ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৬ মার্চ ২০২৫, ১২ চৈত্র ১৪৩১

গল্প ॥ অচেনা পথ

আহমাদ কাউসার

প্রকাশিত: ২২:৫৪, ২৫ মার্চ ২০২৫

গল্প ॥ অচেনা পথ

জলের পিঠে হাসছে রূপালি চাঁদ

জলের পিঠে হাসছে রূপালি চাঁদ। বাতাসের তালে তালে উঠানামা করছে ছোট ছোট ঢেউ। ঢেউয়ের ভাঁজে ভাঁজে চিকচিক করছে জোছনা। বিলের পরে আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে কালো রঙের গাঁও। ধীরেন চন্দ্র ধীরে ধীরে বাইছে নৌকাটা। খোলা নৌকাটায় বসা তাঁর অশীতিপর মা আর সাতবছর বয়সী ছোট বোন। গন্তব্য ওদের বর্ডার। চারিদিকে বিপদের ডঙ্কা বাজছে তাই রাতেই আপন বসতভিটা ছেড়ে যেতে হচ্ছে অজানা এক গন্তব্যে।

এতোদিন ভেবেছিল যত বিপদই আসুক বাপদাদার বসতভিটা ছেড়ে কোথাও যাবে না। পাকহায়েনা আর স্থানীয় রাজাকারদের অত্যাচার এতই বেড়ে গেছে যে, বাড়িতে থাকার কোনো জো নেই। তাছাড়া কখনো কখনো মর্টার শেল বৃষ্টির মতো পরে তাদের বাড়িতে, তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও শরণার্থী হতে যাত্রা শুরু করেছে নির্জন রাতে। ধীরেন চন্দ্র নৌকা বাইছে আর ভাবছে, আমরার যদি একটা ভাই থাকতো তাহলে আমিও বন্ধু নরেন, রণেশের মতো যুদ্ধে যাইতে পারতাম।

আমি আর শর্মিলা ছাড়া মা’র তো কেউ নাই পৃথিবীতে। আমরারে লইয়্যা মা বাইচ্চ্যা আছে। আমরারে লইয়্যা-ই মা স্বপ্ন দেখে, তাই মা’রে রাইখ্যা যুদ্ধে যাওয়াটা ঠিক অইবো না। এরকম নানা চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। নৌকা বিল পেরিয়ে ঘুংঘুর নদীর ঘোলা জলের ওপর দিয়ে চলছে পুবদিকে। বিপরীতদিক থেকে একটি নৌকা আসতে দেখে ধীরেন্দ্র চন্দ্র নৌকাটা বহেড়া গাছের আড়ালে থামাল। নৌকার মাঝি দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলো, কেডা?
আমি ধীরেন চন্দ্র। 
কই যাইবা?
বর্ডারে। 
হেই দিকে এহন যাইঅ না। সামনে মিলিটারি আছে। আমরাও বর্ডারে যাইতাছিলাম, মিলিটারির কথা হুইন্ন্যা আবার এই দিকে ফিইরা আছি আইয়ো, আমার লগে আইয়ো। মইনপুরের বিল দিয়্যা গঙ্গাসার অইয়্যা বর্ডারে যাইতে অইবো তাছাড়া আর কোনো পথ নাই। 
আইচ্ছ্যা লন, আফনার লগেই যায়াম। 
তোমার বাড়ি কই?
চানলা। 
তাইলে ত তুমি এহানের পথঘাট চিন। 
হ, চিনি। 
চানলা গেরাম ত মেলা বড় গেরাম, চানলা কোন পাড়ায় তোমার বাড়ি?
করিমপুর। 
আফনার বাড়ি?
বেড়াখলা। 
অ, আমডার লগেঅই। 
হ, চানলা আর বেড়াখা কাছাকাছি। 
তোমার নাম কী?
ধীরেন চন্দ্র। 
আফনার নাম?
সুধাকর রায়। 
আফনে আগে যান, পথ না চিনলে কইয়েন আমি দেহাইয়্যা দেয়াম। 
ধীরেন চন্দ্র সুধাকর রায়কে অনুসরণ করে ভাটির দিক নৌকা চালাচ্ছে। সুধাকর রায়ের নৌকায় থাকা মানুষগুলো কোনো কথা বলছে না। চুপচাপ শুনছে ওদের কথা। ভাটির দিকে নৌকা চলছে। আকাশের মধ্যখানে চাঁদটা যেন আরো ফকফকা হয়ে উঠলো। নদীর পানি ঘোলাটে হওয়ার কারনে জলের পিঠে জোছনার চকচকানি নেই। নদীর দুইপাড়ের গাছগুলোর পাতায় পাতায় মনানন্দে নৃত্য করে যায় জোছনা।

ধীরেন চন্দ্রের বোন শর্মিলা ঘুমিয়ে আছে নৌকার মাচাইয়ে। ধীরেন চন্দ্রের ক্লান্ত দেহ আর চায় না সামনে এগিয়ে যাক কিন্তু ধীরেন চন্দ্রের মন বলছে এগিয়ে যা। ধীরেন চন্দ্র মাঝে মাঝে তার মা’র দিকে তাকায়, বোনের ঘুমন্ত মুখের দিকে দৃষ্টি যেতেই সব অবসাদ ভূলে যায়। কখনো ভাবে বাড়িতে রেখে আসা গরুগুলির কথা। ঘরে রাখা পাটের কথা,গুলাভরা ধানের কথা।

পিতৃহীন ধীরেন চন্দ্র ছোটবেলা থেকেই সংসারের হাল ধরেছে। মা, বোনই তার সবকিছু। মা আর বোনের নিরাপত্তার জন্যই জন্মভিটা ছেড়েছে। নৌকা চলতে চলতে বলাখাল গাঁয়ের কাছে এলে ধীরেন চন্দ্র সুধাকর রায় বললো,দাদা নদীর ডাইন দিকের বিলটাই মইনপুর এই বিল পার অইয়্যা মইনপুর গাঁয়ের ভিত্রে যাইতে অইবো। 
আইচ্ছা, তাইলে এদিকেই যাই। 
হ, নাও পুবদিকে ঘুরান। 
নৌকা নদী থেকে মইনপুরের বিলে ঢুকে তারা যাচ্ছে পুবদিকে। আস্তে আস্তে চাঁদের আলো ম্লান হয়ে এলো। চলছে নৌকা পুবদিকে। তারা জানে না মইনপুর গাঁয়ের খবর। বিল পেরিয়ে তারা ঢুকে পড়ে গাঁয়ের ভেতরে। ধীরেন চন্দ্র সুধাকর রায়কে বললো, দাদা আগারে একটা ইশকুল আছে হেইখানে মিলিটারি আছে কিনা খেয়াল কইরেন।’
ধীরেন চন্দ্রের কথা শুনে সুধাকর রায় নৌকাটা থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,তুমি এইহানে আগে আইছো?
হ, আইছি। আমি এহানের সবকিছু চিনি। 
এতো রাতে কারে জিগাই?যদি মিলিটারি থাহে তাইলে ত গুলি করবো। দু’জনে নৌকা থামিয়ে বসে রইলো। সুধাকর রায়ের নৌকায় থাকা এক মুরব্বি জিজ্ঞেস করলো, কী অইছে সুধাকর?
সামনে নাকি একটা ইশকুল আছে হেইখানে মিলিটারি থাকতে পারে। 
সুধাকর রায়ের মুখে মিলিটারির কথা শুনে মুরব্বি ভয়ে কাঁপতে লাগলো। মুরব্বির মুখে আর কোনো কথা নেই। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না সুধাকর রায় আর ধীরেন চন্দ্র। ওরা চায় না ওদের ভূলের কারণে এতোগুলো মানুষ বিপদে পড়ুক। ধীরেন চন্দ্র আগে প্রায়ই এখানে আসতো তাই এই গাঁয়ের সবকিছু তার জানাশোনা। সুধাকর ও সুধাকরের নৌকার যাত্রীরা কেউ চেনে না এই গাঁয়ের পথঘাট। সুধাকর রায় এখন ধীরেন চন্দ্রের ওপর ছেড়ে দিয়েছি সিদ্ধান্ত, সামনে যাবে কি যাবে না।

ধীরেন চন্দ্রের মন কেমন কেমন করছে। তার মনে হচ্ছে সামনের ইশকুলে মিলিটারির ক্যাম্প থাকতে পারে। রাত এগিয়ে চলেছে ভোরের দিকে। ভোর হলেই বিপদের মাত্রা আরো বেড়ে যাবে। অনেক দূর থেকেও ওদের দেখা যাবে। আর মিলিটারি দেখতে পেলেই গুলি ছুঁড়বে। ধীরেন চন্দ্র সুধাকর রায়কে সাত্ত্বনা দিয়ে বললো, লন সামনের দিকে যাই, যা অবার অইবো। তাছাড়া হেই দিক যাওনের ত আর কোনো পথ নাই। ধীরেন চন্দ্রের কথা শুনে সুধাকর রায় আবার সামনের দিকে নৌকা বাইতে লাগলো।

স্কুলের কাছে যেতেই এক রাজাকার ওদের দেখে নৌকা ভিড়াতে বললো। সুধাকর রায় আর ধীরেন চন্দ্র ভয়ে থরো থরো হয়ে নৌকা ভিড়ালো। ধীরেন চন্দ্রের মা জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলো। সুধাকরের নৌকার যাত্রীরা ভয়ে কাপতে লাগলো। দুইজন মিলিটারি স্কুল থেকে বেরিয়ে এসে ওদের নৌকা থেকে নামিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। মিলিটারিরা রাজাকারকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় জিজ্ঞেস করলো,
ওরা কি মুক্তিবাহিনীর লোক?
রাজাকার বললো, না স্যার ওরা ইন্ডিয়া যাইবো। 
ইন্ডিয়া যাওয়ার কথা শুনে মিলিটারিরা ক্ষেপে গেল। গোঁফওয়ালা একজন মিলিটারি সকলকে বেঁধে রাইফেলের বাট দিয়ে পিটাতে লাগলো। শর্মিলা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। ধীরেন চন্দ্রর মাকেও ওরা পিটাতে লাগলো। সুধাকর রায় বেহুশ হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। পুবের আকাশ ফর্সা হয়ে এল। গাছে গাছে পাখিরা ডাকছে। ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ছে গাছের পাতায়।

ধীরেন চন্দ্রের মা মৃতমানুষের মতো পড়ে রইলো মাটিতে। শর্মিলার কান্নায় ভারি হয়ে গেল আশপাশের পরিবেশ। এই ছোট মেয়েটার কান্নার ধ্বনিতে থেমে গেল পাখিদের কোলাহল। একটু পর পর হায়েনার দল পালাক্রমে পিটাচ্ছে ওদের, ধীরেন চন্দ্রের শরীরে কিছুক্ষণ পর পর একটি মুগুর সমেত লাঠি দিয়ে পেটাতে লাগলো।

প্রতিটি আঘাতেই ধীরেন চন্দ্র মা-মা বলে চিৎকার করতে লাগলো। ধীরেন চন্দ্রের মা পাশেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, ছেলের আর্তচিৎকার তার কানে পৌছালেও ছেলের দিকে ফিরে তাকানোর মতো শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে। রাজাকার পাশে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বললো, তোর মা তো মনে হয় অক্কা পেয়েছে, মাকে ডাকিস না, তোর মা শুনতে পাচ্ছে না।

সূর্য ধীরে ধীরে মধ্যে আকাশে এলো, চামড়াপোড়া রোদে স্কুলের মাঠে বেধে রেখে অত্যাচার করেই যাচ্ছে নরপশুর দল। ধীরেন চন্দ্র অস্ফুট স্বরে বললো, আমারে একটু জল দেও। রাজাকার ধীরেন চন্দ্রকে ব্যাঙ্গ করে বললো, ইন্ডিয়া গিয়্যা পানি খাইও, এহানে পানি নাই। শর্মিলা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লো ঘাসে ঢাকা মাঠে। ধীরেন চন্দ্র কখনো তার মায়ের দিকে কখনো বোনের দিকে তাকিয়ে কান্না করছে। ক্যাম্পের মাঠ গাছের ছায়ায় ঢেকে গেল। বিকেল হাঁটছে 
সন্ধ্যার দিকে। আশপাশ যেন বিরানভূমি। কোনো জমমানব নেই। ক্যাম্প কমান্ডার রাজাকারকে আবার জিজ্ঞেস করলো, ওরা ট্রেনিং নিতে ইন্ডিয়া যাচ্ছিল?
না, স্যার, ওরা শরণার্থী হতে যাচ্ছিল। 
আমার বিশ্বাস হয় না। আমার মনে হয় ওরা ট্রেনিংয়ের জন্যই যাচ্ছিল। 
ধীরেন চন্দ্রের মা’র ততোক্ষণে জ্ঞান ফিরে এলো। সুধাকরের হুশ ফিরেছে। শর্মিলার ঘুম আগেই ভেঙে গেছে। ভয়ে কাতর শর্মিলা চুপ করে বসে আছে, তার চাহনিতে এক মায়াময় ছায়া, যেন একটু নিরাপত্তা চায়,অসহায়ত্বের মূর্তপ্রতীক হয়ে বসে আছে সে। দাদাকে ভয়ঙ্কর প্রহার করে যাচ্ছে তারই সামনে, সে যুদ্ধ কি বুঝে না।

কমান্ডার ধীরেন চন্দ্রের মা আর শর্মিলাকে ক্যাম্পের মাঠে রেখে বাকিদের নিয়ে গেল ক্যাম্পের পাশে থাকা ছোট খালের ধারে, ধীরেন চন্দ্রের মা একজন মিলিটারির পায়ে ধরে বললো, বাবা, আমার ছেলেরে লইয়্যা কই যাও, হেরে ছাইরা দেও বাবা। মিলিটারি এক লাথি দিয়ে ধীরেন চন্দ্রের মাকে দূরে সরিয়ে দিল। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো ধীরেন চন্দ্রের মা।

কমান্ডারের সঙ্গে পাঁচজন মিলিটারিও গেল। সকলকে একসঙ্গে বেঁধে ফায়ার করলো। সঙ্গে সঙ্গে ওদের সতেজ দেহ মাটিতে পড়ে গেল। চিরদিনের জন্য নিভে গেল ওদের প্রাণপ্রদীপ। পানিতে ভাসিয়ে দিল ওদের লাশগুলো। ধীরেন চন্দ্রের মা ও শর্মিলাকে রাজাকার মইনপুর গাঁ পার করে চানলার পথ ধরিয়ে দিল। ধীরেন চন্দ্রের মা’র জানা নেই কোন পথঘাট। কিছুক্ষণপর গাঁয়ের পথে সন্ধ্যা নামবে কালো হয়ে। ধীরেন চন্দ্রের মা ছোট মেয়েকে নিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে হাঁটতে লাগলো অচেনা আরেক পথে দিকে।

×