৯ ডিসেম্বর পালিত হলো নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া দিবস। আবার ডিসেম্বর মাস এলেই বিজয়ের রথ যেমন নির্দেশনা পায় একইভাবে নারী নিগ্রহের করুণ আখ্যানও দুঃখজনক।
দীর্ঘ নয় মাসের অতৃপ্ত অস্থিরতায় দেশ যখন পাকিস্তানি হানাদারদের নির্মম পেষণে দিশেহারা সেখানে সমসংখ্যক নারীর যে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ তাও ইতিহাসের পাতায় অবিচ্ছেদ্য আর্তনাদ। ত্রিশ লাখ শহীদানের উৎসর্গিত জীবন যেভাবে স্বাধীনতার রক্তস্নানে প্লাবিত হয়েছিল একইভাবে নারীদের সম্ভ্রমহানিতার ইতিবৃত্তি ও দুঃসহ এক পালাক্রম। ধারণা করা হয় ২ লাখ নারীর লাঞ্ছিত দাবানলে রক্তিম সূর্যের যে কালো দাগ সেটা কোনোভাবে মুছে যাওয়ার মতোই নয়। ঘোর অমাবস্যা রাত্রির নির্মম আচ্ছাদন। তাই এই মাসটি স্মরণে, বরণে, তিক্ততায়, নৃশংসতার মিলিত এক বাতাবরণ। আবার ৯ ডিসেম্বর নারীশক্তির আধার বেগম রোকেয়ার জন্ম এবং মৃত্যু দিবস।
জন্ম-মৃত্যুর সময়ের মূল তারিখটা মিলে যাওয়া নাকি ক্ষণজন্মা বিজ্ঞজনদের এক অভাবনীয় বরমাল্য। রংপুরের পায়রাবন্দের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া এই প্রতিভাময়ী নারীর জীবনালেখ্যের শুরু। শেষ অবধি কোন উচ্চতর শিখরে পৌঁছায় তাও সমসংখ্যকের জন্য অবারিত এক মুক্ত যাত্রাপথ। চিন্তার ক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী বেগম রোকেয়া সকল নারীর যাত্রাপথেও তাই কামনা করে যান। ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর জন্ম নেওয়া এই মহীয়সী ১৯৩২ সালের একই মাস ও দিনে চির প্রস্থানের পথে চলে যান। মাত্র ৫২ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে সমাজের নিরক্ষর, অবহেলিত পশ্চাদপদ নারীদের জন্য যে নতুন স্বপ্নের দ্বার উন্মোচন করলেন আজও তা অবিস্মরণীর বাস্তবোচিত জীবন কাহিনী।
ব্রিটিশ ভারতের রুদ্ধতার জালে বড় হওয়া বেগম রোকেয়ার চলার পথও সেভাবে অবারিত না থাকা পরিস্থিতির দুর্বিপাক। প্রতিবন্ধকতার বেড়াজাল ছিল পদে পদে। কিন্তু নির্ভয়ে, দুঃসাহসিক মনোবলে তা ডিঙিয়েছেন দুরন্ত অভিগামিতায়। সে সময়ের নারীদের পর্দাপ্রথার আড়ালে যেভাবে নিজেদের লুকিয়ে রাখা হতো সেটা তাকে মর্মাহত আর ক্ষুব্ধ করতে সময় নেয়নি। শুধু পুরুষ নয় অপরিচিত কোনো মহিলার সামনেও আসা বারণ আড়ালে, অন্তরালে থাকা নারীদের। সেটাই ছিল তার ‘অবরোধবাসিনী’ আলেখ্যের মূল সারমর্ম। আর ‘সুলতানার স্বপ্ন’? যা অন্তপুরে আটকে পড়া নারীদের নিয়ে আর এক চমকপ্রদ স্বপ্নগাঁথা অনন্য আলেখ্য। স্বামী সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন ভগলপুরের এক শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব। তারই সফল প্রচেষ্টা আর অনুপ্রাণিত হয়ে বেগম রোকেয়ার যে পথচলা সেটা যেন সমাজের যে কোনো অংশকে অবিচ্ছিন্ন না রাখার তীব্র আকাক্সক্ষা আর স্বপ্নাবিষ্ট প্রতিফলন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষলগ্নে জন্মগ্রহণ করেও ছোঁয়া পান জাগরণের দুর্লভ সময়ের। যদিও তা অন্তপুর অবধি সে সময় পৌঁছাতে পারেনি। অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও এক নতুন শতকের। দমে যাননি, পিছুও হটেননি। অবলীলায়, স্বাচ্ছন্দ্যে দৃঢ়প্রত্যয় আর অঙ্গীকারে এগিয়ে গেছেন অন্তপুরবাসিনী নারীদের অধিকার আর স্বাধীনতার লড়াইয়ে। সেখানে সবার আগে সামনে এসে দাঁড়ায় জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষাকার্যক্রম। এই অনন্য শিক্ষাবিদের তেমন নিরলস সাধনায় যুক্ত হলেন আর এক আধুনিক পুরুষ বিহারের অধিবাসী স্বামী সাখাওয়াত হোসেন।
ঊনবিংশ শতকের ক্রান্তিলগ্নে যখন বঙ্গীয় রেনেসাস তার যাত্রাপথ শুরু করে সে সময় প্রতিটি গৃহকোণে উর্দুভাষার ব্যবহারই ছিল রেওয়াজ। সেখানে রোকেয়ার মাতৃভাষার চর্চাই শুধু নয় গ্রন্থ রচনার তাগিদও ছিল মুখের ভাষাকে সমুন্নত রেখে। এই নির্ভীক আলোকবর্তিকায় নারীদের প্রতি শিক্ষার আলো ছড়াতে যে নজির তৈরি করলেন তা শুধু ইতিহাসই নয় বরং বাস্তবোচিত এক নিরেট কঠিন যাত্রাপথ, বিপরীত সামাজিক প্রতিকূলতায় ১৯০৯ সালে তিনি ভগলপুরের ‘সাাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ নামে একটি বালিকা বিদ্যালয় খোলেন আর এটাই উপমহাদেশের নারী শিক্ষার দ্বিতীয় প্রাতিষ্ঠানিক বলয়। তার আগে কলকাতার বেথুন গার্লস স্কুলই নারী শিক্ষার শুভ দ্বার উম্মোচনে অগ্রগামী ভূমিকায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। নব জাগৃতির নতুন সময় বেগম রোকেয়াকে কতখানি সহায়তা করে সেটা তৎকালীন কট্টর সমাজব্যবস্থায় আলোকপাত করা আছে। তাই নারীদের জন্য একজন মহিলা হয়ে যে কাজটা অসাধ্য সাধনের ব্রত হিসেবে বিবেচনায় এনেছিলেন সেটা আজও এই মহীয়সী শিক্ষাবিদকে নতুন সময়েরও অনুষঙ্গ করে যাচ্ছে। আধুনিক নবযুগের অনুগামী হয়ে একজন গৌরবান্বিত নারী কীভাবে তার যাত্রাপথ নিষ্কণ্টক করলেন তা আজও আমাদের জন্য স্মরণীয় বরণীয়। বিশ শতকের সূচনাকাল। আর আমরা এখন অতিক্রম করছি একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে। বাস্তব অভিজ্ঞতার মুখোমুখিতে আজও নারী শিক্ষা সর্ব মানুষের কাছে কি অবারিত? এখনো বিশ্ব প্রতিবেদনে বাল্যবিয়ের অবস্থানে বাংলাদেশ একেবারে শীর্ষে। যেখানে অপরিণত বিয়ে ব্যবস্থাই ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না সেখানে নারী শিক্ষা নয় বরং শিশুকন্যা শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের কতখানি উজ্জীবিত করছে সেটা বাস্তব প্রেক্ষাপটে এক অনধিগম্য কঠিন রাস্তা। শুধু তাই নয় বেগম রোকেয়ার অক্লান্ত প্রচেষ্টা আর নিরবচ্ছিন্ন কর্মযোগে ১৯১৭ সালে স্কুলটি মধ্য ইংরেজি গার্লস স্কুল আর ১৯৩১ সালে উচ্চ ইংরেজি গার্লস স্কুলে নতুন সময়ের অনুগামী হওয়া এই কৃতী শিক্ষাবিদের অনন্য সাধনযজ্ঞ। শুধু যে সামাজিক মহান কর্মযোগের আবহ তৈরিতে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখে যাচ্ছেন তা কিন্তু নয়, বরং জন্মগতভাবে সৃজনী প্রতিভার বিকশিত রূপও নারী জাতির জন্য পরম এক অলঙ্কার। প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতা ‘পালন করে সৃষ্টি দ্যোতনার অপার মহিমায় নিজেকে যেভাবে ‘লড়াকু আর সমৃদ্ধ করেছেন সেটা উপমহাদেশীয় এক অভাবনীয় দৃষ্টান্ত। মতিচুর, সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী গ্রন্থসমূহ সৃজনকল্পের অবারিত সম্ভার। সেখানে সমসংখ্যক নারীই ঘটনার মূল কেন্দ্রে বর্ণিত, উপস্থাপিত এবং সামনে এগিয়ে চলার পথ নির্দেশনা তো বটেই। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি এমন মহিমান্বিত নারী শক্তির জন্ম আর তিরোধান দিবসকে। যিনি আসলেই মুছে কিংবা শেষ হওয়ার মতো একেবারেই নন। নারী শিক্ষার বিষয় এলেই সবার আগে তাঁর নামই চলে আসা যুগ, সময়ই শুধু নয় আধুনিকতারও পরম নির্দেশনার বরমাল্যে অলঙ্কৃত।
জাফরান