ভারত সফরের কানপুর টেস্টের আগে টি২০ থেকে অবসরের ঘোষণা দেন সাকিব। একইসঙ্গে তিনি বলেন, দেশের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম টেস্ট খেলে এই সংস্করণকেও বিদায় জানাতে চান। সেই চাওয়া পূরণে দেশে ফেরার পথে দুবাইয়ে থেমে যায় সাকিবের যাত্রা। দেশের উত্তাল পরিস্থিতির মাঝে নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তাকে তখন দেশে ফিরতে নিরুৎসাহিত করা হয়।
এরপর থেকেই থমকে আছে তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। আপাতত দেশের বাইরের বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট খেলে বেড়াচ্ছেন সাকিব। বোলিং নিষিদ্ধ হওয়ায় ওইসব আসরেও সাবেক বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের অপরিহার্যতা কমতে শুরু করেছে। সবমিলিয়ে ছোট হতে শুরু করেছে বর্ণময় সাকিবের ক্রিকেট দুনিয়া।