মঙ্গলবার দিল্লিতে সংবাদ সম্মেলনে অবসরের ঘোষণা দেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ
২০১৮ সালে নিদাহাস ট্রফি টি২০ আসরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে যে ম্যাচটি ছক্কা হাঁকিয়ে জিতিয়েছেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ তা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের মনে আজীবন টিকে থাকবে। চরম উত্তেজনাপূর্ণ সেই ম্যাচে জয় পাওয়াটাই মর্যাদার ব্যাপার হয়ে ওঠে এবং মাহমুদুল্লাহ শুধু ছক্কাই হাঁকাননি বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমী দর্শকদের অন্তরে ভালোবাসার সিলমোহর বসিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। তাকে অনেকেই ‘ফিনিশার’ তকমা দিয়েছেন আরও দুয়েকটি ম্যাচ জিতিয়ে ফেরার কারণে।
তবে বেশকিছু ম্যাচে আবার দলকে জেতাতেও পারেননি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আউট হয়ে কিংবা ধীরগতির ব্যাটিং করে। সেই মাহমুদুল্লাহ এবার অবসর ঘোষণা করলেন আন্তর্জাতিক টি২০ থেকে। দিল্লিতে মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে এই ঘোষণা দেন তিনি। ৩৮ বছর বয়সী মাহমুদুল্লাহর সাম্প্রতিক ফর্ম এবং দীর্ঘদিন ধরে টি২০ ক্রিকেটের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ স্ট্রাইকরেট নিয়ে দীর্ঘদিন কথা হচ্ছিল।
অবশেষে জানিয়েছেন ১২ অক্টোবর হায়দরাবাদে ভারতের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় ও শেষ টি২০ খেলেই জাতীয় দলের জার্সি তুলে রাখবেন এই ফরম্যাট থেকে। ২০২১ সালেই টেস্ট থেকে অবসরে যাওয়া এই তারকা জানিয়েছেন ওয়ানডে আরও কিছুদিন খেলতে চান।
অবসরের চিন্তাভাবনা আগেই করে রেখেছিলেন মাহমুদুল্লাহ। সেভাবেই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) কর্মকর্তা ও টিম ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কথা বলে রাখেন। সে কারণেই ভারতের বিপক্ষে ৩ ম্যাচের টি২০ সিরিজ শুরুর আগেই অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত বলেন, ‘রিয়াদ ভাইয়ের ব্যাপারটা অবশ্যই আমি যতটুকু বুঝতে পারি এই সিরিজ তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং হয়তো উনি নির্বাচকের সঙ্গে কথাও বলবেন। এই সিরিজটিই হয়তো তার ক্যারিয়ারের শেষ হতে যাচ্ছে।
সোমবার জানা যায় দিল্লিতে ভারতের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টি২০ ম্যাচের আগের দিন এই ফরম্যাট থেকে অবসরের ঘোষণা দেবেন তিনি। সেটিই সত্য হয়েছে। বিকেলে দলের অনুশীলন শুরুর আগে অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামে সংবাদ সম্মেলনে বেশ হাস্যোজ্জ্বল মুখেই তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ আমি টি২০ থেকে অবসর নিচ্ছি এই সিরিজের শেষ ম্যাচ খেলে।’ এরপর জানিয়েছেন ১৭ বছর ধরে টি২০ ফরম্যাটে যাত্রা শুরুর সমাপ্তি টানার কঠিন সিদ্ধান্তটা আসলে কিভাবে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘এখানে (ভারতে) আসার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি আমার পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি।
আমার কোচ এবং অধিনায়কের সঙ্গেও কথা হয়েছে। আমি বোর্ড সভাপতিকেও জানিয়েছি টি২০ থেকে অবসর নিচ্ছি।’ মাহমুদুল্লাহ বিদায় নেওয়ার মাধ্যমে পঞ্চ পা-ব শূন্য হয়ে গেল টি২০ ফরম্যাট। আগেই এই ফরম্যাট থেকে অবসর নিয়েছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা, তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহিম। আর ভারত সফরেই ২ টেস্টের সিরিজে কানপুর টেস্টের আগে আন্তর্জাতিক টি২০ থেকে অবসরের বিষয়টি নিশ্চিত করেন সাকিব আল হাসানও। এবার থামলেন মাহমুদুল্লাহ নিজেও।
অনেকেই অবশ্য মনে করছেন মাহমুদুল্লাহ বেশ দেরি করে ফেলেছেন অবসর নিতে। গত জুনে টি২০ বিশ^কাপে দলের ভরাডুবি ও নিজের বাজের পারফর্ম্যান্সের পরই অবসরে যাওয়া উচিত ছিল তার এবং সাকিবের। কিন্তু সে পথে হাঁটেননি কেউ। তবে সাকিব অবসর ঘোষণার পর টনক নড়ে মাহমুদুল্লাহরও এবং সিদ্ধান্তটা নিতে সাকিবের ঘোষণা নিয়ামক হিসেবেই কাজ করেছে। কারণ সাকিব জানিয়েছেন, ২০২৬ টি২০ বিশ^কাপের জন্য দল গড়তে তরুণদের সুযোগ করে দেওয়া উচিত।
এখন তাই মাহমুদুল্লাহও বলেছেন, ‘এটা সঠিক সময় এই ফরম্যাট থেকে সরে যাওয়ার। শুধু আমার নয়, দলের জন্যও সঠিক সময়। সামনের বিশ্বকাপ চিন্তা করলে এখনই সঠিক সময় এগিয়ে যাওয়ার।’ চলতি বছর মাহমুদুল্লাহ ১৮ টি২০ খেলেছেন। দুই ম্যাচে ফিফটি করেছেন। সর্বশেষ ৯ ম্যাচে করতে পেরেছেন মাত্র ৯৯ রান। ভারতের বিপক্ষে গোয়ালিয়রে প্রথম টি২০তে করেন মাত্র ১ রান। এরপর তাকে নিয়ে অনেক সমালোচনা হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন পরিম-লে।
২০০৭ সালের জুলাইয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কলম্বোয় ওয়ানডে ক্রিকেট দিয়ে বাংলাদেশের জার্সিতে যাত্রা শুরু করেন মাহমুদুল্লাহ। একই বছর সেপ্টেম্বরে কেনিয়ার বিপক্ষে তার যাত্রা শুরু আন্তর্জাতিক টি২০তে। এর প্রায় দুই বছর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে কিংসটাউনে টেস্ট অভিষেক হয় তার। তবে সবার আগে ২০২১ সালে জিম্বাবুয়ে সফরে টেস্ট থেকেই অবসরে গেছেন তিনি। সবমিলিয়ে ১৭ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে এখন শুধু ওয়ানডেতেই আছেন।
যে ফরম্যাট দিয়ে বাংলাদেশের জার্সি গায়ে চড়িয়েছিলেন সেই ফরম্যাট থেকেই দেরিতে সরে যাবেন। ২০২২ সালের মাঝামাঝি টি২০ ফরম্যাটের অধিনায়কত্ব ছাড়তে বাধ্য হন একটানা ব্যর্থতার কারণে। এরপর দল থেকেই বাদ পড়েন এবং ২০২২ সালের টি২০ বিশ^কাপে দলে জায়গা হয়নি তার। সে সময় বিসিবি থেকে তাকে অবসর নেওয়ার আহ্বান জানানো হলেও তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং পারফর্ম করে ফিরে আসার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
মাহমুদুল্লাহর অনুপস্থিতিতে কয়েকজনকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলেও তারা ভালো করতে পারেননি। দেশের ক্রিকেট ভক্ত-সমর্থকরা তখন মাহমুদুল্লাহকে ফেরাতে মানববন্ধন, সমাবেশ ও মিছিলও করে। ঘরোয়া ক্রিকেটেও ভালো করছিলেন।
শেষ পর্যন্ত দলে ফেরেন মাহমুদুল্লাহ। এরপর বেশ ভালো পারফর্ম করছিলেন। ২০২৩ ওয়ানডে বিশ^কাপে দলের চরম ব্যর্থতার মধ্যেও উজ্জ্বল ছিলেন এবং একটি সেঞ্চুরিও করেন। কিন্তু টি২০ ফরম্যাটে কিছু ম্যাচ ভালো করলেও চলতি বছর একেবারে ভালো যায়নি তার। বিশেষ করে এ বছর জুনে অনুষ্ঠিত টি২০ বিশ^কাপে চরমভাবে ব্যর্থ ছিলেন, দলও আহামরি কিছু করতে পারেনি।
চারদিকে আলোচনা শুরু হয় দুই অভিজ্ঞ সাকিব ও মাহমুদুল্লাহ হয়তো অবসর নেবেন বিশ^কাপ শেষে। তবে সেটি তারা করেননি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফিল্ডিংয়েও শিথিলতা আসে মাহমুদুল্লাহর। সবমিলিয়ে তার টি২০ ফরম্যাটে খেলা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে তৈরি হয় সমালোচনা। শেষ পর্যন্ত সাকিবের অবসর নেওয়াতে মাহমুদুল্লাহও সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পেরেছেন।
বাংলাদেশের পক্ষে সর্বাধিক ১৩৯ টি২০ খেলেছেন মাহমুদুল্লাহ। ২৩.৪৮ গড় ও ১১৭.৭৪ স্ট্রাইকরেটে ২৩৯৫ রান করেছেন ৮ ফিফটি হাঁকিয়ে। উইকেট নিয়েছেন ৪০টি। দেশকে সর্বাধিক ৪৩ টি২০তে নেতৃত্বও দিয়েছেন তিনি। তার নেতৃত্বে ১৬ জয় পাওয়ার পাশাপাশি ২৬ পরাজয় দেখেছে বাংলাদেশ। ওয়ানডেতে আরও কিছুদিন খেলা চালিয়ে যাবেন। সম্ভবত তার পরিকল্পনা আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলার।
তার আগে দুটি সিরিজে (আফগানিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ) কেমন করবেন সেটার ওপর নির্ভর করছে সেই ফরম্যাট থেকে কবে বিদায় নেবেন সে বিষয়টিও। ওয়ানডেতে ২৩২ ম্যাচ খেলে ৪ সেঞ্চুরি ও ২৮ হাফ সেঞ্চুরিতে করেছেন ৫৩৮৬ রান। উইকেট আছে ৮২টি। এই ফরম্যাটে নেতৃত্ব না দিলেও ৬ টেস্টে অধিনায়কত্ব করেছেন এবং ১ জয়ের পাশাপাশি ৪টি হার ও ১টি ড্র দেখেছেন। ৫০ টেস্টে মাহমুদুল্লাহ ৩৩.৪৯ গড়ে ৫ সেঞ্চুরি, ১৬ হাফ সেঞ্চুরিতে করেছেন ২৯১৪ রান। বল হাতে নিয়েছেন ৪৩ উইকেট।