ছবি : সংগৃহীত
এককালের রাখাইন অধ্যুষিত কলাপাড়ার জনপদে তাদের সঙ্গীতাঙ্গন ছিল মুখরিত। ছিল ব্যাপক সমাদৃত। রাখাইনদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত না হলে সঙ্গীতাঙ্গনে পুর্ণতা পেত না। কালের বিবর্তনে এককালের দাপুটে এ জনগোষ্ঠী এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। গুটি কয়েক পল্লী রয়েছে। তারপরও তাদের দৃষ্টিনন্দন সাংস্কৃতিক অঙ্গনের উপভোগ্য অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয় মাঝে মাঝে। জৌলুস না থাকলেও আমলা থেকে শুরু করে ভিভিআইপি, রাজনীতিকদের সাংস্কৃতিপর্বের সূচিতে থাকে রাখাইনদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
শুধু চিত্ত বিনোদনে নয়। শেষ কৃত্তেও রাখাইনদের ছিল জমকালো, মনকাড়া অনুষ্ঠান। যার ব্যপ্তি ছিল শুধু কলাপাড়া নয়, জেলার বাইরেও। রাখাইনদের বিশেষ বিশেষ সঙ্গীতানুষ্ঠানসহ বিভিন্ন সঙ্গীত পরিবেশন সংশ্লিষ্ট আয়োজন ভড়কে দিত আগতদের। উপভোগ্য এসব অনুষ্ঠান এখন কালে-ভদ্রে রাখাইনরা করে থাকেন। অনুষ্ঠান করেন বিশেষ পার্বণে। যেখানে অংশ নেন রাখাইন ছাড়াও বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষ। তবে এখন এসব অনেকাংশে কালের স্মৃতি হয়ে গেছে। হয়ে গেছে অতীত, হারানো ঐতিহ্য। আর্থিক দৈন্যসহ রাখাইনদের সংখ্যা বিলোপ হওয়া, বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও আর্থিক অসহায়ত্ব এ সম্প্রদায়ের বর্ণিল এসব অনুষ্ঠান অধিকাংশ হারিয়ে যেতে বসেছে।
তারপরও ধর্মীয় রীতির সঙ্গে আষ্টে-পৃষ্ঠে আগলে থাকা অনুষ্ঠানগুলো উদযাপন করেন রাখাইন জনগোষ্ঠী। তবে আগের জৌলুস নেই। কখনও করতে হয় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাসহ বিভিন্ন জনের সহায়তায়। এক সময় রাখাইনদের পেকু নৃত্য ও সঙ্গীত ছিল এ অঞ্চলের সবচেয়ে ঝাকজমক অনুষ্ঠান। কখনও মাসব্যাপী এ অনুষ্ঠান চলত। বৃহদাকার প্যান্ডেল করে চলত এ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নির্দিষ্ট রাখাইন পল্লীতে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। সমাবেশ ঘটত ভিন্ন ধর্মের হাজারো উৎসুক মানুষের। এ অনুষ্ঠানে রাখাইনদের সঙ্গীতের পাশাপাশি নৃত্য চলত। পিঠেপুলির খাবার থাকত। শহরের বিত্তশালী, সামাজিক ও প্রশাসনিক নেতৃবৃন্দ থাকতেন এ অনুষ্ঠানের অতিথি। একটু গলা ভেজাতে তাড়ির পিয়াসও মেটাতেন অংশ নেয়া অনেকেই।
রাখাইনদের বড় অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে প্রবারণা পুর্ণিমার ফানুস উৎসব। এ উৎসবে সকল রাখাইন পল্লী থেকে ফানুস আকাশে ওড়ানো হতো। তিনদিনের এ উৎসবে দলগত নৃত্য পরিবেশন হতো। বাদ্যের তালে নাচ হতো, হতো গান। এছাড়া নতুন বছরকে বরণ করার ‘বর্ষবরণ’ অনুষ্ঠান ছিল এদের জমকালো অনুষ্ঠান। যাকে বলা হয় জলকেলি উৎসব। উৎসবের প্রস্তুতি থাকে ব্যাপক। তবে আর্থিক দৈন্যে এ অনুষ্ঠান, কলাপাড়ায় প্রতিবছর হলেও কুয়াকাটার কেরানিপাড়া ও গোড়া আমখোলা পাড়ায় এখনও ছোট্ট পরিসরে অনুষ্ঠিত হয়।
এ বছর তুলাতলিপাড়ায় এ উৎসব হয়েছে। পটুয়াখালী-বরগুনা জেলার রাখাইন সম্প্রদায়ের শিশু-কিশোর থেকে তরুন-তরুণী, যুবারা এ উৎসবে মেতে ওঠে। পুরনো বছরের সকল পঙ্কীলতা দূর করে নতুন আগামির প্রত্যাশায় রাখাইনরা সব ধুয়ে-মুছে ফেলেন একে অপরের শরীরে পানি ছিটিয়ে।
এ উৎসবে বিশেষ সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। আয়োজন করা হয় পিঠেপুলিসহ নানা খাবারের। রাখাইনদের ভাষায় স্যাংগ্রেই এ উৎসবের নাম। এ ছাড়া বর্ষবরণ অনুষ্ঠানও করতেন এ সম্প্রদায়ের মানুষ। ভিন্ন সঙ্গীতানুষ্ঠানসহ ধর্মীয় রেওয়াজ পালিত হতো। এমনকি ধর্মীয় নেতা বৌদ্ধভিক্ষু প্রয়াত হলে শেষ কৃত্যানুষ্ঠান হতো রাজকীয় স্টাইলে। বর্ণিল এ অনুষ্ঠান উপভোগ করত সব ধর্মের-বর্ণের মানুষকে। রথ যাত্রা থেকে নৃত্য, সমবেত সঙ্গীত ছিল মনোমুগ্ধকর। এখন এসব সঙ্গীত, সাংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠান ধরে রাখা এ সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে বোঝা হয়ে গেছে। কারণ জমিজমা থেকে সবকিছু হারিয়ে নিজেদের অস্তিত্বের লড়াইয়ে টিকে থাকাই এদের এখন মূল চ্যালেঞ্জ। এদের নিজস্ব পাড়া, মন্দিরের জমি পর্যন্ত জবর-দখল করা হয়েছে। দখল করা হয়েছে তাদের নিয়ন্ত্রিত খাস পুকুরগুলো। তিন বেলা পেটের খাবার যোগানের দৌড়ে সদাব্যস্ত থাকতে হয় তাদের। সেখানে সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে ধরে রাখার বাসনা নিস্তেজ হয়ে নিজেরাই নির্লিপ্ত হয়ে গেছেন।
তারপরও বিশেষ পার্বণে সামাজিক রীতির মতো যা না করলেই নয়, ওইসব সংস্কৃতি পালন করেন। তবে অধিকাংশই ঘরোয়াভাবে। জৌলুস নেই। এক কথায় আদিবাসী রাখাইনদের এসব অনুষ্ঠান ছিল এ জনপদের আকাঙ্খিত উৎসব। যা ভিন্ন ধর্মের মানুষও উপভোগ করতে মুখিয়ে থাকতেন।
প্রবীণ রাখাইন মংচোথান জানান, একসময় তাদের নৌকাবাইচ হতো। নৌকার সামনে ড্রাগনের, আর পেছনে ঈগলের প্রতিকৃতি থাকত। উত্তাল নদীতে এ বাইচ হতো। বাইচে অংশ নেয়া রাখাইনরা সমবেত সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। এছাড়া বিভিন্ন পার্বণে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল রাখাইনদের প্রাণের অস্তিত্ব। এখন আর সেই প্রাণের অস্তিত্ব তারা খুঁজে পান না। সর্বদা থাকছেন অধিকার হারানোর শঙ্কায়।
তারপরও সরকারের এবং সমাজের সকল বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণে কিছু কিছু সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড করে যাচ্ছেন বলে এ সমাজ সচেতন মানুষটি জানালেন। সরকারিভাবে রাখাইনদের সংস্কৃতি সংরক্ষণে ১৯৯৮ সালের মে মাসে কুয়াকাটায় রাখাইন সাংস্কৃতিক একাডেমি ভবন করা হয়। দেয়া হয় সাংস্কৃতিক উপকরণ। কিন্তু এ ভবনটি এখন ভাড়া দেয়া হয়েছে। যা নিয়ে সংস্কৃতিমনা রাখাইনরা ক্ষুব্ধ রয়েছেন। কারণ রাখাইনদের সঙ্গীত অঙ্গনের সংগঠকরা তাদের সংস্কৃতি ধরে রাখার জন্য নিয়মিত সঙ্গীত রেওয়াজসহ পরিবশেনের প্রস্তুতি নিতে পারছেন না।
বাংলাদেশ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ এবং সহায়তা কামনা করেছেন রাখাইন নেতৃবৃন্দ। কয়েক বছর আগে ঢাকা থেকে আগত নাগরিক প্রতিনিধিদলের নেতৃবৃন্দের অংশগ্রহণে একটি প্রতিনিধিদল কলাপাড়ার রাখাইন জনগোষ্ঠীর জীবন-যাত্রার হাল-হকিকত দেখতে কলাপাড়ায় আসেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক গবেষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস এ নিয়ে তখন কলাপাড়া প্রেসক্লাবে এক মতবিনিময় সভা করেন। সেখানে রাখাইনদের জীবনমানের উন্নয়নে বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেন। এসময় বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার জন্য রাখাইনরা দাবি জানান। তবে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এ জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ধরে রাখতে বিভিন্ন সময় সহযোগিতা করা হয়। তাদেও জীবন-মান উন্নয়নেও নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার রবিউল ইসলাম জানান, এ বছরের তারুণ্যের উৎসব ঘিরে কুয়াকাটায় রাখাইনদের জমকালো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। তাঁদের কৃষ্টিকালচার রক্ষায় বর্তমান সরকার সচেষ্ট রয়েছেন।
মেজবাহউদ্দিন মাননু/মো. মহিউদ্দিন