জামিলার স্বামীর বদলির চাকরি। বদলি হলে তিনি একাই যান নিজের দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে। পরিবার নিয়ে টানাটানি করতে চান না। জামিলার কাছে সংসারের সব ভার তুলে দিয়ে নির্ভাবনায় চাকরি করেন। সপ্তার শেষে ছুটিতে বাড়িতে আসেন। হাতে থাকে ব্যাগ ভরা জিনিস সবার জন্য। তার আসার দিন জামিলা পথ চেয়ে বসে থাকে। রাত হয়। সবাই ঘুমায়ে যায়। রাস্তার ল্যাম্প পোস্ট আলো দেয়। বাড়ির গেটের সামনে রিক্সা থামে। ঘুমন্ত পাড়ার ভেতর একটা বাড়িতে আলো জ্বলে ওঠে। বাচ্চারা ঘুম থেকে জেগে ওঠে। হঠাৎ ঘরটা ভরে ওঠে তখন আলোর মতোই অথৈ আনন্দে।
জামিলাকে তিনি দেখতে গিয়েছিলেন এক দূর গ্রামে। সেখানে যেতে হয় কপোতাক্ষ নদীতে নৌকায় করে। নৌকা ভিড়ে বাঁকড়া বাজারের ঘাটে। সেখান থেকে সাইকেলে চেপে এক অজপাড়াগাঁয়। কাঁচামাটির ধুলো ওড়া রাস্তা। হাত-মুখ ধুয়ে বাইরের দহলিজ ঘরে বসেছিলেন। নিজের চেয়ে বেঢপ মাপের বড় একটা শাড়ি পড়ে লম্বা ঘোমটা টেনে জামিলা সামনে এসেছিল। মুরুব্বিরা কেউ বলল, মা ঘোমটা একটু সরাও! তোমার মুখটা দেখি! এর মাঝে মুখটা দেখেছেন তিনি। অপরূপ সুন্দরী। গোলগাল গড়নের এক কিশোরী। এই কথাগুলো জামিলা শুনেছিল পড়ে তার শাশুড়ির কাছ থেকে। এ ভাবেই বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি যখন ছেলেকে জিগ্যেস করেছিলেন, কেমন দেখলি মেয়ে?
তার আঙুলে আংটি পরানো হলো। আংটিও ছিল আঙুলের মাপের চেয়ে বড়। বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করে চলে গেল বরপক্ষ।
স্কুল ছেড়ে, মায়ের বাড়ি ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে জামিলা স্বামীর হাত ধরে এসেছে নতুন শহরে। শহরের কত রকমের মানুষÑ বুঝতে তার সময় লেগেছে। ভাড়াবাসায় থেকেছে। তারপর একদিন উঠেছে নিজের বাড়ি। বাঁশ-চাটাই ও গোলপাতার ছাউনির বাড়ি থেকে ইটের বাড়ি। বড় উঠোন। উঠোনের এক পাশে পানির কুয়ো। একটা আলাদা রান্নাঘর। রাস্তার পাশ ঘেঁষে আরেকটা ঘর। সেই ঘরটা বরাদ্দ গৃহশিক্ষকের জন্য। মেহগনি কাঠের পালংটা সেখানে।
ঘর ভরে বাচ্চাকাচ্চা তাদের সংসারে। ঘর সংসার সামলায় জামিলা এক হাতে। বাড়িতে দুটো দৈনিক সংবাদপত্র রাখা হয়। একটা ইংরেজি ও অন্যটা বাংলা। গৃহশিক্ষক ছিলেন যিনি এই সময়টাতে তার নাম শওকত। তার বাবা তাকে পাঠিয়েছেন শহরের কলেজে পড়াশোনা করার জন্য। তার একটা বড় ভাইও পড়তো একই কলেজে। থাকত মেসে। মাঝে মাঝে তাকে দেখতে আসত। জামিলাকে চাচি আম্মা বলে ডাকত। বলত, খিদে পেয়েছে! ভাত, লবণ আর কাঁচামরিচ দিলেই হবে! রান্নাঘরে বসে খেত। নিজেরা যা খেত সেই একই খাবার তুলে দিত তাদের পাতে।
একাত্তর সালের প্রথম দিকে বিনা নোটিশে স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে গেল। পাড়ার কলেজ পড়ুয়া ছেলেরা শওকতের কাছে আসে। ওর ঘরে বসে খবরের কাগজের খবরগুলো চুলচেরা বিশ্লেষণ করে। বলে নিজেদের কি করা উচিত। ফিস ফিস করে কথা বলে। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা করে। শওকতের বড় ভাইয়ের মেস বন্ধ হয়ে গেছে। সে এসেছে এখানে। ব্যাংকের চাকরির জন্য সে শর্টহ্যান্ড শিখছে। তার পড়াশোনা শেষের দিকে। যুদ্ধের জন্য যদিও তখন সবকিছু বন্ধ।
জামিলার স্বামী তখন ঝিনাইদহ শহরে। যশোর থেকে ৩০-৪০ মাইল দূর। সবখানে কার্ফু চলছে। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। স্বামীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই এখন। প্রতিবেশীরা আছে। কেউ কেউ শহর ছেড়ে চলে গেছে নিরাপদ জায়গায়। যারা আছে তাদের সঙ্গে কথা বলে। পরামর্শ করে। নিজেকে শক্ত করে। তার আটটা সন্তান, তার ভেতর একজন দুধের শিশু। ভেঙে পড়েননি তিনি। শুরু হলো তার নিজের যুদ্ধ।
জামিলাদের বাড়ি শহরের পশ্চিমে ক্যান্টনমেন্টের কাছে। বড় রাস্তা থেকে দু-তিনটা বাড়ির পর তাদের বাড়ি। মিলিটারিরা নিয়মিত টহল দিচ্ছে। বড় বড় সাঁজোয়া ট্রাকগুলো রাস্তা দিয়ে শব্দ করে চলে যাচ্ছে। ভয়ে বাড়ির জানালা-দরজা বন্ধ করে রাখে।
জামিলার চিন্তা কিছুতেই কমে না। তার মেয়েটা বড়। তারপর আরও সাতজন। এত বড় সংসার তুলে নিয়ে কোনদিকে যাবে! খবর নিয়ে জেনেছে বাবার কিংবা শ্বশুরবাড়ির দিকে যাবার কোনো উপায় নেই। সব পথে বাঁধা-বিপত্তি। মিলিটারি ও তাদের সহযোগীরা রাস্তায় রাস্তায়। একা এত বড় বিপদে কীভাবে সামাল দেবে!
একদিন বিকেলে সোরগোল শোনা গেল। মিলিটারি আসছে! পাড়ার সবাই তড়িঘড়ি করে নিজেদের বাড়িতে ঢুকে জানালা-দরজা বন্ধ করে দিল। কারও কাছ থেকে হয়তো গোপনে খবর পেয়েছে। বাড়ির সামনে থামছে। হাত বেঁধে বাড়ি থেকে বের করছে। রাইফেলের বাঁট দিয়ে ঠেলা ও ধাক্কা দিয়ে ভ্যানে তুলছে। ঘরের ভেতরে অন্ধকার। চোখ বন্ধ করে সবাই দোয়া পড়ছে, যে দোয়া পড়েছিলেন নূহ নবী সমুদ্রে মাছের পেটে ঘোর বিপদে।
মিলিটারি অপারেশন সেরে ফিরে গেল ক্যান্টনমেন্টে। এরপর একদিন দুদিন পার হয়ে যায়। যাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল তাদের কেউ ফিরে এলো না। পাড়ার দুজন ছেলে মঈন ও বাবুল। কারও বিপদে-আপদে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ত। পরে জানা গেল ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে তাদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করে। কোনো কথা বের করতে না পেরে মেরে ফেলে। লাশও ফেরত দেয়নি।
এবার জামিলা বেগম খুব ভড়কে যায়। ম্যাট্রিক পাস করা একটা মেয়ে ঘরে। মিলিটারিরা মেয়েদেরও ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এখন এ নিয়ে চিন্তা করছে না সে। চিন্তা হলো সব গৃহশিক্ষক শওকত ও তার ভাইকে নিয়ে। পরের ছেলে তারা। বিপদ আসতে পারে যে কোনো সময়। তাদেরও ধরে নিয়ে যেতে পারে। মেরে ফেলতে পারে।
জামিলা বেগম তাদের বলল, তোমরা বাড়ি চলে যাও, যেভাবে পার লুকায়ে ছুপায়ে। এই খানে থাকা এখন খুব বিপজ্জনক। কোনো একটা অঘটন ঘটে গেলে তোমাদের বাবা-মার কি বলে সান্ত্বনা দেব? শহরের অবস্থা ভালো না। দেখছো না নিজের চোখে!
শওকত অবাধ্য হয়ে বলল, চাচি-আম্মা, চাচাজি নাই। এই ঘোর বিপদে আপনাদের একা ফেলে রেখে যেতে পারব না যতই বিপদ আসুক! নাছোড়বান্দা মানুষ জামিলা। ধমকের সুরে বললেন, দিনের আলো থাকতে রওনা দাও! তার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিলেন। শওকত ও তার ভাই খুব মন খারাপ করে বিদায় নিল।
পাকিস্তানি আর্মিদের সঙ্গে বিহারিরাও যোগ দিয়েছে। প্রতিদিন খবর আসছে নিখোঁজ হওয়ার খবর। বাঙালি ধরতে পারলে জবাই করে গণকবর দিচ্ছে। ঘরবাড়ি লুটপাট করে আগুন ধরায়ে দিচ্ছে। পাড়ার ছেলেরাও অস্ত্র ধরেছে। গেরিলা স্টাইলে আক্রমণ চালাচ্ছে। বাড়ির পশ্চিম দিকে বিমান অফিস। সেখানে তাদের ঘাঁটি। গোলাগুলির শব্দ সারাক্ষণ। জামিলা তার আটটা বাচ্চাকে নিয়ে রাতের বেলা এই বাড়ি থেকে সেই বাড়িতে লুকায়। যেটুকু খাবার আছে, সবাই মিলে খায়।
বাড়ির সামনের রাস্তা ধরে উত্তরে সামান্য গেলে বাম দিকে একটা গলি। ডেড এন্ড গলি এটা। বেশ নিরিবিলি। জামিলার চাচা ভাড়া থাকে এখানে। তার দুই বউ। পাশে এক মাস্টারের বাড়ি। দোতলার কাজ পুরো শেষ হয়নি। এই বাড়িতে একরাত কাটলো জামিলার। সকালে গোলাগুলির আওয়াজ কমে আসে। জামিলা তার বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ফিরে এলো নিজের বাড়িতে।
দুপুরে তিন চারজন মুক্তিযোদ্ধা আসে দেওয়াল টপকে। জামিলা তাদের খেতে দেয়। সেই অতি সাধারণ খাবারে যেন অমৃতের স্বাদ। নিঃশব্দে দেওয়াল পার হয়ে আবার ঘাঁটিতে ফিরে যায়।
জামিলা এখানে আর থাকবে না। বাবার বাড়ি কিংবা শ্বশুরবাড়ি, যেখানে যাওয়া সহজ সেদিকে রওনা দেবে। দরকারি কাজগুলো গুছায়ে ফেলে। থালা-বাটি এক সঙ্গে বেঁধে নিল। নিজের গহনা রাখল ঘরের ভেন্টিলেটরে। আর স্বামীর হলুদ খামের চিঠির বান্ডিল দিয়ে আড়াল করে রাখল। ঘরে তালা দিল। এখন বের হবে। শওকত কোথা থেকে এসে দাঁড়াল সামনে তখন। বলল আব্বা আমাকে বাড়িতে জায়গা দেননি। ফেরত পাঠিয়েছে। বলেছেন, যাদের বাড়িতে এতোদিন ছিলি, এতো বড় বিপদে তাদের একা ফেলে আসলি কেমনে? আমার ছেলে হয়ে পারলি এমন কাজ করতে?,
শওকত বলল, চাচি-আম্মা! শহরের ভেতর দিয়ে কোথাও যাওয়া যাবে না। সবখানে মিলিটারিদের পাহারা। উপ-শহর দিয়ে আমাদের গ্রামের বাড়িতে যাওয়া বেশি নিরাপদ। পুরো পথটা মুক্তি সেনাদের দখলে।
জামিলা বেগম বললেন, চলো বাবা!
মোহাম্মদ আলী