ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১

সাহসী এক সম্পাদক

মোয়াজ্জেমুল হক

প্রকাশিত: ২১:০০, ২৮ আগস্ট ২০২৪; আপডেট: ১১:৫৪, ২৯ আগস্ট ২০২৪

সাহসী এক সম্পাদক

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ দৈনিক জনকণ্ঠের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী গ্লোব-জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের (জিজেএসপি) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্দেশনা, পরামর্শে দৈনিক জনকণ্ঠে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে। তাঁর কাছ থেকে জেনেছি অনেক। সমৃদ্ধ করেছে আমার জানার ভা-ার। সাহস কাকে বলে তিনি ছিলেন তার অন্যতম একটি প্রতীক।

আপোসহীন সাহসী এই সম্পাদক যিনি জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত ভয়কে জয় করতে ভালোবাসতেন। জনকণ্ঠের সূচনালগ্ন থেকে তিনি ওই সময়ের চলমান স্রোতের বিপরীতে এগিয়েছেন। তাঁর সাহসে বলীয়ান হয়ে আমরা সংবাদকর্মীরাও এগিয়েছি। তিনি খুলে দিয়েছিলেন বহুমাত্রিক সাংবাদিকতার দুয়ার। অসীম সাহসী জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানের আজ ৭৩তম জন্মবার্ষিকী।

জনকণ্ঠের ঊষালগ্ন থেকে যুক্ত হয়েছিলেন বর্ষীয়ান সাংবাদিক স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠযোদ্ধা তোয়াব খান। তিনি ছিলেন উপদেষ্টা সম্পাদক। যাঁকে সম্পাদকদের সম্পাদক বলে আখ্যায়িত করা হয়। আতিকউল্লাহ খান মাসুদের পরামর্শ নিয়ে তোয়াব খান জনকণ্ঠের প্রতিটি বিভাগ সাজিয়েছিলেন আধুনিকতার ছোঁয়ায়। পাঠক লুফে নেয় এমন রিপোর্ট, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয়, বরেণ্য লেখকদের মতামতভিত্তিক বিশেষ লেখাসহ বিষয়মূলক আলাদা আলাদা পৃষ্ঠা নিয়ে জনকণ্ঠকে সাজানো হয় আকর্ষণীয়ভাবে।

সাংবাদিকদের হাত খুলে সত্য লেখার সুযোগ করে দিয়েছিলেন সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ। সত্য রিপোর্ট প্রকাশের কারণে তোলপাড় যেমন হয়েছে, তেমনি মামলার বেড়াজালও কম সৃষ্টি হয়নি। মামলা ও ভয়ভীতির বিপরীতে উল্টো তিনি সাংবাদিকদের সাহস যুগিয়ে গেছেন। আইনি লড়াই চালিয়ে কুচক্রী মহলের চক্রান্ত নস্যাৎ করেছেন। জনকণ্ঠ তাঁর কাছে ছিল নাড়িছেঁড়া ধনের মত। দেশে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতায় নতুন যুগের সৃষ্টিকারী তিনিই।
রণাঙ্গনের সম্মুখ সমরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিকউল্লাহ খান মাসুদ এ দেশের সংবাদপত্র জগতের বহুল আলোচিত ব্যক্তিত্ব। ১৯৯৩ সালে দৈনিক জনকণ্ঠের জন্মলগ্ন থেকে সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে টানা ২৮ বছর সাহসিকতার সঙ্গে তা পালন করে গেছেন। ‘নীতির প্রশ্নে আপোষহীন’ স্লোগানে দৈনিক জনকণ্ঠকে প্রচারে সর্বশীর্ষে পৌঁছাতে সক্ষম হয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান, বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে মানুষের কর্মক্ষেত্র সৃষ্টির পাশাপাশি পণ্যের উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রমের বিস্তার এবং ওই সময়ের সর্বোচ্চ প্রযুক্তির সন্নিবেশে দেশের বিভাগীয় শহর থেকে একযোগে দৈনিক জনকণ্ঠের প্রকাশনা ও প্রচারের দুঃসাহসিক কার্যক্রমের উন্মেষ তিনি ঘটিয়েছিলেন। বিশে^র উন্নত দেশগুলোতে এ ব্যবস্থা থাকলেও বাংলাদেশে তিনিই প্রথম এর উদ্যোক্তা ও বাস্তবায়নকারী। আজ তাঁর জন্মদিনে বলতে হয়, একজন আতিকউল্লাহ খান মাসুদের জন্ম ও জীবন স্বার্থক। সাফল্যের জান্ডাই উড্ডীন।  
তাঁর প্রতিষ্ঠিত দৈনিক জনকন্ঠ শুধু একটি নাম নয়, স্বাধীনতার স্বপক্ষের বজ্রকঠিন শপথের অন্যতম একটি শক্তি। এছাড়াও ধর্মান্ধ, ফতোয়াবাজ, প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের ভিতে কুঠারাঘাতকারী একটি মুখপত্র। ১৯৯৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আগে এমন দুরূহ কাজে প্রত্যক্ষভাবে এগিয়ে আসার ব্যতিক্রম ঘটনা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের চিন্তা-চেতনার নীতি আদর্শ লালনকারী ও বিশ^াসীদের যখন কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল ঠিক তখন জনকণ্ঠের আত্মপ্রকাশ। তার লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিকে নবউদ্দোমে জাগিয়ে তোলা। স্বাধীনতা বিরোধীসহ প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তির বিরুদ্ধে কলম যুদ্ধ এগিয়ে নেয়া।
আতিকউল্লাহ খান মাসুদ জন্মেছিলেন মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ের খান বাড়িতে। শিক্ষাজীবন ঢাকাতে। স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের আগেই তিনি ব্যবসা বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এর পাশাপাশি দেশের ক্রীড়া জগতেও রয়েছে তাঁর অনবদ্য ভূমিকা। সর্বশেষ তাঁর সফল উদ্যোগ প্রকাশনা জগতে। দৈনিক জনকণ্ঠের জন্ম ও উত্থানে সফলতার কাণ্ডারি সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ। তিনি শুধু এ শিল্পগ্রুপের জন্য নয়, মিডিয়া জগতেও অমর হয়ে আছেন, থাকবেন। জীবদ্দশায় তাঁর সান্নিধ্যে যারা এসেছেন তাঁরা অভিন্ন সুরেই বলতে বাধ্য যে, তিনি কত সাহসি ও স্বাপ্নিক ছিলেন। 
দৈনিক জনকণ্ঠের জন্ম হয়েছিল দেশের পাঁচ বিভাগীয় শহর থেকে একযোগে এবং একইদিনে। এমন দুঃসাহসিক ও জটিল কাজের স্বপ্ন নিয়েই তাঁর সফল অভিযাত্রা। দেশের বাইরে থেকেও জনকণ্ঠ প্রকাশের চিন্তা ভাবনা করেছিলেন। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে তিনি আর এগোননি। তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি।
দৈনিক জনকণ্ঠকে প্রচারের শীর্ষে পৌঁছে দিতে সক্ষম হলেও তিনি নিজে ছিলেন প্রচারবিমুখ। প্রচার বিমুখতা তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম একদিক। কর্মযোগী এ মানুষটি তাঁর জীবনের শেষ দিনটিতে ছিলেন কর্মে, নিবিষ্টমনে। রাশভারি, স্পষ্টভাষী সিংহ হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন আতিকউল্লাহ খান মাসুদ। এ শিল্প গ্রুপের সঙ্গে জড়িত সকলেই তাঁকে ‘স্যার’ সম্বোধন করতেন। তাঁর অধীনে কাজ করতেন এমন প্রবীণ ও খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিদের তিনি ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন।

জুনিয়রদের স্নেহের আবেশে জড়িয়ে রাখতেন। যে কোনো উল্লেখযোগ্য বিষয় নিয়ে জুনিয়রদের সঙ্গেও সরাসরি কথা বলতেন। জেনে নিতেন ঘটনার আদ্যেপান্ত। ভুল ত্রুটিকে সর্বদা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখতেন। তাঁর অধীনে চাকরি পাওয়া যেমন কঠিন ছিল, তেমনি ফাঁকি দিয়ে চাকরি করাটাও সহজ ছিল না। সহকর্মীদের ভালোবাসতেন মনের গভীর থেকে। তিনি বুঝতেন সহকর্মীদের ভীতিতে রেখে ভালো কাজ আদায় করা যায় না।

যে কারণে জনকণ্ঠের সূচনালগ্ন থেকে আমিসহ অনেকেই অদ্যাবধি এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত আছি। অনেকে অবসরে গেছেন। কেউ কেউ অন্যত্র চলেও গেছেন। যারা গেছেন তাদের বেশিরভাগই তাদের কর্মজীবনে সফলতায় ঝা-া উড়িয়ে চলেছেন। তারা সকলেই নিশ্চয়ই জনকণ্ঠের সংক্ষিপ্ত বা দীর্ঘ সময়ের সফলতার জাবর কাটেন। জনকণ্ঠের সঙ্গে জড়িত হয়ে খ্যাতিমান দুই সাংবাদিক একুশে পদকও অর্জন করেছেন। 

জন্মিলে মৃত্যুর স্বাধকে আলিঙ্গন করতেই হবে। আমরা যারা এখনও বেঁচে আছি তাদেরও কঠিন সেই শেষ যাত্রায় সামিল হতেই হবে। এর কোনো ভিন্নতা হবে না। কেউ যাবেন পরিণত বয়সে। কেউ অপরিণত সময়ে। কিন্তু মরেও অমর হয়ে থাকা ক’জনের ভাগ্যে হয়। আতিকউল্লাহ খান মাসুদ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন আকস্মিক। কোনো জটিল রোগব্যাধি ছাড়াই। তিনি অমরত্ব লাভ করেছেন। এটা তাঁর কর্মেরই স্বীকৃতি। এটা কেউ প্রদান করেনি। এটা তাঁকে নিয়ে গেছে সর্বোচ্চ মর্যাদায়।

তাঁর মৃত্যুতে ওই সময়ের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের উচ্চপদের অনেকেই শোক জানিয়েছেন। সংসদে গ্রহণ করা হয় শোক প্রস্তাব। এতে মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনে সম্মুখ সমরের যোদ্ধা হিসেবে আতিকউল্লাহ খান মাসুদের দেশ গঠনের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। একদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধা, অন্যদিকে দেশে শীর্ষপর্যায়ের শিল্পোদ্যোক্তা এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে বলীয়ান করতে আতিকউল্লাহ খান মাসুদের সম্পাদনায় জনকণ্ঠের সাহসী ও অনবদ্য অবস্থানের প্রশংসা করা হয়।
আতিকউল্লাহ খান মাসুদ আড়ালে আবড়ালে নয়, যে কোনো অবস্থায় সত্য বলতেই প্রত্যয়ী থাকতেন। এটাই ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম একটি দিক। তবে মাঝে ক্ষমতার মোহ কোনোদিন ছিল না। পত্রিকাকে ব্যবহার করে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করেননি। সহজ কোনো পথ দিয়ে কাড়ি কাড়ি অর্থ হাতানোর কোনো লোভ লালসাও ছিল না। প্রচলিত সব নিয়মকানুন মেনেই তিনি তাঁর বাণিজ্যিক ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিয়ে সফলতার শীর্ষে পৌঁছেছেন।

তিনি সহকর্মীদের কাছে নিজেকে ‘কামলা’ নামেই অবহিত করতেন। তীক্ষ্ণ মেধার এই মানুষটির বিশালাকার একটা অন্তর ছিল। যে কারণে তিনি নিজ গ-ি পেরিয়ে ক্রীড়া জগৎ ছাড়াও খ্যাতিমান অথচ আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল এমন গুণীদের মাস মাস সাহায্য দিয়ে পাশে থেকেছেন। ঢাকায় তীব্র যানজট নিরসনে তাঁর চিন্তা ভাবনায় প্রণীত কিছু পরামর্শ দিয়ে তা সরকারি পর্যায় থেকে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। 
দিবারাত্রির অধিকাংশ সময় তিনি এ শিল্প পরিবারের ইস্কাটনের জনকণ্ঠ ভবনেই কাটাতেন নানামুখী কর্ম নিয়ে। বাসায় গিয়ে গভীর রাত অবধি জনকণ্ঠের প্রকাশিতব্য বিভিন্ন বিষয়ে খবরাখবর নিতেন। তাঁর এসব কর্মকা-ের ব্যস্ততা নিয়ে সহকর্মীদের সকলেই হতবাক থাকতেন। আসলে তিনি ছিলেন কর্মযোগী, ওয়ার্কোহলিক (কাজপাগল)। এ কারণেই স্বল্প পুঁজিতে গড়া তাঁর প্রতিষ্ঠানকে সাম্রাজ্যে পরিণত করতে সক্ষম হন।

তিনি গ্লোব-জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের ধ্রুবতারা। তাঁর জীবনজুড়ে রয়েছে ত্যাগ, পরিশ্রম কঠোরতম সাধনা। ২০২১ সালের ২২ মার্চ সৃষ্টির অমোঘ নিয়মে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে তিনি পরপারের বাসিন্দা হয়েছেন। মহান রাব্বুল আলামিন তাঁকে বেহেস্তে নসিব করুন। এই উদ্যোমী, কর্মবীরের বিদেহী রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। প্রয়াত সম্পাদকের জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা।  
লেখক : যুগ্ম সম্পাদক, জনকণ্ঠ

×