
মুক্তিযুদ্ধের পরে যেসব রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হয়েছে
মুক্তিযুদ্ধের পরে যেসব রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হয়েছে তার পরিসংখ্যান বের করলে বিস্মিত হতে হবে। ১৯৭৩ সালে গোপালগঞ্জে ৪ মুক্তিযোদ্ধা হত্যার ঘটনা আজও প্রায় অধরা। বিচারের মুখ দেখেনি গত ৫২ বছরে। নিহত সেই চারজনকে বীর মুক্তিযোদ্ধাাকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করা হয়েছিল।
ওয়ালিউর রহমান লেবু (মুক্তিযুদ্ধে ৮ ও ৯ নম্বর সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা) কমলেশ বেদজ্ঞ (হেমায়েত বাহিনীর কমান্ডার ও কিংবদন্তিতুল্য মুক্তিযোদ্ধা) মানিক ভট্টাচার্য, বিষ্ণুপদ কর্মকার ছিলেন এই চার শহীদ। কমলেশ বেদজ্ঞ প্রথমে কমলেশ বেদজ্ঞ ভারতীয় নৌবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। বাবা-মার একমাত্র সন্তান হওয়ায় তাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। পরে স্কুল শিক্ষকের চাকরি নিয়ে অল্পদিনে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
তার নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণ মুক্তিযুদ্ধে কতোটা কাজ দিয়েছিলো তা তার বীরগাঁথা শুনলে বোঝা যায়। কমলেশ বেদজ্ঞ মুক্তিযুদ্ধের ভিতরে এলাকায় আসলে ওদিন সবাই নিশ্চিন্তে ঘুমাতো এলাকাবাসী। হানাদার পাকিস্তান বাহিনীকে আক্রমণের আগে এলাকায় বলে দিতেন আপনারা আজ বাড়ি থাকবেন না। আমাদের বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের একটি ক্যাম্প থাকায় বাড়ির বড়দের আজও সব ঘটনা মনে আছে। মা বলতেন এসব ঘটনা- একদিনের ঘটনা শীতের কুয়াশায় ঘিরে আছে চার ধার। বৃষ্টির মতো হিম পড়ছে।
কমলেশ একটা ছিটকি গাছের ডাল দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে রাস্তার দিতে গেল আসছি বলে। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন এসে কমলেশের বরাত দিয়ে একজনে খবর দিয়ে গেলেন। বললেন, দ্রুত আর্মি এসে যাবে। বাড়ি ছেড়ে যেতে। খবর পেয়েই সবাই দে ছুট। কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমুল শব্দে প্রকম্পিত হলো চারদিক। গুলি চলতে থাকলো। আমার মা, বড়দা বহু কষ্টে এলাকা ছাড়লেও কমলেশ বেদজ্ঞকে ধরে নেয়ার খুব চেষ্টা ছিলো পাকিস্তানি বর্বরদের। তারা গ্রামের ভেতরেও ঢুকে গিয়েছিলেন।
কমলেশ বেদজ্ঞ ছিলেন চৌকস যোদ্ধা। তিনি গ্রামের ভেতর দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় দেখেছিলেন বাড়ির উঠানে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে। তিনি মহিলার কাছে পানি খেতে চাইলে মহিলা দ্রুত পানি আনতে যান এর মধ্যেই তিনি পালিয়ে যান। কমলেশ বেদজ্ঞ কখনো কোনো ফাঁদেই ফেলতে পারেনি পাকিরা। বড়মাপের গেরিলা ছিলেন তিনি। বুক ভরা ছিলো সাহস।
যা তাকে কখনোই দমাতে পারেনি। রাজবাড়ী মুক্ত করতে তাকে লড়তে হয়েছিলো বিহারীদের হটাতে। অপ্রতিরোধ্য এই বীর যোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন বীরদের আইকন। কিন্তু তার এই বীরত্ব কখনো মেনে নেয়নি তার বাহিনী প্রধান। তাছাড়া রাজাকার ক্যাম্প অপারেশনের মালামাল কমলেশ চাইতেন সরকারের কোষাগারে জমা দিতে। হেমায়েত বাহিনী প্রধান হেমায়েতউদ্দীন তাতে কখনোই রাজি হননি।
কিন্তু সব মালামালের তালিকা একটা ডায়রিতে লেখা ছিলো। এটাই পরে কাল হয়ে দাঁড়ায়। এই ডায়রির জন্য তার বাড়িও কয়েকবার ডাকাতি হয়েছে। কারা ডাকাতি করেছে তা কেউ জানতো না। এই ডায়রির কথা ওয়ালিউর রহমান লেবু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন ডায়রি তার কাছে নিয়ে যেতে। ১০ মার্চ সকালে সে ডায়রিসহ তারা রওয়ানা হয়েছিলেন। তারপর ঘাতকরা পথরোধ করে দাঁড়িয়ে ডায়রি চায়। এরপর শুরু হয় খা-ব দাহন।
॥ দুই ॥
১৯৭৩ সালের নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছিলেন বীর যোদ্ধা এলাকার জনপ্রিয় স্বপ্ন মানুষ কমলেশ। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) হয়ে কুঁড়েঘর মার্কা নিয়ে লড়েছিলেন কমলেশ বেদজ্ঞ। জনপ্রিয় স্কুল শিক্ষক ন্যাপনেতা কমলেশের নির্বাচনে কাজ করেছিলো একঝাঁক তরুণ। সারা কোটালীপাড়ায় কমলেশ বেদজ্ঞের জনপ্রিয়তা ছিলো ঈর্ষণীয়।
একই সঙ্গে ওয়ালিউর রহমান লেবু গোপালগঞ্জের গণমানুষের কাছে ছিলো কিংবদন্তিতুল্য একটি নাম। গোপালগঞ্জ আসনে তিনিও নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা মোল্লা জালালের বিপরীতে। আসন হারানোর ভয়ে শেখ মুজিবুর রহমান তখন ওই আসনে নির্বাচন করতে আসলে ওয়ালিউর রহমান লেবু শেখ মুজিবুর রহমানকে সম্মান জানিয়ে তার মনোনয়নপত্র তুলে নেন। একই সঙ্গে কোটালীপাড়ার জনপ্রিয় ন্যাপনেতা, কিংবদন্তিতুল্য মুক্তিযোদ্ধা কমলেশ বেদজ্ঞের নির্বাচন করতে আসেন।
তিনি কোটালীপাড়ায় কমলেশ বেদজ্ঞের নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নেন। এলাকার তরুণ-বৃদ্ধ- যুবা তখন কমলেশ বেদজ্ঞের নির্বাচন করছে। তাদের নেতৃত্বে দিতে চলে আসলেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ওয়ালিউর রহমান লেবু। মুক্তিযুদ্ধে ৮ ও ৯ নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং গোপালগঞ্জের জনপ্রিয় নেতা কমরেড ওয়ালিউর রহমান লেবু। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরির সুযোগ ছেড়ে দিয়ে সাধারণ ক্ষেতমজুর ও গণমানুষকে কমিউনিস্টদের পতাকাতলে সমবেত করার জন্য কাজ শুরু করেছিলেন। উলপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হয়েছিলেন।
॥ তিন ॥
১৯৭৩ সালের ৭ মার্চের নির্বাচনে কোটালীপাড়ায় পরাজিত হন ন্যাপ প্রার্থী কমলেশ বেদজ্ঞ। তারপর ৯ মার্চ সব নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সভা-আলোচনা করে ১০ মার্চ রওয়ানা হন গোপালগঞ্জের পথে। পায়ে হেঁটে চলা পাঁচজন। লেবু ভাই, কমলেশ বেদজ্ঞ, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা বিষ্ণুপদ কর্মকার, মানিকের পথরোধ করে। তারা যেন এই নেতাদের অপেক্ষায় ছিলো। লেবু কমলেমকে পেয়ে তারা রক্ত নেশায় লোলুপ হয়ে ওঠে।
লেবু-কমলেশদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে জখম করে। একটি নৌকায় উঠিয়ে মাঝনদীতে নিয়ে নৌকাটি ডুবিয়ে দেয়। এ সময় সশস্ত্র ব্যক্তিদের হাতে মুক্তিযোদ্ধা কমলেশ ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মানিক এবং বিষ্ণু নিহত হন। মৃতের মত লুৎফর রহমান গঞ্জর নদীর পাড়ে পড়ে থাকে। লেবু ভাই সাঁতরে পার্শ¦বর্তী হাবিবুর রহমানের বাড়িতে আশ্রয় নেন। বাড়িটি ঘেরাও করে খুনিরা আগুন ধরিয়ে দিতে গেলে লেবু ভাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন।
তাঁকে তিনমাইল পর্যন্ত পায়ে দড়ি বেঁধে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় তারা। তারপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে লেবুভাইকে হত্যা করা করে। এই হত্যাকা-গুলো ঘটানো হয় প্রকাশ্যে এবং উপস্থিত গ্রামবাসীর সামনে। ঘাতকরা ছিল সশস্ত্র এবং ডাকাত হিসাবে কুখ্যাত। এই হত্যাকা-ের জন্য অভিযুক্ত করা হয় মুক্তিযুদ্ধে হেমায়েত বাহিনীর প্রধান হেমায়েতউদ্দীনকে। জনরোষ তখন মারাত্মক আকার নেয় করে। হেমায়েতউদ্দীনকে তখন গ্রেপ্তার করা হয়।
নিয়ে যাওয়া হয় জেলে। পরিস্থিতি একটু শান্ত হলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং তাকে বীরবিক্রম খেতাব দেওয়া হয়। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমানকে সিপিবি নেতা কমরেড মনিসিংহ বঙ্গবন্ধুকে বীরবিক্রম খেতাবের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন এটা তার নামে আগেই বরাদ্দ ছিলো। তার পরে ইতিহাসের আরেক কালপর্ব চলে এলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলো- ক্ষমতায় বসলেন খন্দকার মোশতাক সরকার। হেমায়েতবাহিনীরা মোশতাক বাহিনীর সঙ্গে ভিড়ে যায়।
একইভাবে পতিত স্বৈরাচার এরশাদেও সঙ্গেও তিনি ছিলেন। এসব সরকারের লোক সেজে তিনি মামলার পেছনে লেগে থাকতেন। যে কারণে বার বার মামলার নথি হারানো যেত আর বার বার মামলা স্থগিত হতো। ১৯৯৮ সালে পঁচিশ বছর পরে আবার মামলাটি শুনানি শুরু হয়। এলাকার মানুষ স্বস্তির নিশ^াস ফেলেন। তৎকালীন জজ আসামিদের জামিন বহাল রাখেন।
হেমায়েত উদ্দীন মারা গেছেন বছর বছর প্রায় ৮ বছর। গত ৪৪ বছরে মামলাটি শুরু হয়েছে আর স্থগিত হয়েছে। ২০ জন আসামির ১০ জনের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। লেবু ভাইর মা মারা গেছেন সন্তান হারানোর কষ্ট বুকে নিয়ে। কমলেশের বাবা মা-স্ত্রী মারা গেছেন একই কষ্ট বুকে নিয়ে। বিশেষত কমলেশ বেদজ্ঞের পরিবার আর বিষ্ণুপদ কর্মকারের পরিবারে কথা বলতে আমি ভাষা খুঁজে পাই না। কমলেশ বেদজ্ঞের ৩ মেয়ে ১ ছেলেকে নিয়ে পরিবারটির যে যুদ্ধ সেটা মুক্তিযুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ ছিলো।
শুধু মুক্তিযুদ্ধ করার কারণে এইসব দেশপ্রেমিকদের হত্যা করা হয়েছে। কোটালীপাড়ায় এখন অনেক মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু কিংবদন্তীতুল্য মুক্তিযোদ্ধা কমলেশ বেদজ্ঞের নাম সে তালিকায় নেই। বিষ্ণু-মানিক কেউ নেই তালিকায়।শত শত মুক্তিযোদ্ধার ভিড় থেকে তারা উধাও। কমলেশ বেদজ্ঞের সংগ্রাম কন্যা সুতপা বেদজ্ঞ আজও লড়ছেন পিতা হত্যার বিচার দেখতে। খুনীদের উত্তাপ একই রকম রয়েছে। শুধু সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখা মানুষগুলো কমে যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো চার মুক্তিযোদ্ধা হত্যার বিচার দেখার জন্য আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে?