ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১ মাঘ ১৪৩১

ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের স্মরণীয় সাফল্য

জাহিদুল আলম জয়

প্রকাশিত: ২১:৫০, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪

ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের স্মরণীয় সাফল্য

সময়ের অমোঘ নিয়মে অতীতের খাতায় ঠাঁই নিয়েছে ২০২৪ সাল

সময়ের অমোঘ নিয়মে অতীতের খাতায় ঠাঁই নিয়েছে ২০২৪ সাল। মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্যই হলো মনের আয়নায় ফেলে আসা স্মৃতিটুকু আগলে রাখা; চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলানো। তাইতো ১২ মাস আগে যাকে সাদরে বরণ করে নেওয়া হয়েছিল, সেই বছরের স্মৃতিময় মুহূর্ত বা ঘটনাগুলোতে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে বিশ্ববাসী। নির্মল বিনোদনের মাধ্যম ক্রীড়াঙ্গনও এর বাইরে নয়। হাসি-কান্না, সাফল্য-ব্যর্থতায় মোড়ানো আরেকটি বছর পার করেছে বাংলাদেশের খেলাপাগল মানুষ। বছরজুড়ে ক্রীড়াঙ্গনে ঘটে যাওয়া সেসব আলোচিত ঘটনা নিয়ে এ আয়োজন।  

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন ২০২৪ সালে সাফল্য-ব্যর্থতা, হাসি-কান্নার মিশেলে ভরপুর ছিল। এ বছর দেশের ক্রীড়াঙ্গন সাক্ষী হয়েছে উত্থান-পতনের। সাফল্য যেমন এসেছে তেমনি না পাওয়ার বেদনাও কম ছিল না। বিদায়ী বছরে ক্রিকেটে পছন্দের ফরম্যাট ওয়ানডেতে টাইগাররা হতাশ করলেও চোখ ধাঁধানো সাফল্য এসেছে মর্যাদার টেস্ট ও টি২০তে। টেস্টে পাকিস্তানকে তাদেরই মাটিতে ২-০ ব্যবধানে হারিয়ে ঐতিহাসিক সাফল্য পেয়েছে লাল-সবুজের দেশ। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে (টি২০ সিরিজ) ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তাদেরই মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে ইতিহাস গড়ে ‘টিম বাংলাদেশ’। 
এর পাশাপাশি পরাশক্তি ভারতকে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো ছেলেদের অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপের শিরোপা জিতেছে টাইগার যুবারা। মেয়েদের ফুটবলে দেশবাসীকে আরেকটি সোনার সাফল্য উপহার দিয়েছেন বাংলাদেশের বাঘিনীরা। টানা দ্বিতীয়বার নারী সাফে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অবিস্মরণীয় কীর্তি গড়েন সাবিনা-ঋতুপর্ণারা। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে (বাফুফে) কাজী সালাউদ্দিন যুগের অবসান হয়েছে।

নতুন সভাপতি হয়েছেন তাবিথ আউয়াল। তেমনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডেও (বিসিবি) এসেছে পরিবর্তন। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিসিবির সভাপতি হয়েছেন সাবেক টাইগার অধিনায়ক ফারুক আহমেদ। এর মাধ্যমে শেষ হয়েছে নাজমুল হাসান পাপন গংদের স্বৈরাচারী অধ্যায়। বছর জুড়ে আলোচনায় ছিলেন সাকিব আল হাসান। সাবেক বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার দেশের মাটিতে শেষ টেস্ট খেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনে পাশে না থাকায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে আর দেশে ফিরতে পারেন নি তিনি।

এসবের পাশাপাশি বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আলোচিত ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ফুটবলার হামজা চৌধুরীর বাংলাদেশের জার্সিতে খেলা নিশ্চিত হওয়া বছরের অন্যতম বড় ঘটনা। বিদায় বছরে দুনিয়ার মায়া ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু। 
শেষ ভালো যার, সব ভালো তারÑ বাংলাদেশের ক্রিকেট বিজয়ের মাস ডিসেম্বর যেন সেই বার্তাই নিয়ে আসে। এ মাসেই যুব এশিয়া কাপ জয় করে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দলের ছেলেরা। নারী অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপেরও ফাইনালে খেলেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। এ ধারাবাহিকতায় বছরের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ জিতে ইতিহাস গড়ে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল। স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে টি২০ সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করে টাইগাররা।

কিংসটাউনে পয়মন্ত ভেন্যু হয়ে ওঠা আরনস ভেল গ্রাউন্ডে তৃতীয় ও শেষ টি২০ ম্যাচে ৮০ রানের বড় ব্যবধানে জয় পায় লিটন দাসের দল। গেল বছর নানা উত্থান-পতনের মধ্যে থাকা বাংলাদেশ দলের ব্যর্থতার গল্পটাই বুকে ভারি পাথরের মতো চেপে বসেছিল ভক্ত-সমর্থকদের। কিছু সাফল্য আসলেও বড় বড় হতাশা দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের হতাশ করে। বছরের প্রথমে শ্রীলঙ্কার কাছে টেস্ট সিরিজ হার দিয়ে শুরু হয় মিশন। তবে শেষটা সুন্দর হয়েছে ক্যারিবীয়দের ধবলধোলাই করার মধ্য দিয়ে। এর আগে বছরের প্রথম ছয় মাসে ছিল একের পর এক ব্যর্থতা। গত জুনে যুক্তরাষ্ট্র ও ওয়েস্ট ইন্ডিজে যৌথভাবে আয়োজিত টি২০ বিশ^কাপের সুপার এইট পর্ব থেকে বিদায় নেয় বাংলাদেশ।

সাফল্য বিবেচনায় বড়দের ছাপিয়ে গেছেন যুবারা। বিদায়ী বছরে টানা দুই ট্রফিতে ঝলমলে ছিলেন খুদে টাইগাররা। ওয়ানডে ফরম্যাটের যুব এশিয়া কাপ ক্রিকেটের প্রথম নয় আসরে কোনো শিরোপা ছিল না। দুবাইয়ে ২০২৩ সালের ফাইনালে আয়োজক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতকে হারিয়ে অপেক্ষার অবসান ঘটে। একই ভেন্যুতে ডিসেম্বরে রেকর্ড আটবারের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে উড়িয়ে সাফল্যের সেই ধারা অব্যাহত রাখে টাইগার যুবারা। পরাক্রমশালী প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো যুব এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরবে ভাসে আজিজুল হাকিম তামিমের দল।

দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০২০ যুব বিশ্বকাপের ফাইনালে এই ভারতকে হারিয়েই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আকবর আলির বাংলাদেশ। যা যে কোনো পর্যায়ের ক্রিকেট বিশ্বকাপে একমাত্র সাফল্য। আরেকবার সেই ভারতকে হারিয়ে গৌরবময় সাফল্যে ভাস্বর হয়েছেন লাল-সবুজের যুবারা। বিদায়ী বছরের সেপ্টেম্বর মাসে টেস্টে ঐতিহাসিক অর্জন ধরা দেয়; যা বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসেই নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। পাকিস্তানের মাটিতে স্বাগতিকদের ২-০ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ। রাওয়ালপিন্ডিতে সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টে পঞ্চম ও শেষ দিন ৬ উইকেটের জয় পায় টাইগাররা। একই ভেন্যুতে প্রথম টেস্টে ১০ উইকেটে জয় পায় বাংলাদেশ।
চব্বিশে আরও একবার হিমালয়ের চূড়ায় উঠেন বাংলাদেশের মেয়েরা। সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে টানা দ্বিতীয়বার অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে ইতিহাসের পাতায় সোনার হরফে নিজেদের নাম লিখেন সাবিনা খাতুন, মনিকা চাকমা, ঋতুপর্ণা চাকমারা। গত ৩০ অক্টোবর সপ্তম নারী সাফের ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে ২-১ গোলে হারিয়ে অবিস্মরণীয় শিরোপা জয়ের গৌরবে ভাসে বাংলাদেশ। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে বাংলার বাঘিনীদের গর্জনে কেঁপেছে দক্ষিণ এশিয়ার নারী ফুটবল। এর আগে ২০২২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর আগের সাফের ফাইনালেও এই নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ।

সেবার বাংলার মেয়েরা প্রথম জয়ের স্বাদ পায়। ২০২২ সালে প্রথমবার মেয়েদের সাফে শিরোপা জয়ের কীর্তি গড়েন বাংলার অদম্য মেয়েরা। এর ফলে পুরুষ কিংবা মেয়েদের ফুটবলে যে কোনো ফরম্যাটে ২০০৩ সালের পর সাফ শ্রেষ্ঠত্ব পায় বাংলাদেশ। পুরুষ দল সবশেষ ২০০৩ সালে দক্ষিণ এশিয়ান ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। ২০২২ সালে বাংলার সোনার মেয়েদের হাত ধরে ১৯ বছর পর দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে শিরোপা জয়ের স্বাদ পায় লাল-সবুজের দেশ। শুধু তাই নয়, ১৯৯৯ সালে নেপালেই প্রথমবার দক্ষিণ এশিয়ার সেরা হয়েছিল বাংলাদেশ পুরুষ ফুটবল দল।

সুদীর্ঘ ২৩ বছর পর  সেই নেপালেই দক্ষিণ এশিয়ার সেরার মুকুট পরেন মেয়েরা। সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে বিদায়ী বছরে সাফের শিরোপা অক্ষুণœ করেন বাংলাদেশের মেয়েরা। এর মধ্য দিয়ে বিদেশের মাটিতে দেশের পতাকার মানও সমুজ্জ্বল করেছেন বাংলার বাঘিনীরা। 
হকিতে শুধু ব্যর্থতা আর হতাশার গল্পই শোনা গেছে বছরের পর বছর। যখন কোন আশার আলো দেখা যাচ্ছিল না, তখনই মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমান থেকে আসে চমক জাগানিয়া খবর। সেটা হলো ইতিহাস গড়ে যুব বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে বাংলাদেশ যুব হকি দল। গত ৩ ডিসেম্বর অনন্য এই কীর্তি গড়েন লাল-সবুজের যুবারা। এখন পর্যন্ত বড়রা যা করতে পারেনি, তাই করে দেখিয়েছেন যুবারা। প্রথমবারের মতো যুব হকির বিশ^কাপে খেলবে বাংলাদেশ। স্থান নির্ধারণী ম্যাচে থাইল্যান্ডকে ৭-২ গোলে বিধ্বস্ত করে এই কীর্তি গড়ে যুব হকি দল। নতুন বছর ২০২৫ সালে ভারতে হবে যুব বিশ্বকাপ। যেখানে এশিয়া থেকে সাত দল অংশ নেবে।

বাংলাদেশের ঐতিহাসিক অর্জনে উচ্ছ্বসিত জাতীয় দলের বর্তমান ও সাবেক খেলোয়াড়েরা। সাবেক হকি তারকা রফিকুল ইসলাম কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, ‘স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। এই দিনটির জন্যই অনেকদিন ধরে অপেক্ষায় ছিলাম। এর আগেও আমরা অনেক চেষ্টা করেছিলাম। এই সাফল্য ধরে রাখতে হবে। এক বছর হাতে সময় আছে। পরিকল্পিতভাবে নিজেদের গোছাতে হবে। বিশ্বকাপে ভালো ফলের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।’
জাতীয় হকি দলের তারকা ফরোয়ার্ড রাসেল মাহমুদ জিমি বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, যুবারা বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। তাদের আন্তরিক অভিনন্দন। হকিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আমাদের এমন একটা সাফল্য দরকার ছিল।’

×