ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের হাওড়ে একবেলা

সাইফুল লিমন

প্রকাশিত: ০১:৫৬, ১৪ জুন ২০২৪

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের হাওড়ে একবেলা

কবি জীবনানন্দ দাসের জননন্দিত পঙ্ক্তি

কবি জীবনানন্দ দাসের জননন্দিত পঙ্ক্তি“‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর’ কিংবা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বহুল শ্রুত গানের লাইন ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে-আমার জন্মভূমি।’ কবিদ্বয়ের এই পঙ্ক্তিমালা এবার আমার কাছে আবার নতুন করে ধরা দিল।

সবুজ বৃক্ষ-লতা-পাতায় ঢাকা ছায়া সুনিবিড় বাংলার সমতল ভূমির বুক চিরে আবহমান কাল ধরে বয়ে চলা শত নদীর নীরব কোলাহল, নদীমাতৃক জীবন ও জীবিকা, সিলেট চট্টগ্রাম অঞ্চলের সুউচ্চ পাহাড়ি অরণ্য কিংবা চা বাগান ও জনপদের বিচিত্র জীবন ও সংস্কৃতি, দক্ষিণে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ম্যানগ্রোভ বন ও জীববৈচিত্র্য, দক্ষিণে অবারিত নীলাভ সমুদ্র; এইতো বাংলার রূপ যা দেখে মুগ্ধ আমাদের কবিকুল ও পর্যটক বন্ধুরা।

তবে আমার প্রিয় জন্মভূমির এই সকল রূপ নয়, দেখেছি অন্যরকম নয়নাভিরাম এক গ্রাম বাংলা যার দিগন্তের কোথায় সমাপ্তি ঘটেছে কেবল জ্ঞানের ধারণায় অনুমান করা যায় কিন্তু চর্মচক্ষু দ্বারা এর সীমা টানা অসম্ভব। যতদূর আঁখি গোচর হয় শুধু ততটুকু নয় বরং আরও অনেক দূর পর্যন্ত কখনো ঢেউ খেলানো সবুজ ধান খেত, কখনোবা পাকা সোনালি ধানের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ আবার কখনো তীরহারা সুবিশাল জলরাশির বুকে উথলে ওঠা নৌকার নাচের সঙ্গে মাঝির ভাটিয়ালি গান।
‘হাওড়’ গ্রাম বাংলার আরেকটি প্রাকৃতিক রূপ। মনোমুগ্ধকর এই রূপ উপভোগ করতে হলে যেতে হবে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত কিশোরগঞ্জ জেলার ঘোরাওত্রা ¯্রােতস্বিনী দুই তীর বিস্তৃত করে থাকা নিকলি, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলা; ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলার তিতাস নদীর তীরঘেঁষা নাসিরনগর উপজেলা, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলার কিছু অংশে। তবে আমার সৌভাগ্য হয়েছে কিশোরগঞ্জ জেলায় অবস্থিত সুবিশাল হাওড় ভ্রমণের।

এই ভ্রমণটি আমি যেমন উপভোগ করেছি তেমনি অভিজ্ঞতার ঝুলিতেও অনেক কিছু তুলতে পেরেছি। ঢাকা-সিলেট সড়ক পথে মেঘনা নদীর তীরে অবস্থিত ভৈরব একটি গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা যা কিশোরগঞ্জ জেলার অন্তর্গত এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের জন্মস্থান ও সংসদীয় আসন। ঢাকা, সিলেট অথবা চট্টগ্রাম যেখান থেকেই আসেন আপনাকে প্রথমে এই ভৈরব উপজেলায় আসতে হবে। আমি এখান থেকে ময়মনসিংহগামী একটি বাসে উঠলাম।

কিশোরগঞ্জ শহরের দিকে প্রায় ২০ কিলোমিটার আসার পর আগরপুর নামক বাসস্ট্যান্ডে নেমে পড়লাম। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে ৩৫ মিনিটে এই জেলারই আরেকটি উপজেলা বাজিতপুরের পাটুলি ফেরিঘাটে আসলাম। মাঝখানে ভাগলপুর নামক একটি স্থান আছে। কাগজে কলমে এটি গ্রাম হলেও দেখে মনে হবে পরিপূর্ণ একটি শহর। স্বনামধন্য জহুরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ যার পুরো চত্বর সুপরিকল্পিত সবুজ বাগানে ঢাকা। শুধু সৌন্দর্য নয়, আশপাশের জেলার মানুষের কাছে এর সেবারও জুড়ি নেই। বিশাল নদী ও তাকে ঘিরে মানুষের কর্মব্যস্ততা দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়ি।

ফেরি বোঝাই করা যানবাহন। খেয়া নৌকায় মানুষের ভিড়। নৌকাটি আকারে বেশ বড় হলেও মানুষ ও মালামাল বেশি বোঝাই করার কারণে নৌকাটিকেই ছোট মনে হচ্ছিল। ভয়ে আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার উপক্রম। কারণ নদীতে ¯্রােতের তীব্রতার সঙ্গে মাঝারি ধরনের ঢেউ ছিল এবং আমি অনেকটা সুকুমার রায়ের কবিতার সেই বাবুর মতো। ইঞ্জিনে ভর করে ভটভট শুব্দ তুলে নৌকা ছাড়ল। বাতাস আর ঢেউ কেটে আমাদের খেয়া নৌকা দ্রুততার সঙ্গে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল। ঢেউগুলো নৌকার গলুয়ের নিচে আছড়ে পড়ছিল আর পলি মিশ্রিত সাদা পানি দুই পাশে ছিটকে পড়ছিল।

পানি আর নৌকার আঘাতে সৃষ্ট ছলাৎ ছলাৎ শব্দের ঝংকার আমার মনে ছন্দের অনুভূতি তৈরি করেছিল। ওপার থেকে আসা যানবাহন বোঝায় ফেরি আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। দানব আকৃতির বালু ভর্তি বাল্কহেড যার প্রায় পুরোটা পানির নিচে লুকিয়ে থাকে, আমাদের নৌকাকে অতিক্রম করার সুযোগ করে দিল। নৌকায় বেশ কিছু পর্যটক ছিল। তারা সবাই ছবি তোলা অথবা ভিডিও করায় ব্যস্ত ছিল। তাদের দেখে আমিও সংক্রমিত হলাম। মাঝিভাইকে নদীর নাম ও এর গভীরতা জিজ্ঞেস করলাম। ‘ঘোরাউত্রা, আর এইহানে ৫০/৬০ ফুট পানি অইব’ মাঝিভাই উত্তর দিল। নদীর উত্তর ও পূর্ব দিকে যতদূর চোখ যায় দিগন্ত বিস্তৃত শুধু খোলা মাঠ। প্রায় পনেরো মিনিট নৌভ্রমণ শেষে আমরা ঘাটে ভিড়লাম। চারদিকে কোনো লোকালয় নেই, বিস্তৃত ধানখেত ও তৃণভূমি। ঘাটে কয়েকটা সিঙ্গাড়া পুরির দোকান; হাওড়ের মাছের তরকারির সঙ্গে ভাতও পাওয়া যায় এখানে। প্রচ- গরম; মুঠোফোনে তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সে: দেখাচ্ছে। খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে ও  ঠান্ডা পানীয় খেয়ে একটি  মোটরসাইকেল ভাড়া করে উঠে পড়লাম অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্টের উদ্দেশ্যে। যাওয়ার পথে হাওড় পাড়ের মানুষের কর্মব্যস্ততা লক্ষ্য করলাম। রাস্তার দু’পাশে খালি মাঠে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের ধুম। প্রযুক্তির কল্যাণে ধান এখন মেশিনে মাড়াই করা হয়। আবার এক ধরনের দানবাকৃতির মেশিন কয়েক বছর ধরে কৃষক-কৃষাণির কাজকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। ধান কেটে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ধান মাড়াই হয়ে যায়। বড় ট্রাক্টরে করে লোকালয়ে খুব সহজে নিয়েও আসে। ধানের খড় স্তূপ করে রাখা হয়েছে, শিশু-কিশোররা এর ওপর লুটোপুটি খাচ্ছে দেখে আমার শৈশবের কথা মনে উঁকি দিয়ে উঠল। প্রায় বিশ মিনিট পর সেই কাক্সিক্ষত জিরো পয়েন্টে পৌঁছলাম। নান্দনিক জাহাজের ভাস্কার্য স্থাপন করা হয়েছে তিন রাস্তার মাঝখানে। বেশ প্রশস্ত রাস্তার একটি সোজা অষ্টগ্রাম অপরটি হাতের বায়ে মিঠামইন ও ইটনার দিকে চলে গেছে। পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন উপলক্ষে মিঠামইন পর্যন্ত ১৪ কিমি পিচঢালা রাস্তার কালো ক্যানভাসে রং-তুলির ছোঁয়ায় রঙিন হয়ে উঠেছে। সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলার ছাড়াও গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে বিশে^ও দীর্ঘতম আল্পনার রেকর্ড তৈরি করার জন্য রং-তুলির এই বিশাল নান্দনিক ব্যবহার করা হয়েছে। সদ্য সাবেক হওয়া মহামান্য রাষ্ট্রপতির উদ্যোগে এই তিন উপজেলায় অবস্থিত হাওড়ের বুকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘অল ওয়েদার রোড’ নির্মাণ করা হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে দেশবাসীর নিকট এই জনপদের দৃষ্টি আকর্ষিত হয় ও আলোচনার জন্ম দেয়। দৃষ্টিনন্দন এই রাস্তার সৌন্দর্য দেখার জন্য প্রতিদিন পর্যটকদের পদচারণায় মুখর থাকে এই হাওড় অঞ্চল। এ বছর হাওড়ে পানি এখনো না আসায় কৃষকরা হাসিমুখে সোনার ধান খুব সহজে ঘরে তুলতে পারছে। এবার পালনকর্তার কৃপায় ধানের ফলন খুবই ভালো হয়েছে। আর কিছুদিন পর বর্ষাকালে বৃষ্টির সঙ্গে যখন উজানের পানি আসতে শুরু করবে তখন শুকনো এই হাওড় বিশাল জলরাশিতে ফেঁপে উঠবে; অবশ্য এ দৃশ্য নতুন নয়। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে এই সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। তখন অন্যরকম এক সৌন্দর্যের রূপ ধারণ করে এই বিস্তৃর্ণ ভূমি। চারদিকে যখন বিশাল জলরাশির খেলা জমে তখন হাওড় ও এই প্রশস্ত রাস্তা পর্যটকদের আমোদভ্রমণের তীর্থস্থান হয়ে ওঠে। বজরা সাজিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাওড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে আসে ভ্রমণ পিপাসু মানুষ; মেতে ওঠে মেলার আনন্দে। কবির ভাষায়Ñ 
‘এ কি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী-জননী।
ফুলে ও ফসলে কাদা মাটি জলে ঝলমল করে লাবণী।’
তবে বর্ষাকালে এই সুবিশাল সংযোগ রাস্তা নির্মিত হওয়ার আগে হাওড়বাসীর দুঃখ-কষ্টের সীমা ছিল না। বহুমাত্রিক ছিল হাওড়পাড়ের মানুষের দুর্ভোগ। একগ্রাম থেকে অন্যগ্রামে যাওয়ার একমাত্র উপায় ছিল নৌকা। আর শুকনা মৌসুমে কোনো যানবাহন ছিল না। হাওড়ে একটা প্রবাদ আছে ‘বর্ষকালে নাও, শুকনা কালে পাও’। এখন এই প্রবাদ প্রায় উঠে যাচ্ছে। হাওড় থেকে ফসল আনার জন্য মহামান্য সাবমারসিবল রোড করে দিয়েছেন। নতুন ক্যান্টনমেন্ট স্থাপনের কাজ চলমান। বিনোদন ও রাত যাপনের জন্য রয়েছে ‘প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট’ নামে বিলাসবহুল অবকাশ যাপন কেন্দ্র।
হাওড়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, তাদের জীবন-জীবিকা দেশের অন্য জনপদগুলো থেকে ভিন্ন নয়, এই অঞ্চলের মানুষগুলোর প্রধান পেশা কৃষিকাজ ও মাছধরা। তবে নি¤œভূমি হওয়ায় তারা হাওড়ের জমিতে শুধু ধানই ফলাতে পারেন অন্য ফসলে ফলানো তাদের জন্য দুর্ভাগ্য। এই ধান দেশের চাল সংগ্রহে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। বছরে আর ছয় মাস যখন পানিতে পরিপূর্ণ থাকে হাওড় তখন তাদের অকৃপণ হাতে মাছ ধরার সুযোগ করে দেয়। তখন তাদের মূল জীবিকা হয় মাছ ধরা যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশ-বিদেশে রপ্তানি করা হয়। অবশ্য বর্তমান সময়ে বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে মানুষ দেশ-বিদেশে কাজের প্রয়োজনে ছড়িয়ে পড়ছেন।
পরিশেষে বলতে চাই, হাওড়বাসীর জীবন সমতল ভূমির মানুষের মতো এতটা সহজ নয়। তবে এটা বলা যায় সুবিশাল এই রাস্তা হার ফলে তাদের কষ্টকর জীবনযাত্রা সহজ হতে শুরু করেছে। হাওড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে আপনাকে হাওড় সশরীরে পরিদর্শন করতে হবে।

×