ওয়ানডে ক্রিকেটে দীর্ঘদিন ধরেই দাপটের সঙ্গে খেলে আসছিল বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক সময়ে সাফল্যের হাসি হাসতে পারছেনা টাইগাররা
এশিয়া কাপের ফাইনাল, চ্যম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল, বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল- বাংলাদেশের ক্রিকেটে স্মরণীয় যত সাফল্য তার বেশিরভাগই এসেছে ওয়ানডেতে। এমনকি ২০২০-২০২৩ ওডিআই লিগ টেবিলে ইংল্যান্ডের সমান দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৫ ম্যাচ জিতে তৃতীয়সেরা দল হিসেবে বিশ্বকাপে জায়গা করে নিয়েছিল টাইগাররা। সেই প্রিয় ফরম্যাটেই এ কী হাল! দীর্ঘ এক দশকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে কেবল সিরিজ হারই নয়, চলতি বছর ৯ ম্যাচ খেলে ৬টিতেই হেরেছে বাংলাদেশ, শেষ ১১ ম্যাচে হার ৮টিতে।
চলতি ক্যারিবীয় সফরে দ্বিতীয় টেস্ট জিতে চমকে দেওয়া মেহেদি হাসান মিরাজের দল ওয়ানডে সিরিজে পাত্তাই পায়নি, ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ হওয়ার পথে হার ৫, ৭ ও ৪ উইকেটে। অথচ আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চে পাকিস্তানে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আগে আগেই এটিই বাংলাদেশের শেষ ওয়ানডে সিরিজ। আশ্চর্যের ব্যাপার তিন ম্যাচের দুটিতেই তিন শ’র ওপরে রান করেও সেটি ডিফেন্ড করতে পারেনি। সম্প্রতি বোলিংয়ের এত যে প্রশংসা সেটি নিয়েও তৈরি হয়েছে নতুন শঙ্কা!
ক্রিকেটের পুরনো শক্তিগুলোর মধ্যে এই একটা দলের বিপক্ষেই যে ওয়ানডে সিরিজে সাফল্যটাকে নিয়ম বানিয়ে ফেলেছিল বাংলাদেশ। এবারের আগে দুই দলের ৬টি ওয়ানডে সিরিজের ৫টিতেই জয় বাংলাদেশের। সর্বশেষ পরাজয় সেই ২০১৪ সালে। বাংলাদেশের এই আধিপত্য শুধু দেশের মাটিতেই ছিল না। ২০১৮ ও ২০২২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়েও সর্বশেষ দুটি ওয়ানডে সিরিজ জিতে দেশে ফিরেছিল বাংলাদেশ। তো ১৫ বছর ধরে যাদের সঙ্গে ওয়ানডে পারফরম্যান্সের ধারাটা এমন, তাদের কাছে হোয়াইটওয়াশের লজ্জায় পড়তে হলো।
‘এ বছরের দিকে তাকান, (টি২০) বিশ্বকাপের পর আমরা ছয়টি ওয়ানডে খেলেছি, এর মধ্যে পাঁচটিই হেরেছি। আমরা টেস্ট খেলছিলাম। কিন্তু আমাদের মনে হয়, ওয়ানডে নিয়ে ভাবা উচিত। সামনে যেহেতু চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, (ওয়ানডে ম্যাচ) জিততে পারলে ভালো হতো। আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ত।’ অকপট স্বীকারোক্তি উইন্ডিজ সফরের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেহেদি হাসান মিরাজের। নিয়মিত অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত না থাকায় মিরাজকে ওয়ানডে সিরিজেও করতে হয়েছে অধিনায়কত্ব। মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসানের মতো তারকারাও ছিলেন না।
অভাবটা এই সিরিজে বুঝতে পেরেছেন মিরাজ, ‘এই সিরিজে আমরা কিছু সিনিয়র খেলোয়াড়কে মিস করেছি। আমাকে দায়িত্ব নিতে হবে এবং চার নম্বরে ব্যাট করতে হবে।’ তানজিদ হাসান তামিম তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে করেছেন ১০৬ রান। যার মধ্যে প্রথম দুই ওয়ানডেতে দারুণ শুরু করেও ইনিংস লম্বা করতে পারেননি। দ্বিতীয় ম্যাচে আউট হয়েছেন রানের খাতা খোলার আগেই। এছাড়া বোলিংয়ে হাসান মাহমুদ, রিশাদ হোসেনরা যে কার্যকরী হয়ে উঠতে পারেননি, সেটা ওয়েস্ট ইন্ডিজের একপেশে সিরিজ জয় দেখে বোঝা যাচ্ছে। মিরাজ বলেন, ‘এই সিরিজে তরুণদের দায়িত্ব নেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তারা সেটা করতে পারেনি।’
প্রথম ওয়ানডেতে ২৯৪ রান করে বাংলাদেশ হেরেছিল ৫ উইকেটে। সেই ম্যাচে বাংলাদেশ হেরেছিল শাই হোপের ৮৬, শেরফান রাদারফোর্ডের ১১৩ ও জাস্টিন গ্রিভসের অপরাজিত ৪১ রানের কাছে। মিরাজরা হেরেছিলেন ম্যাচের ১৪ বল বাকি থাকতেই। তৃতীয় ওয়ানডেতে বাংলাদেশ হেরেছে মূলত কেসি কার্টির ৯৫, অভিষিক্ত আমির জাঙ্গুর অপরাজিত ১০৪ ও গুদাকেশ মোতির অপরাজিত ৪৪ রানের ইনিংসে।
৫ উইকেটে ৩২১ রান করার পরও ম্যাচটি মিরাজরা হেরেছেন ২৪ বল বাকি থাকতে, ৪ উইকেটে। এত বেশি রান করার পরও এভাবে ম্যাচ হারতে হবে, এটা বিশ্বাসই করতে পারছেন না বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক। বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডেতে এটি কোনো দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড। এর আগে ২০১৪ এশিয়া কাপে মিরপুরে বাংলাদেশের দেওয়া ৩২৭ রানের লক্ষ্য ৩ উইকেট হাতে রেখে পেরিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তান।
মিরাজের উপলব্ধি, ‘৩২০ রান (আসলে ৩২১) করার পর হেরে যাওয়াটা হতাশার। আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে এ ম্যাচটা আমরা হারতে পারি। সত্যি বলতে কি, ২০ ওভারের মধ্যে (১৪.১ ওভারে ৮৬/৪) আমরা ৪ উইকেট তুলে নিয়েছি। কিন্তু পরে তারা ১৫০ রানের (পঞ্চম উইকেটে ১৩২ রান) একটি জুটি গড়ল এবং তারা যখন প্রচুর বাউন্ডারি মারছিল, আমরা উইকেট নিতে পারিনি।’ এজন্য বোলারদের ব্যর্থতার কথাই বলেছেন তিনি, ‘যেভাবে বল করার দরকার ছিল, তা আমরা করতে পারিনি এবং সমস্যা সম্ভবত এটাই ছিল।’
মিরাজ এরপর যোগ করেন, ‘ওভারপ্রতি তাদের সাড়ে ছয়ের কাছাকাছি রান করতে হতো এবং চেজ করার সময় আপনাকে হিসাবি হতে হবে আর আমাদেরও একই কাজ করতে হতো। নিশ্চিত করেই উইকেট ভালো ছিল এবং আমরা ছোট ছোট ভুল করেছি। আমরা যদি ওই ভুলগুলো না করতাম, এর চেয়ে ভালো করতে পারতাম।’ মিরাজ এখানেই থামেননি।
মিরাজ বলেন, ‘এই ধরনের উইকেটে (ভালো করা) যেকোনো বোলারের জন্যই কঠিন। কারণ, এখান থেকে আপনি তেমন কোনো সুবিধা পাবেন না এবং ব্যাটসম্যানরা যখন প্রচুর শট খেলে, রান করার সুযোগ বেড়ে যায়।’ প্রথম ও শেষ ম্যাচে বোলিং ব্যর্থতার মাঝে দ্বিতীয় ওয়ানডে ছিল চিরায়ত সেই ব্যাটিং হতাশায় মোড়ানো। বাংলাদেশ কাল ১১৫ রানেই হারিয়ে ফেলেছিল ৭ উইকেট। সেখান থেকে যে স্কোরটা ২২৭ হয়, তাতে বড় অবদান মাহমুদউল্লাহ ও তানজিম হাসানের ৯২ রানের অষ্টম উইকেট জুটিতে।
তবে সেটি যে যথেষ্ট ছিল না, তা ৩৭ ওভারের মধ্যে ৭ উইকেট জিতে প্রমাণ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ‘৪ উইকেট পড়ে যাওয়ার পরও ভেবেছিলাম ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব। আমাদের স্কোর যথেষ্ট ছিল না, ৩০০ রানের বেশি করা দরকার ছিল।’ ম্যাচ শেষে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক ব্যাটসম্যানদের ভুল শিকার করে নিয়েছেন, ‘মাঝের ওভারগুলোয় আমরা ভালো ব্যাটিং করিনি। কোনো জুটি হয়নি, একের পর এক উইকেট পড়েছে। মাহমুদউল্লাহ ও সাকিব (তানজিম) ভালো খেলেছে তবে ভুলটা আমাদেরই।’ শুরুতে দ্রুত উইকেট হারালেও ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব ছিল বলেও মনে করেন মিরাজ, ‘সিলসরা ভালোই বল করছিল।
আমরা শুরুতে রান ওঠাতে পারছিলাম না। ৪ উইকেট পড়ে যাওয়ার পরও ভেবেছিলাম ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব। আমাদের স্কোর যথেষ্ট ছিল না, ৩০০ রানের বেশি করা দরকার ছিল।’ প্রথম ম্যাচেও ৩০০ করার আশা জাগিয়েও বাংলাদেশ করতে পেরেছিল ২৯৪ রান। সেই রানটাও ১৪ বল হাতে রেখেই পেরিয়ে গিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ওই ম্যাচে ৫ উইকেট নেওয়া বাংলাদেশের বোলাররা দ্বিতীয় ম্যাচে নিতে পেরেছেন মাত্র ৩ উইকেট। চরম হতাশায় মোড়ানো তিন ওয়ানডের সিরিজের চিত্রটা যেন ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দিব কোথ!’
খেলা দেখতে ক্যারিবীয় দ্বীপে উড়ে যাওয়া বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) প্রেসিডেন্ট ফারুক আহমেদও হতাশ, ‘আমার মনে হয় ক্রিকেট খেলাটাই এরকম। ওয়েস্ট ইন্ডিজ যখন আমাদের কাছে ১১টা ম্যাচ হেরেছে, তখন নিশ্চয়ই তাদের হতাশা আমাদের চেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু দুই ম্যাচে ভাল স্কোর গড়েও জিতে না পারা, আবার আরেক ম্যাচে ব্যাটিং ব্যর্থতা... এভাবে হার হজম করা কঠিন।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘আসলে এই উইকেটে বোলিং কার্যকর হচ্ছিল না। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আমরা এক-দুটি ক্যাচ ছেড়েছি। আমিও চিন্তা করিনি যে কালকের ম্যাচটা হারব।
আমরা আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী জায়গায় পারফর্ম করতে পারিনি। তবে এটাও বুঝতে হবে, আমরা ওয়েস্ট ইন্ডিজে খেলছি, যেখানে কন্ডিশন আলাদা। গোটা সিরিজে স্পিনারদের অকার্যকারিতার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিসিবির পরিচালক নাজমুল আবেদিন ফাহিম বলেন, ‘যে উইকেটে খেলা হয়েছে, সে উইকেটে আমাদের স্পিনাররা বল করে অভ্যস্ত নয়। আমাদের দেশে যে লেন্থে বল ফেলে সফল হওয়া যায়, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওই লেন্থে বল ফেলতে পারেননি। বল একটু টার্ন করে।
ওইখানে বল ফেললে টার্ন করে না। ব্যাটাররা নিজের নিয়ন্ত্রণে বল পেয়ে যায়।’ এ নিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বোলারদের ঠিক ওই লেন্থে বল করার চর্চাটা কম। আমাদের স্পিনারদের যদি ওই চর্চা থাকতো, তাহলে হয়তো তারা আরেকটু কার্যকর হতো। সেক্ষেত্রে বোর্ডে বড় রান জমা করার পর প্রথম ও তৃতীয় ওয়ানডের ফল ভিন্ন হতে পারতো।’