ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ৭ কার্তিক ১৪৩১

ক্রিকেট ছাপিয়ে আলোচনায় সাকিব ও হাতুরু

শাকিল আহমেদ মিরাজ

প্রকাশিত: ০০:৩৭, ২৩ অক্টোবর ২০২৪

ক্রিকেট ছাপিয়ে আলোচনায় সাকিব ও হাতুরু

টাইগার ক্রিকেটে কোচ চন্দ্রিকা হাতরুসিংহের অধ্যায় এখন অতীত, বিশ্বখ্যাত তারকা সাকিব আল হাসান

নিজ আঙিনায় দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে হাই-ভোল্টেজ টেস্ট সিরিজ, ভবিষ্যতের সম্ভাবনায় ইমার্জি এশিয়া কাপ খেলতে আরেকটা দল ওমানে, চলছে ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির জাতীয় লিগ (এনসিএল)। অথচ আলোচনায় কেবলই সাকিব আল হাসান ও চন্দ্রিকা হাতুরুসিংহে! সাকিব বাংলাদেশের অন্যতম বড় তারকা, কিংবদন্তি ক্রিকেটার। প্রিয় মিরপুরে অবসর তিনি নিতে চাইতেই পারেন। কিন্তু বিপত্তি বাধে তার আওয়ামী আমলের এমপি পরিচয় নিয়ে। ‘হত্যা মামলার আসামির’ চাওয়া পূরণে ফারুক আহমেদের নতুন ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) বল ঠেলে দেয় অন্তর্বর্তী সরকারের কোর্টে।

যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের ইতিবাচক ইঙ্গিতের পর মিরপুর টেস্টের একাদশেও ছিলেন সাকিব। কিন্তু স্টেডিয়াম এলাকায় সাকিবের পক্ষে ও বিপক্ষে মিছিল-মিটিংয়ের সূত্র ধরে নিরাপত্তা ইস্যুটি বড় হয়ে সামনে আসে। দুবাই থেকে আর দেশে ফেরা হয়নি তার। অন্যদিকে এমনিতেই আগামী ফেব্রুয়ারিতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির পর হাতুরুর সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যেত। কিন্তু নিয়ম ভঙ্গ ও অসদাচরণের অভিযোগ এনে তাকে প্রথমে শোকজ ও পরে বরখাস্ত করা হয়েছে। ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নতুন কোচ হিসেবে চলে এসেছেন ফিল সিমন্স! 
কানপুরে ভারতের সঙ্গে দ্বিতীয় টেস্টের আগের দিন হঠাৎই টেস্ট ক্রিকেট থেকে আগাম অবসরের ঘোষণা দেন সাকিব। বলেন, যদি দেশে আসার এবং দেশ থেকে বিদেশে যেতে কোনো বাধা না থাকে তবে মিরপুরে শেষ টেস্ট খেলবেন তিনি। এ নিয়ে ফারুকসহ বোর্ডের অনেক ঊর্ধ্বতনই অনেক বক্তব্য দেন। ক্রীড়া উপদেষ্টার এক মন্তব্যে সংশয় কেটে গিয়েছিল, ‘প্রত্যেক খেলোয়াড়কে আমাদের নিরাপত্তা দিতে হবে। এটা আমাদের দায়িত্ব, সেটা আমরা পালন করব। আমি যেহেতু আমার মিনিস্ট্রির কনসার্ন, আমি জানার চেষ্টা করেছি কোনো আইনি বাধা আছে কি না (সাকিব) দেশে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে।

আমি জানতে পেরেছি এখন পর্যন্ত কোনো আইনি বাধা নেই।’ বলেছিলেন তিনি। সাকিব যাতে দেশে ফিরতে না পারেন সেজন্য আন্দোলন করে আসছিলেন কিছু লোক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাকিবের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছে। মিরপুরে স্টেডিয়াম এলাকায় হয়েছে বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন। এই অবস্থায় হঠাৎই ক্রীড়া উপদেষ্টা বলেন, ‘অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিতে যাতে না পড়তে হয় তাই তাকে দেশে না আসার পরামর্শ দিয়েছি। বিদায়ী টেস্ট খেলতে মিরপুর আসবেন না সাকিব আল হাসান।’

পরে তিনি আরও জানন, ‘উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ক্রীড়াঙ্গনে যেন কোনো প্রকার অনাকাক্সিক্ষত পরিবেশ না ঘটে এবং খেলোয়াড়দের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই বিসিবিকে এই পরামর্শ দিয়েছি, আপাতত দেশে না আসার পরামর্শ বিসিবিকে দিয়েছি। নিরাপত্তা কিন্তু এটা না যে নিরাপদে দেশে এনে খেলানো, নিরাপত্তা এটাও যে দেশে আসলে যদি নিরাপত্তা বিঘœ ঘটার কোনো সম্ভাবনা থাকে সেটাকেও আগে থেকে অকার্যকর করা। উভয় দিক থেকেই নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে।’ নারী টি২০ বিশ্বকাপ না হওয়ায় মুলত দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজটা হয়ে উঠেছে মহাগুরুত্বপূর্ণ।
সাকিব কানপুরেই বিদায় বলে দিলে এমন উত্তেজনা হয়তো এড়ানো যেত। তেমন কিছু হলে বিসিবি সেখানেও সাকিবকে বিদায়ী সংবর্ধনা দিতে পারতো। যেমনটা টি২০কে বিদায় বলা মাহমুদউল্লাহর ক্ষেত্রেও হয়েছে। সাকিব বিদায়ের মঞ্চ হিসেবে বেছে নিলেন দেশের মাটিকে। একজন খেলোয়াড় কোথায় বিদায় বলবেন, এটা নিয়ে তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা থাকতেই পারে। বোর্ড বা সমর্থকদেরও এতে আপত্তির কিছু থাকতো না। কিন্তু আপত্তিটা হচ্ছে, সাকিব খেলার সঙ্গে ‘রাজনীতির ধুলো’ মিশিয়ে ফেলেছিলেন।

তার ওপর তিনি রাজনীতিতে যে দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টে দেশজুড়ে হত্যাযজ্ঞের অভিযোগ। গণঅভ্যুত্থানের পর পতিত সরকারের এমপি মন্ত্রী দূরে থাক, ওই আমলের প্রশাসন যন্ত্রের অনেকেই যেখানে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, ইতোমধ্যে হত্যা মামলার নাম ওঠা সাকিবের সেখানে নির্বিঘেœ খেলা চালিয়ে যাওয়াটা কিছুটা অবিশ্বাস্যই হতো! এমন পরিস্থিতিতে দেশে আসলে ঝামেলা হতে পারে সেটি কি তিনি জানতেন না? হয়তো জানতেন। সে জন্যই অবসরের ঘোষণার সময় দেশে ফিরতে শর্তও জুড়ে দিয়েছিলেন। বিসিবি ও সরকারের কাছ থেকে দেশে আসা এবং দেশ ছাড়ার বিষয়ে নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন তিনি। সাকিব বিদায় বেলায় দেশবাসীকে পাশে চেয়েছিলেন।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, সাকিব শুধু কি টেস্ট খেলতেই এত আবেগী হলেন? দুবাই এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকলেন সরকারের গ্রিন সিগন্যালের আশায়। অনেকে বলছেন, এত মরিয়া হলে তো সিরিজের দুটো টেস্টই খেলেই অবসর নিতে পারতেন। প্রথম টেস্ট খেলেই অবসর নেওয়ার চিন্তা করতেন না। দেশে ফিরতে চাওয়ার পেছনে সাকিবের অন্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ। ছাত্র আন্দোলনের সময় সাকিব দেশের বাইরে থাকলেও বিগত সরকারের জনপ্রতিনিধি হওয়ায় তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ রয়েছে দেশের অনেকের। তাদেরই একটা অংশ প্রত্যক্ষ সাকিববিরোধী আন্দোলনে নামেন। অন্যদিকে সাকিবকে দেশে ফেরাতে জোরদারে আন্দোলন করে তার ভক্ত-সমর্থকরাও।

এদিকে বোর্ড সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার আগে ফারুক আহমেদ বলেছিলেন, কোচ হিসেবে হাতুরুর দেওয়ার খুব বেশি কিছু নেই। দায়িত্ব পেয়েও বলেছিলেন, জাতীয় দলে সম্ভব হলে অন্য কোনো কোচকে আনার চেষ্টা করবেন। এরপর পাকিস্তানে দারুণ সাফল্য। আবার ভারতে হয়েছে চরম ব্যর্থ। তবে কোচকে সাময়িক বরখাস্ত করার পেছনে ব্যক্তিগত পছন্দ, অপছন্দ বা সাফল্য-ব্যর্থতার কোনো ভূমিকা নেই বলে জানিয়েছেন বোর্ডপ্রধান। কারণ মূলত অসদাচরণ ও আচরণবিধি ভাঙ্গের। ২০২৩ বিশ্বকাপে জাতীয় দলের এক ক্রিকেটারের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগ ছিল হাথুরুসিংহের বিপক্ষে।

বোর্ড সভাপতি বলেছেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে তদন্ত করেছেন, ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেছেন, এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাতে হাতুরুসিংহকে দোষী বলেই মনে হয়েছে তাঁর। এর বাইরে বেতনভুক্ত কর্মচারী হয়েও বোর্ডের নিয়ম না মানার অভিযোগ করা হয়েছে হাতুরুর বিরুদ্ধে। বলা  হয়েছে চুক্তি অনুযায়ী হাতুর  বছরে যে কদিন ছুটি পাওনা, তিনি এর চেয়ে বেশি ছুটি কাটিয়েছেন এবং এই দুই অভিযোগেই মূলত ছাঁটাই হয়েছেন হাতুরুসিংহে।

অন্যদিকে বরখাস্ত হাতুরু শৃঙ্খলাভঙ্গের বিষয়টি মেনে নেননি। জাতীয় দলের স্পিনার নাসুম আহমেদকে চড় মারার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রথমত, অভিযুক্ত ঘটনাটি খেলোয়াড়দের ডাগআউট বা ড্রেসিংরুমে ঘটেছিল, যেখানে বিশ্বকাপের ম্যাচ চলাকালে সার্বক্ষণিক নজরদারি থাকে। খেলার প্রতিটি মুহূর্ত সঙ্গে সঙ্গে ধারণ করে ৪০ থেকে ৫০টিরও বেশি ক্যামেরা। আমি অভিযোগকারীকে যাচাই করার সুযোগ পাইনি বা কোনো সাক্ষীও পাইনি, আদৌ যদি থেকে থাকে।’ 
এরপর কয়েক মাস পরে কেন ইউটিউবে সেই অভিযোগ তোলা হলে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন সাবেক টাইগার কোচ, ‘ঘটনাটি যতটা গুরুতর হিসেবে দাবি করা হয়েছে, আশ্চর্যের ব্যাপার যে সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড় ওই ইভেন্টের (ওয়ানডে বিশ্বকাপ) পরে দ্রুততম সময়ে টিম ম্যানেজার বা কোনো কর্তৃপক্ষকে ঘটনাটি জানায়নি। যদি অভিযোগ করাও হয়, আমি বিস্মিত যে কেন আমাকে প্রশ্ন করা হয়নি কিংবা আমার কাছ থেকে কিছু জানতে চায়নি।

প্রশ্ন উঠছে, কেন এটি কয়েক মাস পরে ইউটিউবে একজন ব্যক্তির মাধ্যমে প্রকাশিত হলো?’ বিবৃতিতে বিসিবির করা অভিযোগ পূর্বপরিকল্পিত বলেও দাবি করেছেন হাতুরু, ‘এসব অভিযোগ পূর্বপরিকল্পিত বলে মনে হচ্ছে আমার। নতুন সভাপতির মেয়াদের প্রথম দিনেই তিনি প্রধান কোচ অপসারণের ইচ্ছার কথা জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন। এরপর আরেকজন প্রধান কোচ নিয়োগের মাত্র চার ঘণ্টা আগে শোকজ নোটিস পেয়ে আমি হতভম্ব। সেখানে বলা হয়েছে যে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য হাতে আছে মাত্র ৪৮ ঘণ্টা। ঘটনার ক্রমধারা এই কর্মকা-ের পেছনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্ন তোলে।’

×