বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন অকৃত্রিম বন্ধু পণ্ডিত রবিশঙ্কর।
ডিসেম্বরের ১১ তারিখ তাঁর মৃত্যুদিবস। ২০১২ সালের এই তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের কালিফোর্নিয়ার সানদিয়াগো হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় ৯২ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তাঁর পুরো নাম ছিল রবিশঙ্কর চৌধুরী।
কিন্তু শুধু রবিশঙ্কর নামেই তিনি পরিচিত।
তাঁর বাবার নাম শ্যামশঙ্কর চৌধুরী।
মা হেমাঙ্গিনী দেবী।
বাবা-মা’র সাত পুত্রের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট।
রবিশঙ্করের পৈতৃক বাড়ি ছিল বাংলাদেশে।
বর্তমান নড়াইল জেলার কালিয়াতে।
কিন্তু বাবার পেশাগত কারণে তাঁর জন্ম হয় উত্তর ভারতের বারানসিতে। ১৯২০ সালের ৭ এপ্রিল তারিখে।
তাঁর এক ভাই উদয়শঙ্কর একজন খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পী ছিলেন। নিজস্ব একটা নাচের দলও ছিল তাঁর।
খুব ছোটবেলায় এই ভাইয়ের কাছে তিনি নাচ শিখতে থাকেন।
১৯৩৮ সালে যখন তাঁর বয়স মাত্র ১৩ বছর, সে সময় ভাইয়ের নাচের দলের কনিষ্ঠতম সদস্য হয়ে তিনি প্যারিস যান। ওখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি কখনো নৃত্যশিল্পী, আবার কখনো সেতার বাদক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। এ ছাড়া একই দায়িত্ব নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে গমন করেন ইউরোপ ও আমেরিকাতে।
এরপর থেকে তিনি সেতারবাদনে বেশি উৎসাহী হয়ে ওঠেন। তাই নাচ ছেড়ে সেতারবাজনা শিখতে শুরু করেন।
সেতারবাজনা শেখার জন্য তিনি ওস্তাদ সন্ধান করতে থাকেন।
১৯৩৪ সালে এক অনুষ্ঠানে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র সেতারবাদ্য শুনে তিনি মুগ্ধ হন।
পরের বছর তাঁর বড়ভাই উদয়শঙ্কর একটি অনুষ্ঠান পরিবেশন করার জন্য ইউরোপ গমন করেন। উক্ত অনুষ্ঠানে সেতার বাজানোর জন্য সঙ্গে করে নিয়ে যান ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’কে। সঙ্গে গেলেন রবিশঙ্করও।
ওখানে গিয়ে সেতার বাজানোতে রবিশঙ্করের আগ্রহ দেখে মুগ্ধ হন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ।
উদয়শঙ্করকে তিনি বললেন, রবিকে তাঁর কাছে দিয়ে দেওয়ার জন্য।
প্রস্তাবটা শুনে তো ভীষণ খুশি রবিশঙ্কর। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল!
উদয়শঙ্করের অনুমতি নিয়ে রবিশঙ্করকে আলাউদ্দিন খাঁ নিয়ে গেলেন তাঁর বাড়ি ভারতের মধ্য প্রদেশের মাইহারে।
এখন শুরু হলো রবিশঙ্করের যথাযথ সেতারবাজনা শেখা। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র কাছে।
রবিশঙ্করকে আলাউদ্দিন খাঁ শেখাতে লাগলেন বিভিন্ন রাগ-রাগিনীর সেতারবাজনা।
এটা ১৯৩৮ সালের কথা।
খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি সেতারবাজনায় বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন।
মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে তিনি যুগলবন্দি বাজনা বাজাতে শুরু করেন খ্যাতিমান সরোদবাদক ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ’র সঙ্গে।
শিষ্যের এ দক্ষতা দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হন গুরু ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। তাই অতি আগ্রহের সঙ্গে শিষ্যকে তিনি সেতারবাজনা শেখাতে থাকেন। মাত্র এক বছরের মধ্যে শিষ্য রবিশঙ্কর সেতার বাজনায় এত বেশি পারদর্শিতা লাভ করেন যে, অনেক অনুষ্ঠানে ওস্তাদের সঙ্গে তিনি সেতার বাজাতে থাকেন। তাঁর সেতারবাজনা এত দ্রুত উন্নতি লাভ করে যে, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ বেশিদিন তাঁকে প্রশিক্ষণ প্রদানের প্রয়োজনীয়তা বোধ করলেন না। মাত্র বছর ছয়েক পর ১৯৪৪ সালে তাঁর প্রশিক্ষণ প্রদান সমাপ্ত করে দেন।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র কাছ থেকে সেতার বাদন শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি ওস্তাদ এবং পণ্ডিত খেতাবপ্রাপ্ত হন। এরপর চলে যান মুম্বাইয়ে। সেখানে কনসার্ট পার্টির সদস্য হিসেবে যোগদান করেন পিপল্স থিয়েটারে।
এখানে বছর চারেক থাকার পর ১৯৪৯ সালে সংগীত পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে। এখানে ছিলেন ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ সাত বছরের মতো। এখানে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
এরপর তিনি কাজ করতে থাকেন চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক হিসেবে। খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ ও ‘অপুর সংসার’-এর সংগীত পরিচালক ছিলেন তিনি। ভারতের আরও অনেক বিখ্যাত চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেন ওস্তাদ রবিশঙ্কর।
এ ছাড়াও তিনি শিক্ষকতা করেন নিউইয়র্কের সিটি কলেজ অব মিউজিক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব আর্টস, আলী আকবর মিউজিক কলেজসহ অনেকগুলো সংগীতবিষয়ক প্রতিষ্ঠানে।
১৯৫২ সালে পশ্চিমা বিশ্বের বিখ্যাত বেহালাবাদক ইয়াহুদি মেনুহিন দিল্লিতে আসেন এক অনুষ্ঠানে বেহালা বাজাতে। ওই অনুষ্ঠানে এই বিখ্যাত মহান শিল্পীর সঙ্গে পরিচয় ঘটে ওস্তাদ রবিশঙ্করের। তাঁর সেতারবাদন শুনে মুগ্ধ হন ইয়াহুদি মেনুহিন। দু’জনার মধ্যে বন্ধুত্বের সৃষ্টি হয়। এর কিছুদিন পর জাতিসংঘের দশম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় ‘ইউনেস্কো সংগীত উৎসব’। এই অনুষ্ঠানে তাঁদের দু’জনের বেহালা ও সেতারের যুগলবন্দি বাজনা উপস্থিত শ্রোতাদেরকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করে। এরপর থেকে তাঁরা দু’জন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুগলবন্দি বাজনা বাজাতে থাকেন। যুগলবন্দির অ্যালবামও বের করেন তাঁরা।
আমেরিকার অত্যন্ত জনপ্রিয় পপসংগীত শিল্পী জর্জ হ্যারিসন তাঁর কাছে সেতারবাজনা শেখেন।
বাংলাদেশের জনগণ যে বিশেষ কারণে তাঁকে বিশেষভাবে সম্মান ও শ্রদ্ধা করে তা হচ্ছে, একাত্তরে এদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সবিশেষ ভূমিকা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট জর্জ হ্যারিসনকে নিয়ে তিনি নিউইয়র্কের মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনে আয়োজন করেন ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নামে এক জমকালো কনসার্ট অনুষ্ঠান। এতে হ্যারিসনের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মনমাতানো সংগীতের সঙ্গে সেতার বাজান পণ্ডিত রবিশঙ্কর। এ অনুষ্ঠানে জর্জ হ্যারিসন ছাড়াও পশ্চিমা জগতের আরও অনেক বিখ্যাত শিল্পীরা সংগীত পরিবেশন করেন। কনসার্টে সেতারে পণ্ডিত রবিশঙ্কর ছাড়াও বেহালাতে ছিলেন ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, তবলায় আল্লারাখা খাঁ এবং তানপুরায় কমলা চক্রবর্তী। প্রায় ৪০ হাজার মানুষ এ কনসার্টটি উপভোগ করে। সংগৃহীত হয় প্রায় আড়াই কোটি ডলার। সব অর্থই তিনি দান করে দেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তহবিলে, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় বিশেষ সহায়ক হয়। বলাবাহুল্য, ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নামের এই বিশাল অনুষ্ঠানটির প্রধান উদ্যোক্তা এবং সার্বিক আয়োজন ও ব্যবস্থাপনায় ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্করই।
সেতারের জন্য তিনি বেশকিছু রাগ-রাগিনীর সুর সৃষ্টি করেন। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ‘বাংলাদেশের ধুন’ নামক সুরটি। এটি অত্যন্ত প্রাণমাতানো তাল-লয়ের সুর।
সেতারে বিভিন্ন রাগিণীর সুর সৃষ্টিতে বিশ্বজয়ী অবদান এবং সেতারবাদ্যে অসামান্য দক্ষতার জন্য তিনি বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হন। সেসবের মধ্যে অন্যতমÑতপন সিংহ পরিচালিত রবীন্দ্রঠাকুরের কাহিনী ‘কাবুলিওয়ালা’ চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক হিসেবে ১৯৫৭ সালে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ পুরস্কার, ১৯৬২ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি পদক, একই বছরে সংগীত-নাটক একাডেমি পুরস্কার, ১৯৬৭ সালে পদ্মভূষণ পুরস্কার, ১৯৮১ সালে পদ্মবিভূষণ পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে ভারতরত্ন পুরস্কার। এ সবগুলোই দেশের এবং আন্তর্জাতিক মানের অতি সম্মানীয় পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত। বিশেষ করে শেষোক্ত পুরস্কারটি ছিল ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার। এ ছাড়া আরও অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন সেতার জাদুকর পণ্ডিত রবিশঙ্কর।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সেতারবাদনের মাধ্যমে শ্রোতাদেরকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করেন এবং উক্ত অনুষ্ঠান সমূহের প্রাপ্ত তাঁর সম্মানী অর্থ মুক্তিযুদ্ধের ফান্ডে দান করেন। তাই মুক্তিযুদ্ধে তাঁর এই বিশেষ সহায়ক অবদানের জন্য ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাঁকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হয়।
দেশ-বিদেশে পণ্ডিত রবিশঙ্করের অসংখ্য সেতারবাদক ছাত্র-ছাত্রী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বিশ্বখ্যাত পপসংগীত গায়ক জর্জ হ্যারিসনের নাম তো আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমানের একজন খ্যাতিমান গায়িকা ও গীতিকার নোরা জোন্স তাঁর কাছে সেতারবাদ্য শেখেন। ভারতের প্রখ্যাত সেতারশিল্পী আনুশকা শঙ্করের সেতার শেখা পণ্ডিত রবিশঙ্করের হাতে।
উল্লেখ্য যে, পণ্ডিত রবিশঙ্করেরই কন্যা আনুশকা শঙ্কর।
মোহাম্মদ আলী