ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৯ ফাল্গুন ১৪৩১

মাতৃভাষার গৌরব সন্ধান

দিলরুবা শাহানা

প্রকাশিত: ০০:৪৬, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

মাতৃভাষার গৌরব সন্ধান

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

নিজের মাতৃভাষাকে ভালো না বাসলে নিজের অস্তিত্বকে অবজ্ঞা করা হয়, আমার আমিত্বকে অসম্মান করা হয়। তাই মাতৃভাষার গুরুত্ব ও মর্যাদা অনুধাবন করার জন্যই পৃথিবীতে একটি দিন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নামে নির্ধারিত হয়েছে। সেই দিনটি হলো ২১ ফেব্রুয়ারি। এই দিনেই অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখেই মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষার লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার ও নাম না জানা আরও অনেকে।

তাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানানোর জন্যই জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে। তারপর থেকে নানাভাষী, নানা জাতির মানুষ পৃথিবীর নানান প্রান্তে মাতৃভাষা দিবস নানা আড়¤¦রে উদযাপন করে আসছেন।
অনেকে প্রশ্ন করেন মাতৃভাষাতো প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় খুব একটা কাজে লাগে না তাই তা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার আছে কি? তাছাড়া মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা অর্জন ও অর্থকরি উপার্জন করা যায়কি? উত্তর সহজ নয়।

শুধু একটা বিষয় আমরা ভেবে দেখতে পারি তাহল আমরা অনেক কিছু ভালোবাসি, তাই নয় কি? দরকারে লাগবে, লাভ হবে এসব চিন্তা করেতো মানুষ ভালোবাসে না। মাতৃভাষার জন্য টান বা ভালোবাসা লাভ বা দরকার থেকে উৎসারিত নয়। এ ভালোবাসার জন্যই ভালোবাসা। এখানে কারণ খুঁজতে যাওয়া অর্থহীন।
তারপরও মাতৃভাষা বাংলায় করা কোনো কাজ যদি প্রশংসিত হয় আলোড়ন তোলে আমরা গর্ববোধ করি, আত্মসম্মান বেড়ে যায়। এখানে দুটো ঘটনা বর্ণনা করছি যা জানলে মাতৃভাষা বাংলা বলে শ্লাঘা অনুভব করা যাবে। বাংলাভাষা তুচ্ছ নয়, বাংলায় যিনি লেখেন তিনি অপাঙ্ক্তেয় নন, বাংলাভাষার পাঠকরাও সম্মানের দাবিদার।
ঘটনা বর্ণনার আগে কিছু পুরনো তথ্য আবার বলছি যা এই বক্তব্যকে সমৃদ্ধ করবে, আমাদের যারা নিজেকে সম্মান করেন তাদের ভালোও লাগবে। সেই কবে কোন এক সময়ে বাংলা ভাষায় লিখে একজন নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন তাঁর নাম আমরা সবাই জানি। আজ থেকে এক শ’ বারো বছর (১৯১৩ সালে) আগে প্রথম নন-ইউরোপিয়ান প্রথম নন-হোয়াইট নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মাতৃভাষা বাংলায়ই সাহিত্যচর্চা করেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ। মাতৃভাষার ‘মাকের্টভ্যালু’ বা বাণিজ্যিক মূল্য নিয়ে যার খুশি সে মাথা ঘামাক রবীন্দ্রনাথ ঘামাননি। 
তাইতো বর্তমান সময় থেকে একশ’ বছরের বেশি আগে যখন বঙ্গভাষা রাজভাষা নহে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা নহে, সম্মান লাভের ভাষা নহে, অর্থো পার্জনের ভাষা নহে কেবল মাতৃভাষা’ *জেনেও নিজের মায়ের ভাষা বাংলার প্রতি নিবেদিত ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বাংলাভাষা একটি ঋদ্ধভাষা ও এই ভাষায় অসাধারণ সব ভাবনা চিন্তা লিপিবদ্ধ করা যায় বলেই এই ভাষাতে লিখে নন্দিত হয়েছিলেন কবি। কবির নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর বাংলা ভাষার আরেক স¦নামধন্য কবি অতুল প্রসাদ লিখেছিলেন
‘এই ভাষাতে বাজিয়ে বীনে
আনলো রবীজগৎছিনে’
         (উৎস: মোদের গরব মোদের আশা) 
সুতরাং মাতৃভাষ াবাংলা নিয়ে গৌরব করা অবশ্যই যাবে। 
বাংলাভাষায় লেখা সৃজনশীল কর্ম বিদেশী ভাষায় অনূদিত হয়ে আদৃত হয়েছে এমন অনেক তথ্যও এই ভাষাভাষীদের গর্বিত করে।
এবার বাংলা ভাষার পাঠকেরা কেমন তা তুলে ধরছি। বাংলাভাষী পাঠকদের বিষয়ে ভারতের বাঙালি লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় আশির দশকের শেষে ঢাকায় গিয়ে বলেছিলেন ‘বাংলাদেশের পাঠকেরা বই পড়েন বলেই বাংলা ভাষার লেখকেরা টিকে আছেন’। শীর্ষেন্দুর এই ভাষ্য সেই সময়ে ‘যায় যায় দিন’ নামে সাপ্তাহিকীতে ঊদ্ধৃতি হিসেবে ছাপানো হয়েছিল।
বাঙালিরা গল্প, উপন্যাস, কবিতাই শুধু পড়েন তা নয়। আরও নানা বিষয়ে তাদের আগ্রহ লক্ষণীয়। (এরপর ২৩ পৃষ্ঠায়) 
বৈচিত্র্যময় তাদের পাঠ¯পৃহা। এই বক্তব্যের সপক্ষে একটি প্রমাণ তুলে ধরছি। কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রোর আত্মজীবনী বাংলায় অনূদিত হয় বাংলাদেশে। ওই বইয়ের গ্রন্থস্বত্ব বা কপিরাইট রয়েছে যে অস্ট্রেলীয় পাবলিশারের তার কাছ থেকে আইনগত অনুবাদক ফারুক চৌধুরী অনুমোদন নিয়েই বইটি অনুবাদ করেন। ছাপানোর বা প্রকাশের পর ফিদেল ক্যাস্ত্রোর বই ‘আমার কৈশোর আমার তারুণ্য’ বাংলাদেশের পাঠকেরা সাদরে গ্রহণ করেন।

এর প্রমাণ বইয়ের বিক্রির মাধ্যমে অর্থও ভালো অর্জিত হয়। ফলে বাংলাদেশের প্রকাশক ও অনুবাদক দুজনেই খুশি। পরবর্তী সময়ে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে অস্ট্রেলীয় প্রকাশককে তার প্রাপ্যও বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এই পর্যায়ে এসে আমার ওপর দায়িত্ব পড়ে অস্ট্রেলীয় ওশেন প্রেসকে তার প্রাপ্য অর্থ পৌঁছে দেওয়ার। উল্লেখ্য, এই প্রকাশক ফিদেল ক্যাস্ত্রো ও চে গুয়েভারার বইয়ের ইংরেজি অনুবাদের স্বত্বাধিকারী।

ওই বইগুলো বিক্রি থেকে ওশেন পাবলিশার ৪০০, ৫০০ হাজার ডলার অর্জন করে থাকে। তারপরেও সুদূর বাংলাদেশ থেকে বাংলায় অনুবাদকৃত বই বিক্রির লভ্যাংশের অর্থ সামান্য শ’তেক ডলার পেয়ে যত না খুশি প্রকাশক হলেন তার চেয়েও বেশি বাংলাদেশের পাঠকদের প্রতি বিস্ময় মিশ্রিত শ্রদ্ধা জানালেন। আমাদের বাংলা ভাষার পাঠকও নমস্য!
এবার বলছি অন্য ঘটনা। আমার পরিচিত অস্ট্রেলীয় একজন ইংরেজির শিক্ষক। যিনি  সম্ভবত পাঠ্য বিষয় (অর্থাৎ সিলেবাস) নির্বাচন নির্ধারণেও জড়িত। কোনো এক সময়ে আমাদের একটি বই উপহার দিয়েছিলেন। রবী ঠাকুরের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ। অনুবাদক উইলিয়াম রাদিচে, প্রকাশক পেঙ্গুইন পাবলিশার।

বইটি হাতে নিয়ে আমার মনে হলো আমিতো রবীন্দ্রনাথ বাংলায়ই পড়তে পারি আমাকে কেন ইংরেজিতে রবীন্দ্রনাথ পড়তে হবে। তারপর যখন জানলাম বইটি ভিসিইর (মাধ্যমিক পরীক্ষা) সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করার চিন্তাভাবনা হচ্ছে তখন একই সঙ্গে গর্ব ও আনন্দ হলো। আজও রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিক আর উনি লিখেছিলেন মায়ের ভাষাতে। এদেশের স্কুলপড়ুয়ারা শেক্সপিয়ারের ‘হ্যামলেট’ পড়েছে, ‘ওথেলো’ পড়েছে ও পড়ছে একদিন তারা পড়বে রবীন্দ্রনাথের ‘সোনারতরী’র ইংরেজি অনুবাদ এড়ষফবহ ইড়ধঃ.
আমার গভীর প্রত্যয়ও আশা মাতৃভাষায়ই মানুষের শ্রেষ্ঠ চিন্তাভাবনা ও কল্পনা প্রকাশিত হোক এবং হবে নিশ্চয়।

* বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘মাতৃভাষার স্বপক্ষে রবীন্দ্রনাথ’ বইতে রবীন্দ্রনাথের কথাটি উদ্ধৃত।

×