ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

এই অরূপ সন্ধ্যার কাছে

অনিকেত সুর

প্রকাশিত: ০১:৫০, ১৪ জুন ২০২৪

এই অরূপ সন্ধ্যার কাছে

অরূপ সন্ধ্যার কাছে

ফাগুনের প্রথম দিন ছিল সেদিন। আরও ছিল ‘ভালোবাসা দিবস’। দুটিই ছিল আমার জন্য কাকতালীয় ঘটনা। আমার আসন্ন সান্ধ্য কর্মকা-ের জন্য এই দিনটিকে সজ্ঞানে বেছে নিই নি। এই সমাপতন দৈবাৎ ঘটে গেছে। সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের বইমেলা ছেড়ে যখন শাহবাগের মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছি, তখন বিকাল প্রায় পাঁচটা। এমন সময় মেলা থেকে দুই বন্ধু ফোন করল। 
বইমেলা চত্বরটা আমার প্রিয় জায়গা। ফেব্রুয়ারি মাস এলে সন্ধ্যা অব্দি সচরাচর ওখানেই কাটাই। অন্য কোনো দিন হলে বন্ধু-আহ্বান ফেরাতে পারতাম না। তবে আজকের দিনের কথা আলাদা। কারণ, তোমার সঙ্গে দেখা করার সময়টা আগে থেকেই স্থির করা আছে। হাতে তোমার অনেক কাজ এবং আমারও অনেক অকাজের ব্যস্ততা। ক’দিন আগে বাহকের মারফত বেশকিছু দামি ঊপহার পাঠিয়েছিলে। একটা শোভন প্রতিক্রিয়ায় আজকের এই সৌজন্য সাক্ষাতের সময় ও স্থান নির্ধারণ করেছি। তাতে তোমার সম্মতি ছিল।   
ফার্মগেটে নিউ স্টার কাবাব রেস্টুরেন্টের দোতলায় জানালার পাশে বসে অপেক্ষা তোমার জন্য। যেখান থেকে রাস্তায় লোকচলাচল ও সড়কে চলমান জীবন সহজে নজরে আসে, রেস্টুরেন্টের এরকম কোনও জায়গায় এককোণে বসা আমার অভ্যাস। সেদিন আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল —- তুমি হেঁটে আসছ, উপর থেকে তাকিয়ে এই প্রিয় দৃশ্য অবলোকন করা। 
তোমার আসতে তখনো পনেরো মিনিট বাকি। “ঠিক সাড়ে পাঁচটায় আসব,” তোমার কণ্ঠটা আগের চেয়ে আরো মিষ্টি, আরো সুরেলা। “ঠিক সাড়ে পাঁচটা!” কথাগুলি হুবহু প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল আমার মনে। হুঁ! কিছু আগে-পরে নয় কেন! 
মেলায়-আসা আমার সদ্য প্রকাশিত বইয়ের একটি কপি সঙ্গে এনেছিলাম তোমাকে দেব ব’লে। সময় কাটাতে সেটিরই পৃষ্ঠাগুলি উল্টে দেখতে শুরু করলাম। যত দেখছিলাম, ততই প্রুফ রীডারের যোগ্যতায় আমার গভীর আস্থা জাগছিল। এক জায়গায় দেখলাম, আমার লেখা ‘কুতূহলী’ শব্দটার বদলে মুদ্রিত হয়েছে ‘কৌতূহলী’।

আরেক পৃষ্ঠায় ‘লোলজিহ্ব’র স্থানে ‘লোলজিহ্বা’। অন্যত্র ‘আলাপচারি’ বাদ দিয়ে ‘আলাপচারিতা’। কবিতায় কোন শব্দের ধ্বনিব্যঞ্জনা কেমন —- মাত্রাসীমা ও কবিতাদেহের অন্তঃছন্দ রক্ষায় এসবের ভূমিকা কী, এ নিয়ে স্মার্ট প্রুফ রীডারের সময় নষ্ট করার সময় একেবারেই নেই। একের পর এক এরকম বেশ কিছু ত্রুটি আমার নজরে এলো। খিঁচড়ে গেল মেজাজ। কিন্তু বিশেষ এই সময়টার মাধুর্য আমি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে চাই। বই বন্ধ ক’রে দিয়ে অতএব 
দৃষ্টি ঘোরালাম নিচে ব্যস্ত সন্ধ্যার আলোকিত সড়কের ওপর। 
গির্জায় প্রার্থনা শেষে যথাসময়ে সড়কের ওপার থেকে ধীরপায়ে হেঁটে এলে তুমি। আর এপারে পৌঁছেই চোখ তুলে তাকালে ওপরে। আমি যেখানটায় বসেছি, একেবেরে ঠিক সেইদিকেই মুহূর্তে তোমার চোখ গেল কী ক’রে, ভেবে খানিকটা অবাক হয়েছিলাম। চোখাচোখি হতেই তোমার ঠোঁটে ফুটে ওঠল মৃদু হাসির রেখা। অমনি একটা অদৃশ্য শক্তিশালী আলোকতরঙ্গ চারপাশের কৃত্রিম আলোকে যেন চমকে দিয়ে প্রবল এক ধাক্কায় সরিয়ে দিল দূরে। সেই অলক্ষিত ঢেউয়ের অভিঘাত এসে লাগল দোতলায় অপেক্ষারত আমার বুকের ভিতর। 
রাজহংসীর মতো তোমার উঁচু গ্রীবা, তোমার অনায়াস অনাড়ষ্ট লঘু হাঁটার ভঙ্গিতে একটা অনমনীয় দৃঢ়তা আর আত্মবিশ্বাস ফুটে বেরোচ্ছিল, এবং সবকিছু মিলিয়ে তোমার রমণীয়তায় এমন একটা মাত্রা যোগ ক’রেছিল যে তোমাকে মনে হচ্ছিল দ্যুলোকের দূতী। ভেবেছিলাম, টেবিলে আমার আমার উল্টোদিকে বসবে তুমি। আমার মুখোমুখি। কিন্তু স্বচ্ছন্দে এসে বসলে আমার পাশে। বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে। আবার একটু হাসলে আমার দিকে ফিরে। 
মুখ-খোলা একটা মোড়কে আধফোটা একটা গোলাপ ছিল। আর ছিল তোমার জন্য আনা খুব সামান্য ছোট্ট একটা উপহার। 
এখানে আসার পথে দেখেছিলাম, মেলাপ্রাঙ্গনের প্রবেশপথ থেকে টিএসসি হয়ে গণগ্রন্থাগার পর্যন্ত বিস্তৃত সড়কের দুইপাশে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে প্লাস্টিকের ঝুড়ি আর বালতিতে আনা গোলাপ বিক্রি করছে অল্পবয়েসী কিছু ছেলেমেয়ে। ওদের মধ্যে ইডেন কলেজ ও ঢাকা ভার্সিটির সদ্যভর্তি ছাত্রীরাও ছিল। পেশাদার ফুলবিক্রেতা নয়। কেবল ভালোবাসা দিবসেই ওরা এ কাজটি করে। পাশ দিয়ে অনেকটা দ্রুত হেঁটে আসছিলাম। দুটি মেয়ে আমাকে লক্ষ ক’রে প্রায় যুগল কোরাসের মতো গেয়ে উঠল, “এই যে দাদা! দাদা! প্লীজ গোলাপ নিয়ে যান।” 
ভাবলাম, আমার চোখে-মুখে আমার হৃদয়-মনের এমন একটা ছাপ মারা আছে কি, যাতে মনে হয় আমি কারও অনুরোধ ফেলতে পারি না। তা নইলে ঠিক আমাকেই উদ্দেশ ক’রে এমনভাবে বলা কেন! মেয়ে দুটি নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমতী। কে জানে, সম্ভবত সব মেয়েই এমন বুদ্ধি ধরে! 
গোলাপটা বের ক’রে টেবিলে রাখতেই ব’লে উঠলে, “কার জন্য এনেছো?”
“কেন, তোমার জন্য।” 
“তাহলে টেবিলে কেন! আমার হাতে দাও।”
আরে! সত্যিই তো! টেবিলে কেন! —- কিছুটা লজ্জা পেয়ে আধফোটা গোলাপ তোমার হাতে তুলে দিলাম। আবার হাসলে সেই মৃদু অপার্থিব অপরূপ হাসি। 
শুধু ছবিতেই তোমাকে দেখছিলাম এতোদিন। বলেছিলাম, তুমি নিশ্চয়ই তোমার ছবির চেয়ে অনেক সুন্দর। কথাটাকে অতিশয়োক্তির মতো শোনাচ্ছিল তোমার কাছে। মৃদু হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলে। আজ দেখলাম তোমাকে মুখোমুখি। প্রত্যক্ষ। আমার কল্পনা, আমার বিশ্বাস যে একবিন্দু মিথ্যা ছিল না, তার চাক্ষুষ প্রমাণ পেলাম আজ। কোনও ছবি কিংবা পৃথিবীর কোনও ক্যামেরার লেন্স তোমার রূপ, তোমার সৌন্দর্যের ভগ্নাংশটুকুও ধারন করতে পারে নি, আর কখনও পারবে না। কথাটায় অনেকেই হয়তো অবাক হবে। কেউ কেউ ভাবতে পারে, গুল মারছি বুঝি। কিন্তু তোমার ফটো কিংবা ভিডিও ক্যামেরায় তোমাকে দেখার পর তোমাকে প্রত্যক্ষ মুখোমুখি দেখতে পেলে তারাও আমার সঙ্গে একমত না হয়ে পারবে না। প্রযুক্তির খর্বত্ব বেশ বড় আকারেই প্রকাশ হলো আমার কাছে। 
এক চঞ্চলা কিশোরীর মতো লাগছিল তোমাকে। দূর থেকে শোনা তোমার কণ্ঠে আমি অবশ্য বরাবরই সে আভাস পেয়েছিলাম। প্রাণের আলোয় ঝকমক করছে তোমার মুখ। এতোদিন মনে মনে যে শ্যামাঙ্গিনীর ছবি এঁকেছি আমি এবং আমার স্বপ্নে যেভাবে ধরেছি আমার প্রিয় বাঙালি নারীটিকে, দেখলাম, তুমি তারই একমাত্র বাস্তব প্রতিমা। বেরিয়ে এসেছো আমার স্বপ্নকল্পনার কুহেলি আড়াল থেকে... 
আন্দাজ করলাম, পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি লম্বা তোমার শরীর। বাঙালি নারীর গড়পড়তা উচ্চতার চেয়ে যথেষ্ট বেশি। মেদবাহুল্যবিহীন ওই দেহে কামিজে তোমাকে দারুণ মানিয়েছিল। মনে হলো, শাড়িতে নয়, কামিজ বা খাটো পাঞ্জাবিতেই তোমাকে বেশি মানায়। ঠোঁটে কোনও আলগা রঙের ছোঁয়া লাগে নি। মুখেও নেই কোনও প্রসাধনচিহ্ন। যতোটুকু পরিচর্যা দরকার, তার অতিরিক্ত কিছুই নেই। কিন্তু ওই সাজসজ্জাহীন, অলঙ্কারহীন তোমাকেই লাগছিল নারীপ্রকৃতির শ্রেষ্ঠ রূপ। 
নারীকে নিয়ে আমার ভাবনায় বরাবরই একটা সরলতা আছে। তার সৌন্দর্য আড়াল হয় মাত্রাবোধহীন প্রসাধন ও অলঙ্কারে। সম্ভবত খুব কম নারীই তা বোঝে। কিংবা হয়তো এই আড়ালটা তার নিজের সম্পর্কে একটা আত্মবিশ্বাসের অভাব থেকে তৈরি। ব্যাপারটা কৌতুকের। আবার খানিকটা বেদনারও। সে যেন প্রদর্শন করছে, আড়াল করছে না। 
তোমার সুন্দর সেই আড়ালের বেদনা থেকে বেরিয়ে এসে এই মুক্ত পৃথিবীর আলোকে আরো দীপ্তিমান করেছে। আর তোমার নিমীলিত দু’ঠোঁটের বিস্তৃতির মধ্যে ফুটে-ওঠা ঐ নিঃশব্দ হাসি এমন অপার্থিব! —- দেহজ তবু দেহের অতীত; কেবল ধ্যানস্থ করে। যে এই সুন্দরের দেখা পেয়েছে, সে ভাগ্যবান; এক বিস্ময় তন্ময়তার ভেতর আবিষ্কার করতে পেরেছে সুগভীর আনন্দের স্বরূপ।
তোমার জীবনের সব গল্পই আমাকে বলেছ। একটু একটু ক’রে। প্রায় প্রতিদিন। আমি তন্ময় মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে শুনতাম। কিছুটা তোমার কণ্ঠের মাদকতায়। বাকিটা তোমার বর্ণনার স্থৈর্যে, সহজাত নৈপুণ্যে। তোমার বলার ঢঙে বিস্মিত আমি তোমার ভেতর একজন জাত গল্পকারের ক্ষমতা আবিষ্কার করতে পেরেছিলাম। বলেছিলাম, তুমি এতো সুন্দর ক’রে বলো যে সারাজীবন আমি কেবল তোমার শ্রোতা হয়েই কাটিয়ে দিতে পারি আনন্দে। তুমি প্রতিবাদ করেছিলেÑ“চুপ! বেশি কথা।” আহা, কী মিষ্টি! কী মিষ্টি তোমার এই ধমকের সুরে-করা প্রতিবাদ। 
তুমি জীবনে অনেক কষ্ট করেছো। অনেক সংগ্রাম। অনেক ত্যাগ। অনেক লাঞ্ছনা। তবু তা তোমার মনের ঐশ্বর্যকে লুটে নিতে পারে নি। বরং চারদিক দিয়েই তা আরো বেড়ে উঠেছে। বিকশিত হয়েছে। আরো আশ্চর্য! তুমি যেন সদ্য পা দিয়েছো কৈশোর থেকে তারুণ্যে, এমনই তোমার সৌন্দর্য। 
এবং তোমার পায়ের কাছে এসে স্তব্ধ হয়ে গেছে সময়। যেন সে তোমার আদেশ মানতে তৈরি। 
এতো অবলীলায় এতো ঘন হয়ে বসেছো আমার কাছে, আমি প্রায় ভুলতে বসেছিলাম, দেখতে আমি আপাদমস্তক কুৎসিত। তোমার পাশে একেবারেই বেমানান। এই সত্যে মন রেখে মনে মনে বললাম, “তুমি বিউটি। আমি বীস্ট। তবে শেষটা ওই গল্পের মতো হবে নাৃ” 
“কী খাবে, বলো?” আমার আঙুলগুলি হাতে তুলে নিয়ে দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করলে তুমি। 
“শুধু চা খাব। তাও এক কাপ দুইজনে ভাগ ক’রে।” 
উঁহু! তা হবে না।” মাথা নেড়ে প্রতিবাদ জানালে। “নানরুটি আর বটি কাবাব খাও। আমি খাইয়ে দেব, বেবি।”
অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হলাম। রুটি ছিঁড়ে এক টুকরো মাংসসমেত আমার মুখে তুলে দিতে যাবে, এমন সময় বললাম, দাঁড়াও, আগে তোমাকে খেতে হবে। 
“উঁহু! আমি ব্রতযাপন করছি। আজ থেকে। কোনো আমিষ খেতে মানা। চল্লিশ দিন পর্যন্ত।” 
বললাম, “ভালো। মাঝে মাঝে টানা কিছুদিন নিরামিষ খাওয়ার অভ্যাস থাকা দরকার। আজীবন নিরামিষাশী হলে আরো ভালো। বার্নার্ড শ’, আইজাক বাসেভিশ সিঙ্গার নিরামিষাশী ছিলেন। তবে আজ আমার জন্য খাও একটু, যেহেতু প্রস্তাবটা তুমিই আমাকে দিয়েছো।” 
হাসলে একটুখানিক। আধা সম্মতির হাসি। “কিন্তুৃপাপ হবে যে।”
“মোটেও না। এই নাও, গোলাপগন্ধভরা তোমার যে-পাপ,” ব’লেই তোমার মুখে তুলে দিলাম এক টুকরো মাংস। তুমি নির্দ্বিধায় সহজ আনন্দে সেটি মুখে নিয়ে চিবোতে লাগলে।  
খাবার শেষে দু’জনের বিশ্রম্ভাপালাপ চলল কিছুক্ষণ। কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে আমার পেটে আলতো ক’রে হাত রেখে বললে, “বাহ! তোমার দেখি একেবারেই পেট নেই। মেদহীন। একদম সমান। তোমার আঙুলগুলিও কী সুন্দর লম্বাটে। আর ওই লম্বা চোখা নাকটা, দাঁড়াও, একটুখানি টিপে দিইৃ।” বুড়ো আঙুল আর তর্জনীতে আমার নাকটা সত্যি টিপে ধরলে। নাকের ডগাটা ধরে নাড়া দিয়ে দেখলে খানিক।
ভাবলাম, আমার প্রশংসা করার উদ্দেশ্যে এসব খুঁজে খুঁজে বার করছ যাতে আমার কদাকার রূপটি নিয়ে কোনও হীনমন্যতায় না ভুগি। আমি তো খুবই সামান্য একজন। তোমার বন্ধুত্বলাভের চির অযোগ্য। তবু জানি, আমার ক্ষুদ্রতাকে তুমি খুব বড় ক’রে দেখ নি কখনো। বরং তোমার কোমল হৃদয়স্পর্শে তা একটা অর্থময় রূপ নিয়েছে আজ। আলোকিত হয়ে উঠেছে। এই সন্ধ্যাটুকু আমার কাছে দামি। এই অরূপ সন্ধ্যার কাছে আমি বার বার ফিরে আসতে পারি। এরই ভেতর আমার সমগ্র কালের যাপন। আমার যাবতীয় ক্ষুদ্রতা আজ নিষিক্ত হয়েছে তোমার ভালোবাসায়। এবং আমার এই অসীম ক্ষুদ্রতার মধ্য দিয়েই এই বার্তা পৌঁছে গেছে বৃহৎ বিশ্বপ্রাণের মর্মে।
মুখে শুধু বললাম, “আজকের সন্ধ্যাটা কেবল আমারই জন্য রচিত।”
“এবং আমার জন্যও।” তুমি যোগ করলে। তোমার চাহনি ও কণ্ঠে অপূর্ব কোমলতা।  “কেবল আমাদের দু’জনের জন্য?” আমি বললাম। 
কোনো জবাব দিলে না তুমি। তোমার নিমীলিত অধরের দুই পাশ জুড়ে, চিবুকের মোহন ভঙ্গিতে ছড়িয়ে পড়ল সেই অতল হাসির তরঙ্গ।
বিদায় নেবার সময় আমার তুচ্ছ উপহারটি হাতে নিয়ে বললে, “এই উপহার আমারই কাছে থাকবে আজীবন।” টেবিল ছেড়ে উঠতে যাচ্ছি দুজনেই —-ওই মুহূর্তে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল —- 
আমাদের টেবিলে যে ছেলেটি খাবার পরিবেশনের দায়িত্বে ছিল, দেখলাম, জানালার পর্দাগুলি দুপাশ থেকে টেনে আনছে সে। বাইরের আলো যাতে ভেতরে ঢুকতে না পারে। পরক্ষণেই বলা-কওয়া নেই, রেস্টুরেন্টের ভেতরের সাদা ফকফকে আলোটা নিভে গেল। তার বদলে কুয়াশার মতো খুব মৃদু নীলাভ আলোয় ভরে গেল চারদিক। একটা স্বপ্নময় আবছায়ার মতো। সঙ্গে বাজতে শুরু করল এক অচেনা শিল্পীর সুরেলা কন্ঠে রবীন্দ্র সঙ্গীত —- ‘যদি তারে নাই চিনি গো, সে কিৃ”। চুপচাপ আমরা দুজ’নেই ধীরলয়ে আর নিচু পর্দায় বেজে-চলা সেই সুরের বাণীতে কান পেতে বসে রইলাম। 
থেমে গেল গান। মৃদু অস্পষ্ট নীলাভ আলোটা তখনো জ্বলছে। সেই আলোতে দেখা-না-দেখার মতো রহস্যময় এক হাসিতে ভরে আছে তোমার মুখ। ঠোঁট দুটি বরাবরের মতোই নিমীলিত। চোখজোড়া আমার চোখের দিকে স্থির। আর সেই মুহূর্তে তোমার চোখের ভাষা বুঝবার জন্যই যেন বা ঝুঁকে এলাম তোমার দিকে। তুমিও কি আমার দিকে ঝুঁকেছিলে খানিকটা? ঠিক বুঝতে পারি নি। আমাদের দুই জোড়া ঠোঁট ততোক্ষণে মিলিত হয়ে গেছে একসাথে। 
ধীরে ধীরে নীলাভ আলো এবার আরেকটু উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এবার ভালো ক’রে চেয়ে দেখলাম তোমাকে। ঠোঁটে সেই অথৈ হাসি। স্থির জোড়া চোখ আমাকেই দেখছে। যেন বলছে “কী ভাবছিলে?” 
মুছে গেল নীলাভ আলো। ধবধবে সাদা বাতিগুলি ফের জ্বলে উঠল। সেইসাথে একটা মৃদু ভূকম্পন। কিছু বুঝে উঠবার আগেই টেবিলের প্রান্ত ছুঁয়ে আধফোটা গোলাপটা হঠাৎ গড়িয়ে পড়ল মেঝের ওপর।

×