আরেকটি নতুন বছরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বিশ্ব
আরেকটি নতুন বছরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বিশ্ব। প্রতিটি নতুন বছরেই সবার থাকে নতুন নতুন পরিকল্পনা। পুরনো বছরে যা কিছু মনের বিপরীতে ছিল, নতুন বছরে তেমন কিছু যেন না ঘটেÑ এমনি ইচ্ছা পূষণ করে সবাই। বিগত বছরে পুরো দেশের প্রেক্ষাপটে ঘটে গেছে অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। তার সব যে ভালো ছিল তা নয়, কিছু মেনে নিতে মনও অপ্রস্তুত ছিল দেশ তথা জাতির। বিশেষ করে বছরের শেষ অর্ধেক দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঘটেছে বিপুল পরিবর্তন।
ঠিক তার পর পরই কয়েকদিনের ভারি বর্ষণ ও ঢলে ফেনী এবং নোয়াখালীসহ দেশের ১১টি জেলা ও ৭৩টি উপজেলা স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় প্লাবিত হয়। মানবতার বিশাল দৃষ্টান্ত উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেয় এই দুর্যোগে। শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ, নি¤œবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশের এই ক্রান্তিকালে। নতুন সরকারের পক্ষে কঠিন ছিল একার পক্ষে এই দুর্যোগ থেকে উতড়ানো।
সামাজিক মূল্যবোধ ও দায়বদ্ধতা ॥ সামাজিক মূল্যবোধ ও দায়বদ্ধতা বেড়েছে তরুণদের মাঝে। দেশ ও সমাজের যে কোনো দুর্যোগে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একে অন্যের পাশে দাঁড়াতে শিখেছে তারা। আগস্ট-সেপ্টেম্বরের বন্যাকবলিত মানুষের পাশে তারা যেভাবে বিভিন্ন এলাকা ও ফেসবুকে নানা রকম গ্রুপ থেকে এক জোট হয়ে বিভিন্ন উপহার সামগ্রী নিয়ে এই দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছে, তা বর্তমান জেন-জি কে দেশ ও বিশ্ববাসীর কাছে নতুন করে পরিচয় করিয়েছে।
এমনকি বন্যা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় লোকজন নিয়ে রাস্তা, কালভার্ট তৈরি করতে দেখা গেছে। এসব কিছুই তাদের সামাজিক মূল্যবোধ ও দায়বদ্ধতারই বহির্প্রকাশ। নতুন বছরেও তারা নতুন নতুন পরিকল্পনা করছে।
রসনা বিলাস ও স্বাস্থ্যসচেতনতা ॥ ইদানীং রসনা বিলাসী হয়ে উঠেছে সবাই। একদিকে ইউটিউব দেখে যেমন ঘরে নিজেরা তৈরি করছে মুখরোচক খাবার, অন্যদিকে বাইরের খাবারের প্রতিও ঝোঁক বেড়েছে। আবার স্বাস্থ্যসচেতনতাও বেড়েছে সমানতালে। নিজের প্রতি যতœশীল হয়ে উঠছে ছেলেমেয়ে সবাই। আগে যা শুধু মেয়েদের বিষয়েই উদাহরণ হতো।
স্কুলগামী সন্তানের বাবা-মা ॥ করোনার সময় থেকেই বাচ্চাদের পড়াশোনায় প্রচুর ঘাটতি পড়ে যায়। তা ছাড়া সিলেবাস পরিবর্তন হওয়ায় পড়ায়ও বিঘœ ঘটেছে। বাচ্চাদের পড়ায় বসাতে বাবা-মায়েদের বেগ পেতে হয়েছে অনেক। এরপর ছিল ভর্তি বিড়ম্বনা। সন্তানকে একটা ভালো স্কুলে দেওয়ার প্রচেষ্টা থাকে সব বাবা-মায়ের। স্কুল পরিবর্তন ও নতুন স্কুলে যাওয়া বাচ্চাদের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো নিয়ে নতুন বছরে অভিভাবক থাকেন উৎকণ্ঠিত। তা ছাড়া অনেকে আবার বাচ্চাদের স্কুলের কাছে বাসা নেওয়ার চিন্তায়ও আছেন, যাতে অল্প সময়ে যানজট পেরিয়ে সহজেই যাতায়াত করতে পারেন।
স্ট্রিট ফুড ॥ হঠাৎ করেই স্ট্রিট ফুডের কদর বেড়েছে। একটা সময় অভিভাবকদের কড়া নির্দেশ থাকত পথের ধারের খাবার যেন না খাওয়া হয়। কিন্তু এখন অভিভাবকরাই ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিকেলে ঘুরতে গিয়ে এসব স্ট্রিট ফুড খেয়ে আসে। যদিও এসব খাবার কতটা স্বাস্থ্যসম্মত তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তবু দিন দিন স্ট্রিট ফুডের কদর বেড়েই চলেছে। বন্ধুদের আড্ডা বা একটুখানি বাইরে সময় কাটানো মানেই যেন স্ট্রিট ফুড। একটা সময় স্ট্রিট ফুড মানে ছিল ফুচকা, চটপটি, ঝালমুড়ি ও নানা রকম আচার।
এর পরে এলো ভেলপুরি আর ছোট ২ টাকার শিঙ্গাড়া। এখন এসবের সঙ্গে অনেক ভালো মানের খাবারও পাওয়া যায় সেখানেÑ পাস্তা, নুডলস, চাওমিন, চিকেনের বিভিন্ন রকম আইটেম, ফ্রাইড রাইস, শীতের নানা রকম পিঠা, লুচি, পরোটাসহ নানা লোভনীয় খাবার। তা ছাড়া ছোট ছোট ফুডকার্টগুলো এত সুন্দর করে সাজানো থাকে যে, দেখলে সত্যিই খেতে ইচ্ছা জাগে। বেশিরভাগ ফুডকার্টেই ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী খাবার সামনেই তৈরি করে দেয়, যার জন্য সব শ্রেণির মানুষেরই এসব স্ট্রিট ফুড খেতে দেখা যায়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে প্রতিদিন সন্ধ্যায় মুখরিত হয়ে ওঠে এসব খাবারের জন্য। শুধু তরুণরাই নয়, সবার মাঝেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই স্ট্রিট ফুড।
ফ্যাশন ॥ ফ্যাশন সচেতনতাও বেড়েছে এই একবিংশ শতকে সবার মাঝে। শুধু ছেলেমেয়েদের মাঝেই নয়, সব শ্রেণির মানুষই এখন অনেক বেশি ফ্যাশন সচেতন। ইন্টারনেটের কারণে কখন কোন ট্রেন্ড চলছে খুব দ্রুত সবাই তা জেনে যায়। তাই এখন বৈশাখ, ফাল্গুনসহ বিভিন্ন উৎসবগুলোতে সবাই আর আগের মতো নির্দিষ্ট রং আর ডিজাইনের পোশাকই পড়ে না, নানা রং-ডিজাইনে তৈরি ফ্যাশনেবল পোশাকে নিজেদের উপস্থাপন করে ভিন্ন আঙ্গিকে।
অনলাইন নির্ভরতা ॥ বিজ্ঞান জীবনকে দিয়েছে গতি। ইন্টারনেট এখন শুধু বিনোদন বা বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কাজেই লাগে না, এর মাধ্যমে অনেক মেয়েরা ঘরে বসেই উপার্জন করছে। এবং দিন দিন এর সংখ্যা খুব দ্রুত গতিতে বেড়েই চলেছে। অনেক সচ্ছল পরিবারের মেয়েরাও এখন ঘরে বসে অনলাইন ব্যবসা করে উপার্জন করছে। যে ভালো রান্না জানে সে রান্না নিয়ে কাজ করছে, যে ভালো সেলাই জানে, সে সেলাই করছে। যে ভালো আঁকতে জানে, সে হ্যান্ড পেইন্ট করছে শাড়ি-জামা-পাঞ্জাবিতে। বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়।
চলচ্চিত্র বিনোদন ॥ এক সময় মানুষের বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম ছিল চলচ্চিত্র। ছুটির দিনে বা বিশেষ দিনগুলোতে চলচ্চিত্র দেখার পরিকল্পনা থাকতই। সেটাই থাকত বিনোদনের সেরা উপাদান। মাঝে বেশ কয়েক বছর অশ্লীলতা আর সস্তা গল্প দখল করে নিয়ে হারিয়ে যাচ্ছিল এই বিশাল ক্ষেত্রটি। চলচ্চিত্রেও এবার সুদিন দেখা দিয়েছে। গল্প ও সাহিত্যনির্ভর বেশ কিছু চলচ্চিত্র তৈরি হওয়ায় মানুষ আবার হলমুখী হয়েছে। সপরিবারে আবার সবাই হলে যাচ্ছে সিনেমা দেখতে।
তারুণ্যের জয়জয়কার ॥ বিশ্ব এখন গতিশীল। সেই সঙ্গে গতি বেড়েছে সবারই। তরুণরা ছুটে গেছেন এভারেস্ট থেকে এন্টার্কটিকায়। ৪২ ফুট ওপর থেকে শূন্যে ঝাঁপ দিয়েছেন কেউ, কেউ সাইকেল নিয়ে পৌঁছে গেছেন হিমালয়ে। প্লেন চালিয়ে কেউ মহাকাশে এঁকে দিচ্ছেন প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের মানচিত্র।
তবে সেই পরিবর্তনে গৃহিণীরা কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে। যারা স্বেচ্ছায় শুধু সংসারকে বেছে নিয়েছেন, তাদের কোনো আক্ষেপ নেই। কিন্তু যারা বাধ্য হয়েছেন তাদের আক্ষেপের শেষ নেই। আমি বলব তাদেরও আক্ষেপ করার কিছু নেই। তারা বিনা ছুটিতে প্রায় ২৪ ঘণ্টা সংসারে সময় দিয়ে, সন্তান লালন-পালন করে, আত্মীয়-পরিজনদের দেখভাল করছেন, তাদের অবদানও কম নয়। আমরা যারা ঠিক বর্তমানের আগের যুগের, তারা মায়ের মায়া-মমতায় বড় হয়েছি, তারাই বুঝি মায়ের আঁচল কি জিনিস।
মা কতটা আগলে রাখেন সারাক্ষণ তার সন্তানকে। কতটা গুছিয়ে ঘরের কোণে কোণে মমতায় ভরিয়ে রাখেন সংসার। কেউ হয়তো ভাবেন, স্বামীর কাছে হাত পেতে নিতে হয়। মনে রাখবেন, আপনার স্বামীর আয় রুজিতে আপনার সম্পূর্ণ হক আছে। তিনি বাধ্য আপনার ভরণ-পোষণ করতে। ইসলামে তার পূর্ণ বিধান রয়েছে। তাই হাত পেতে নিতে সঙ্কোচ নয়, আপনি আপনার ন্যায্য পাওনাটুকুই নিচ্ছেন তার থেকে। গৃহিণীদেরও সংসারে অবদান কোনো অংশে কম নয়।
যুগ পাল্টাচ্ছে। ইন্টারনেটের এই যুগে আমরা পরিচিত হচ্ছি বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে। সেই সঙ্গে পাল্টে নিচ্ছি নিজেদেরও। আর আমাদের সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি। কিন্তু সময় যতই বদলে যাক, আমরা যেন সেই ¯্রােতে আমাদের দেশ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বদলে না দেই। শুধুমাত্র বিশেষ দিনেই যেন আমাদের ধর্ম, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে মনে না করে সব সময় মনে রাখি, পালন করিÑ নতুন বছরে এই প্রত্যাশা।