ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩০ ভাদ্র ১৪৩১

মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ ॥ জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

সংবাদপত্র আকাশের ধ্রুবতারা 

ওবায়দুল কবির

প্রকাশিত: ২০:৫৭, ২৮ আগস্ট ২০২৪; আপডেট: ১১:৫০, ২৯ আগস্ট ২০২৪

সংবাদপত্র আকাশের ধ্রুবতারা 

মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ

জনকণ্ঠে নানা উপলক্ষে উৎসব লেগেই থাকত। কারণে-অকারণে উৎসব। ফ্যামিলি ডে, বিশ্বকাপ ফুটবল ও ক্রিকেট, জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী, কারো পুরস্কার পাওয়া ইত্যাদি ছিল উৎসবের উপলক্ষ। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও দীর্ঘ মেয়াদে উৎসব হতো বিশ্বকাপ ক্রিকেট এবং বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে। টুর্নামেন্ট চলাকালে জনকণ্ঠ থাকত সরগরম। প্রতিদিন হতো লটারি। কে জিতবে, কে হারবে এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক। যোগ দিতেন অন্যান্য বিভাগের সাংবাদিকরাও। এমনকি খোদ সম্পাদক এই লটারিতে শরিক থাকতেন।

লটারির নিয়ম ছিল খেলার আগের দিন কোন্ দল জিতবে এর আগাম ধারণা দেয়া। ছোট্ট কাগজে লিখে একটি বাক্সে ফেলা হতো। খেলার আগে বন্ধ হয়ে যেত বাক্সের মুখ। খেলা শেষ হওয়ার পর বাক্স খুলে স্লিপ দেখে পয়েন্ট যোগ করা হতো। আমাদের প্রিয় সম্পাদক প্রতিদিন কাউকে দিয়ে তাঁর স্লিপটি বাক্সে ফেলতেন। একবার বিশ^কাপ ফুটবলে তিনি পয়েন্ট তালিকায় নিচের দিকে চলে গেলেন।

রাতে রিপোর্টিং বিভাগে এসে বললেন, ‘আজ থেকে এই স্লিপ লেখককে বহিষ্কার করলাম।’ নতুন আরেকজনকে নিয়োগ দেয়া হলো। এ নিয়ে কি হৈচৈ কা-। হাসি ঠাট্টায় জমজমাট। বিশ^কাপ টুর্নামেন্ট শেষে সবচেয়ে বেশি পয়েন্টের অধিকারীকে পুরস্কার দেয়া হতো। পুরস্কার বিতরণ উপলক্ষে হতো ফ্যামিলি ডে। অনুষ্ঠান হতো কখন অফিসের বাইরে কোন রেস্টুরেন্ট বা মিলনায়তনে। কখনও আবার জনকণ্ঠ ভবনের টপ ফ্লোরে। আমাদের প্রিয় সম্পাদক থাকতেন সপরিবারে। আনন্দ-উৎসবে কেটে যেত সারাদিন। এমনই ছিলেন আমাদের প্রিয় সম্পাদক।
কাজের সময় কাজ। বাকি সময় আনন্দে উচ্ছ্বাসে ভরিয়ে রাখতেন গোটা অফিস। সম্পাদক, উপদেষ্টা সম্পাদক এবং সাংবাদিকদের জন্মদিন পালন হতো। তেমন কোন আনুষ্ঠানিকতা নয়, একটু ফুল দেয়া, কেক কাটা এবং ছবি তোলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত অনুষ্ঠানমালা। প্রিয় সম্পাদক আগ্রহের সঙ্গে এসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন, নিজ হাতে কেক কেটে বিতরণ করতেন। নিজ দফতরে কাজ শেষে রাত ৮টার পর তিনি নিচে নেমে আসতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, মন ভাল থাকলে কাজও ভালো হয়।

কাজের জন্য চাই আনন্দঘন পরিবেশ। বিশেষ করে সংবাদপত্র কায়িক পরিশ্রমের কাজ নয়। এই ক্রিয়েটিভ কাজে মন ভালো থাকা জরুরী। সম্পাদক নিজে যখন সবার মন ভালো রাখার দায়িত্ব নেন, তখন সবার মন ভালো না থাকার উপায় থাকে না। এই দিক থেকে জনকণ্ঠ সকল পত্রিকা থেকে আলাদা। জনকণ্ঠে কাজের পরিবেশ সবচেয়ে ভাল এটি সর্বজন বিদিত। শেষ দুই বছর ছিল একটু ব্যতিক্রম।

কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় তার রুটিনে এসেছিল কিছু পরিবর্তন। তবুও সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজের রুটিনে কোন পরিবর্তন হয়নি। পত্রিকার দ্বিতীয় এডিশন দেখেই তিনি ঘুমাতে যেতেন। আজ ২৯ আগস্ট প্রয়াত সম্পাদক, বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিকউল্লাহ খান মাসুদের জন্মদিন।

বিক্রমপুরের লৌহজং উপজেলার উত্তর মেদেনীম-ল গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান তিনি। ১৯৫১ সালের ২৯ আগস্ট তিনি জন্মগ্রহণ করেন ভারতের বর্তমান মিজোরাম প্রদেশের লাংলী জেলার ডিমাগীরী নামক স্থানে। পিতা মোহাম্মদ দবির উদ্দিন খান চাকরি করতেন ভারতীয় বন বিভাগে। চাকরি সূত্রে সপরিবারের থাকতেন ওখানে। দেশ ভাগের কয়েক বছর পর চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে আসেন স্বদেশে। ৮ ভাইবোনের মধ্যে সপ্তম তিনি।

১৯৭৬ সালে তিনি বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন শামীমা এ খানের সঙ্গে। দুই পুত্র মিশাল এ খান এবং জিশাল এ খান। ২০২১ সালের ২২ মার্চ তিনি চলে যান পৃথিবীর সকল মায়া ত্যাগ করে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বগাথা রচনা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের অংশই হয়ে ওঠার পাশাপাশি রেখে গেছেন অনেক অমর কীর্তি। বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতের যুগান্তকারী পরিবর্তনের অগ্রধা দৈনিক জনকণ্ঠ তাঁরই সৃষ্টি। ছিলেন সংবাদপত্র আকাশের ধ্রুবতারা। তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছেন গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবার।

সকাল ১১টায় প্রতদিন অফিসে ঢুকে একের পর এক ব্যবসায়িক বৈঠক। মাঝে মধ্যেই ছিল দর্শনার্থীদের সাক্ষাৎকার। বিকেলের দিকে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে আবার চলত বিরামহীন কাজ। সন্ধ্যার পরের সময় পুরোটাই পত্রিকার জন্য। কোথায় কি ঘটছে জানা এবং জানানো। কোন ঘটনা বাদ পড়ছে কিনা সতর্ক থাকা। পরদিন পত্রিকায় কি নিউজ যাচ্ছে এ নিয়ে সাত তলায় উপদেষ্টা সম্পাদকের সঙ্গে আলোচনা।

রিপোর্টার-ফটোগ্রাফারদের সঙ্গে আলোচনা শেষে বাসায় ফিরলেও জনকণ্ঠের সঙ্গে থাকত সার্বক্ষণিক যোগাযোগ। প্রথম এডিশন পত্রিকা দেখে কোথাও কোন ভুলভ্রান্তি থাকলে তা ঠিক করা। রাতে কোন ঘটনা ঘটলে প্রধান প্রতিবেদক এবং ফোটোগ্রাফারের সঙ্গে ফোনে কথা বলে প্রয়োজনীয় নির্দেশ  দেয়া। দ্বিতীয় এডিশনে কি নিউজ যাচ্ছে, কোন্টা বাদ দেয়া হবে, সবই হতো তাঁর নির্দেশনায়। দ্বিতীয় এডিশন পত্রিকা দেখে গভীর রাতে তিনি ঘুমোতে যেতেন।

এর বাইরে গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের সকল খুঁটিনাটি বিষয় তিনি অবহিত থাকতেন। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এসব কাজে তাঁর কোন ক্লান্তি ছিল না। অফিস ছিল তাঁর প্রাণশক্তি। মৃত্যুর আগের দিনও তিনি সারাদিন অফিস করেছেন, সকল রুটিন কাজ সেরেছেন। জনকণ্ঠের শেষ এডিশন দেখে ঘুমাতে গেছেন।
জনকণ্ঠ বের হওয়ার সময় তিনি ছিলেন আপাদমস্তক ব্যবসায়ী। একের পর এক সফল ব্যবসার পর সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্বশীলতা থেকে তিনি আসেন পত্রিকা জগতে। একাধিকবার তিনি এ কথা আমাদের বলেছেন। ব্যবসার ক্ষেত্রে তিনি যা করেছেন, তাও ছিল দেশে প্রথম। গ্লোব ছিল এই দেশে প্রথম যথার্থ মশার কয়েল। এক সময় মোটরসাইকেল বলতে যেমন হোন্ডা ব্র্যান্ডই বোঝাত, তেমনি মশার কয়েল বলতে বোঝাত গ্লোব।

দোকানে গিয়ে মানুষ মশার কয়েল না বলে গ্লোবই চাইতেন। এই দেশে আয়োডিনযুক্ত সাদা লবণ বাজারে এনেছিলেন তিনিই প্রথম। কম মূল্যে আবাসন, গ্লোব মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ, গ্লোব ক্যাবল, গ্লোব খামার ইত্যাদি তিনি স্থাপন করেছিলেন। এর মধ্যে সবচেয়ে সাহসী সিদ্ধান্ত ছিল দেশের পাঁচ জায়গা থেকে পত্রিকা বের করার চ্যালেঞ্জ। তিনি সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন এবং সফল হয়েছেন। সাংবাদিকতা জগতের আরেক কিংবদন্তি তোয়াব খানকে সহযাত্রী পেয়ে তাঁর এই দুঃসাহসিক অভিযাত্রা সহজ হয়েছিল।
প্রথম দিকে তিনি প্রত্রিকার জন্য সময় দিতেন কম। নীতিনির্ধারণী কিছু বিষয়ে তাঁর ভূমিকা থাকলেও বেশি সময় দিতেন মূল প্রতিষ্ঠানে। তখন মতিঝিল এল্লাল চেম্বারে ছিল তাঁর অফিস। জনকণ্ঠ ছিল ৫৫, মতিঝিল।  ধীরে ধীরে তিনি জড়িয়ে পড়েন সাংবাদিকতায়। বিশেষ করে জনকণ্ঠ ভবন প্রতিষ্ঠা এবং মতিঝিল থেকে ইস্কাটনে সকল অফিস স্থানান্তরের পর তিনি জনকণ্ঠের জন্য সময় বাড়িয়ে দেন।

বোঝার চেষ্টা করেন সাংবাদিকতার খুঁটিনাটি। জনকণ্ঠে চালু করেন তাঁর বিখ্যাত কলাম ‘সাধু সাবধান’। এই কলামের মাধ্যমে তিনি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন সমাজ এবং রাষ্ট্রের অসঙ্গতি ও ভুলভ্রান্তি। ব্যবসায়ী পরিচয়ের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠা পাওয়া শুরু করেন সাংবাদিক হিসেবে। যোগ দিতে থাকেন সাংবাদিকদের অনুষ্ঠানগুলোতে। এক সময় হয়ে ওঠেন পুরোদস্তুর সাংবাদিক। সদস্য হন সাংবাদিকদের পেশাগত প্রতিষ্ঠান জাতীয় প্রেসক্লাবের। ক্রমশ তাঁর কাজের গ-ি বাড়তে থাকে। দায়িত্ব পালন শুরু করেন সম্পাদক পরিষদ কিংবা নিউজ পেপার ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনে  (নোয়াব)।
সেদিন ছিল সোমবার, ২২ মার্চ। সকাল ৭টায় অপ্রত্যাশিত ফোন পেলাম, আমাদের প্রিয় সম্পাদক আর নেই। টেলিফোনের সংবাদে সবকিছু শূন্য হয়ে গেল। সমাপ্ত হয়ে গেল দীর্ঘ ২৮ বছর একসঙ্গে সুখ দুঃখের পথচলা। বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠল, শূন্য হয়ে গেল সব। যৌবনের সবটুকু কেটেছে এই মানুষটির সঙ্গে। লেখাপড়া শেষ করে সেই যে তার হাত ধরে জনকণ্ঠে ঢুকেছি, এখন প্রৌঢ়ত্ব। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নায় কেটেছে এতটা সময়।

প্রতিষ্ঠানের অনেক উত্থান-পতনেও ছেড়ে যাওয়া হয়নি এক অদৃশ্য বন্ধনে। ২৮ বছরের কথা ঘটনা, কত কথকতা। আজ তাঁর জন্মদিনে পরম করুণাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রার্থনা, আমাদের প্রিয় সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদকে বেহেস্তের শ্রেষ্ঠতম স্থানে অধিষ্ঠিত করুন।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, জনকণ্ঠ

×