সোনালী দিনের স্মৃতি
কদিন ধরে ছোটবেলার একটি স্মৃতি মনে পড়ছে। স্মৃতি সবারই থাকে বা আছে। আর তা মনেও পড়ে কখনো কখনো। তবে অনেক ঘটনার মাঝ থেকে এই বিশেষ স্মৃতিটি যেন ডেকে ডেকে বলছে ‘আমার কথা কেন বলছো না? নাকি আমি বলার মত কিছুই না’।
বেশ ভাবনায় কেটে গেল সময়। কেন এমন হচ্ছে? কিসের তাগাদা মনের মাঝে? মনে হল বুকের মাঝে কেমন এক সূক্ষ্ম কষ্ট জমেছিল। একটি গান। কিছু লোকের প্রতিক্রিয়া। তা দেখেই কষ্টের উৎপত্তি।
রবিঠাকুর ও নজরুলের ঋতু পর্যায়ের গান হচ্ছিল অনুষ্ঠানে। এরই মাঝে একজন শিল্পী অন্য ধরনের একটি গান আপন ইচ্ছায় গাইলেন।
ছন্দ পতন হয়েছে একটু তা বলা যায়। ঋতুর গান গাইতে গিয়ে ধর্মপুরুষ বা অবতারের আগমনগীতি কেন গাওয়া? যদিও এর সাংগীতিক মাধুর্যের কারণেই গাওয়া হয়েছিল গানটি তাতে কোন সন্দেহ ছিল না। যিনি গাইলেন তার ঐ গান গাওয়ার মত দক্ষতাও ছিল। সবচেয়ে বড় কথা উনি ঐ অবতারের অনুসারীও নন। উদার মনেই সুললিত সংগীত হিসেবে গেয়েছিলেন।
তবে ঐ সংগীত নিয়ে কারও কারও অসহিষ্ণু ও অনুদার প্রতিক্রিয়া দেখে মনটা খারাপ হল। সবকিছু পছন্দনীয় নাও হতে পারে। তারপরও মেনে নেওয়ার মত ঔদার্য থাকলে অসুন্দরের আবির্ভাব ঠেকানো যায় হয়তো। শিল্পকে মত-পথ-আদর্শের চশমা চোখে এঁটে দেখলে তার রূপ ধরা যাবে না।
যখন এসব ভাবনা-চিন্তায় মন ভারাক্রান্ত তখনই ঐ স্মৃতি এসে উঁকি দিল। তারপর আরো, আরো স্মৃতিরা এসে ভিড় করলো। তারা যেন ফিসফিসিয়ে বললো ‘আমাদের কথা মনে নেই? মনে করে দেখ আনন্দ জাগবে, খুশি হবে। মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়বে।’ আসলেও তাই ঘটলো। ঐ সব মনে পড়ায় প্রশান্তিতে বুক ভরে উঠলো, এমন স্মৃতি বিষাদ ভুলিয়ে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা জাগায়। এগুলো আমার মা আর মাসীর স্মৃতি, ঐ স্মৃতি রেজওয়ানা বন্যার লেখনীতে বন্দী কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি, ঐ স্মৃতি মেলবোর্নের অনুষ্ঠানে গায়ক শ্রীকান্ত আচার্যের সচেতন উচ্চারণ। তাইতো সব মানুষতো আর অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় না, একে অপরকে মেনেও নিতে চায় না। যদি তাই হতো তবে পৃথিবীতে মারামারি, কাটাকাটি কবে বন্ধ হয়ে যেতো।
ছোটবেলা কোন একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি টেবিলে কাঁঠাল পাতার একটি মোচা রয়েছে। মিষ্টি জাতীয় খাবার যে এতে রয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ধরতে যেতেই মা বললেন,
‘রীতেন ও তার বউ আজ ফিরেছে রায়পুরা থেকে। ওর মা পূজার প্রসাদ মিষ্টি পাঠিয়েছেন। যাতা ভাবে ধরবে না, বিকালে সবাই একসাথে খাবে।’
বিকালে ভাইবোন সবাইকে মা মিষ্টি খেতে দিলেন। গুড়ের সন্দেশ, নারকেলের সাদা নাড়ু, নারকেল চিকন সুতা মত কেটে গুড়ে জাল দিয়ে নানা নকশার মিষ্টি। মা সতর্ক করলেন এই বলে যে, মিষ্টি যেন মাটিতে না পড়ে। মায়ের মতে পূজার প্রসাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে খাওয়া উচিত না। ‘কেন মা?’
‘ওরা শ্রদ্ধার সাথে পাক-পবিত্র করে বানিয়েছে তাই।’
‘জান মা, সাদা নাড়ুতে হাল্কা কর্পূরের গন্ধ, মুসলমানদের জন্য কর্পূর নাকি নিষেধ?’
‘কে বলেছে?’
অসহিষ্ণু কণ্ঠে মা জানতে চাইলেন।
‘শরীফের দাদী’
“ওহ্ যিনি সকাল বিকাল সুর করে কোরান পড়েন তিনি?’
মা হতাশ হলেন মনে হল। তারপর আমাদের জানানোর জন্য প্রত্যয় নিয়ে বললেন,
‘শোন ঐ কোরানের সূরা আদ দাহারের ৫নং আয়াতে বলা হয়েছে, সৎ কর্মশীলরাই কর্পূর মেশানো পাত্র থেকে পান করবে।’
‘তোমাকে তো কোরান পড়তে দেখি না, তুমি জান কি ভাবে মা?’
‘তা যাই হোক, আমি হয়তো সকাল-সন্ধ্যা অর্থ না বুঝে আরবী কিছু শব্দ সুর করে ভজি না, তবে পড়ি সময় নিয়ে মর্ম বুঝতে চাই তাই।’
চলে যেতে যেতে মা গজ গজ করছিলেন ‘না বুঝে কোরান পড়েন বলেই গিবতের মত জঘন্য কাজও অনবরত করেন। কার মেয়ে চুল ছড়িয়ে জানলায় বসেছিল, কার বউয়ের মাথায় আঁচল ছিল না বলে কে তাকিয়েছিল, এসবও কোরান পড়ার মতই যতœ করে বাড়ি বাড়ি বলে বেড়ান উনি।
একবারও ভাবেন না যে বদনাম ছড়ালে সেই অপরাধের ক্ষমা আল্লাহও করেন না, যে পর্যন্ত যার নামে বদনাম বা গিবত করা হয়েছে সে ক্ষমা না করে। আজ কথাগুলো সব মনে পড়ছে। তখন ঐ কথার তাৎপর্য তেমন বুঝিনি, বোঝার মত বুদ্ধিও অবশ্য
(এরপর ২৩ পৃষ্ঠায়)
ছিল না। এবারের স্মৃতি এক মাসীর স্মৃতি। ঘটনা ঘটেছিল আমার দ্বিতীয় সন্তান জন্মের সময়। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সামান্য অস্বস্তি নিয়ে ক্লিনিকে যাই ডাক্তারের পরামর্শ শুনতে। সহকারী ডাক্তার সমস্যা সামান্য ভেবে বাড়ি ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছিলেন প্রায়। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যার কাছে আমার আগের কেস হিস্ট্রি ছিল, তাঁর নির্দেশ একদিন ক্লিনিকে রেখে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে। ঐখানে আসন্ন গর্ভবতীদের ভিড়। ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর আমাকে রুম দেওয়া হল।
আরেক জনের সাথে এক ঘরে ব্যবস্থা হয়েছে। ঘরে ঢুকে দেখি বিছানায় আসন্ন মাতৃত্বের ভারে আমারই মত ক্লান্ত এক নারী শুয়ে। তার সিঁথিতে সিঁদুর, হাতে শাঁখা, নোয়া। বিছানার পাশের চেয়ারে এক প্যাঁচ দিয়ে চওড়া পাড় সাদা শাড়ি পরিহিতা আরেক জন বসে। মায়াভরা চেহারার বয়স্কা মহিলা তার আঁচলে বাঁধা চাবির গোছা কাঁধের উপর দিয়ে পিঠে লুটিয়ে রেখেছেন। আমার জন্য ধবধবে পরিষ্কার বিছানা পাতা ছিল। তার কিনারায় যেই বসতে গেছি, তখনি চিন্িিচনে এক ব্যথা বিদ্যুতের মত ঝিলিক দিয়ে মিলিয়ে গেল। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা সত্ত্বেও আহ্ কাতরানি উচ্চারিত হল। সেই মায়াবতী নারী চেয়ার ছেড়ে ঝট্ করে উঠে আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন।
‘ব্যথা শুরু হয়েছে কি? সঙ্গে কেউ আসেনি তোমার?’
আমার ব্যথা যন্ত্রণা চলে গেছে ততক্ষণে। আমি পুরোপুরি স্বাভাবিক বললাম- ‘ভর্তি করিয়ে রেখে দেবে ভাবিনি; আমার আরও দু’সপ্তাহ পর আসার কথা। স্বামী আত্মীয়দের খবর দিয়ে এখনই ফিরবেন।
কথাবার্তা হল তা থেকে জানা হল ঘুমন্ত নারী তাঁর পুত্রবধূ। এরও দ্বিতীয় সন্তানের আগমনের অপেক্ষা। সবকিছুই স্বাভাবিক উনার জটিলতা নেই কোন। ব্যথা তীব্র হলে ডাক্তার বলেছে আগামীকাল ভোরেই বাচ্চা হবে। আমার ব্যাপার শুনে বললেন-‘স্রষ্টার উপর ভরসা রাখ মা, সবই তাঁর ইচ্ছা।’
ঠিক তখনি আবার আমি ব্যথা সামলাতে গিয়ে কেঁপে উঠলাম। উঁনি আমার পিঠে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সরে গেলেন। দেখি বেডসাইড টেবিল থেকে ফ্লাস্ক তুলে ঢাকনা খুলে কাপে কিছু ঢালছেন। মনে হল ওনার হয়তো চায়ের পিপাসা পেয়েছে, তাই চা খাবেন। কতটা সময় ধরে ব্যথাকাতর পুত্রবধূর পাশে বসে রয়েছেন কে জানে? কাপ হাতে আমার কাছে ফিরে এলেন। কাপে গরম দুধ রয়েছে। আমার দিকে কাপ বাড়িয়ে দিয়ে বললেন-
‘খাও, নিজেদের গরুর দুধ, গরম দুধ খেলে উপকার হবে’
সস্নেহ অধিকারে যোগ করলেন-
‘মাসী বলছি, খেয়ে দেখ ভাল লাগবে।’
আমার সংকোচ হচ্ছিল। আজকাল আন্তরিকতা দেখলে অস্বাভাবিক লাগে, অবাক হই। আন্তরিকতা দুর্লভ, রুক্ষতা ও অবজ্ঞা মেশানো উদাসীনতা এই সময়ের স্বাভাবিক আচরণ। আমি ব্যথায় দীর্না ঘুমন্ত মুখটি আড়চোখে দেখলাম। মনে হল ঐ বেচারীর দুধে আমি ভাগ বসাচ্ছি। আমার মনোভাব বুঝতে পেরে সদ্য পাওয়া মাসী বললেন, ‘ওকে গরম দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছি। ব্যথাটা ওর জোর হচ্ছে না কেন তাই নিয়ে চিন্তা ?’
আমি আস্তে আস্তে দুধে চুমুক দিচ্ছি আর মাসীকে দেখছি। খয়েরী সুতার নকশা পাড়ের সাদা শাড়ি, শান্তিনিকেতনী দুই ফিতার স্যান্ডেল, গলায় মোটা সোনার চেন। হৃদয়বতী স্নিগ্ধ রুচির এই নারী কত সহজে আমাকে আপন করে নিলেন। অল্প সময় পরই আমার মা-খালা দরকারি সবকিছু নিয়ে হাজির। তার মাঝে ফ্লাস্ক ভর্তি চা ও ফুটন্ত পানি, কেক, বিস্কিট, হরলিক্স সবই ছিল।
তারা নিজেদের পরিচয় দিয়ে-নিয়ে দিদি সম্পর্ক পাতিয়ে ফেললেন। আমার খালা চা ঢেলে মা-মাসীকে দিলেন। তারপর নিজের কাপটি হাতে নিয়ে বিছানার ধারে বসে মাসীর ছেলের বউয়ের কথা বিস্তারিত জেনে নিলেন। এরই মাঝে বউটি নড়েচড়ে উঠে বসলেন। বিশালগর্ভ নিয়ে যা সব গর্ভবতীরই হয়, বউটি কষ্টে হাতমুখ ধুয়ে ফিরলে শাশুড়ি তার চুল আঁচড়ে দিলেন। চুল বাঁধা হয়ে গেলে আমার মা তাকে চা আর কেক খাওয়ানোতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আর সেই ফুরসতে খালা তাঁর রূপার ছোট্ট পানদান খুলে মাসীর সাথে পান খেতে বসলেন। আমার মা কখনই পানের ভক্ত নন।
ভিজিটিং আওয়ার শুরু হওয়াতে মানুষের আনাগোনা বাড়ছে। সবারই অবয়বে আনন্দের সাথে আশংকাও মিশে আছে। প্রকৃতির অংশ নারী ১ সৃষ্টির বহমানতা রক্ষা করে নারী। তাই আদিকাল থেকে পৃথিবীতে প্রাণ আনার গুরু দায়িত্ব নারীর কাধে অর্পিত। এই কাজে গৌরব যেমন আছে, সংকটও থাকে পাশেপাশে। সেই সংকট থেকে সহজ মুক্তির জন্য সবার থাকে প্রার্থনা। সংকটের সময়ে সামান্য আশ্বাসও পাওয়া যায় এমন সবকিছুই আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে।
মাসীমার প্রতিবেশী মহিলা এলেন। ফলমূলতো আছেই, সঙ্গে ছোট্ট বোতলে পানিও এনেছেন ইনি। কিসের পানি, কি জন্য পানি, কেনই বা এনেছেন জানি না।
সবাই গল্পে মেতেছে। আমি বাইরে তাকালাম। বাইরে হেমন্তের পড়ন্ত বিকাল। দরজা দিয়ে তাকালে বারান্দা পেরিয়ে ছোট্ট চারকোণা উঠান বা আঙ্গিনা চোখে পড়ে। ঐটুকু আঙ্গিনার অর্ধেক সিমেন্টে বাঁধানো। তারই এক কোনায় একটি পানির কল। তবে কলতলা, উঠান সবই পরিষ্কার, শুকনা আর ঝকঝকে। উঠানের আরেক কোণার গাছ থেকে অবিরাম পাতা ঝরছে। খুব সুন্দর ভাবে পাতারা ঝরছে। ঝট্ করে একবারেই মাটিতে পড়ছে না। কেমন যেন দুলে দুলে এসে আস্তে মাটিতে ঠাঁই করে নিচ্ছে। ভাবলাম, মানুষ যদি এমনি শান্তিতে ঝরে যেতে পারতো।
কাউকে কষ্ট না দিয়ে, নিজে কষ্ট না পেয়ে। তবে তা হবার নয়।
মানুষতো পাতা নয়, মানুষের রয়েছে কর্তব্য, মানুষের রয়েছে ভালবাসা। এই দুই পাকে বাধাঁ বলেই পাতা ঝরার মত মানুষ ঝরে যেতে পারে
না ।
ভিজিটররা সব চলে যাবার পর নার্স আমাদের দেখতে এল। বউটিকে ঠাট্টার সুরে বললো, ‘দিদিমনি আজকের রাতটা ঘুমিয়ে নিন, কাল সকালেই ইনজেকশন দিয়ে ব্যথা তোলা হবে।’
আমাকে বললো, ‘আপুমনি, আপনাকে দেখছি আসার পর থেকেই খালা, মা আর মাসীর আদর আপ্যায়ন পেয়ে খুশিতেই আছেন, উঠে হাঁটুন এবার তানা হলে আবার ছুঁরিকাচি নিয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু হবে।’
আমার খালা আর মাসীমা একসাথে বলে উঠলেন, ‘ভয় দেখিও নাতো, যা হবার তা হবেই, সাহস রাখ মা।’
মায়ের চোখে পানি চলে এল, আঁচলে চোখ মুছতে দেখলাম তাকে। মাসীমা দুটো কাপে মহিলার বোতল থেকে অল্প করে পানি ঢাললেন। তারপর একটি কাপ আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘খাও মা, এ পানি তোমাদের পবিত্র জায়গা থেকে আনা ?’
বিস্মিত কণ্ঠে খালা প্রশ্ন করলেন-‘মক্কা শরীফের জমজম কুয়ার পানি আপনি পেলেন কোথায়?’
অন্য কাপটি নিয়ে ছেলের বউয়ের কাছে যেতে যেতে বললেন, ‘ঠিক ধরেছেন দিদি, আমার প্রতিবেশিনীর বাবা এই বছরেই মক্কাতে গিয়েছিলেনতো।’
আমি ‘ইয়া শাফি’ বলে কাপের পানি এক চুমুকে শেষ করে বউটির দিকে তাকালাম। স্নেহময়ী শাশুড়ি পুত্রবধূর হাতে কাপটি দিয়ে বললেন, ‘ধর, শ্রদ্ধার সাথে খেয়ে নাও মা ?’
অবাক হয়ে দেখলাম বউটি অত্যন্ত শৈল্পিক ভাবে হাতের তালুতে তিনবারে ঢেলে তিন চুমুকে পানিটুকু খেয়ে ভেজা হাত খুব যতেœর সাথে মাথায় মুছলেন। মুসলমানের কাছে যে পানি পবিত্র তা এক হিন্দু ঘরের বউ কত যতœ করে যে খেল সে ঘটনা মনে রাখার মতোই।
আমার মা আর ঐ মায়াঝরানো মাসী নন-কম্যুনাল হওয়ার শিক্ষা পাননি, দীক্ষা নেওয়ার প্রশ্নতো অনেক দূরের বিষয়। ওঁনারা অর্থ জানতেন না সেকুল্যারিজম বা মিউচ্যুয়াল টলারেন্সের মত গুরুগম্ভীর শব্দের। তবু মা পূজার প্রসাদকে যোগ্য মর্যাদা দিয়েছেন আর হঠাৎ পাওয়া মাসীকেও দেখলাম মক্কার পানিকেও শ্রদ্ধার সাথে খেতে বলছেন। একেই বোধহয় বলা যায় গোঁড়ামিমুক্ত মিউচ্যুয়াল রেসপেক্ট।
এবার যে স্মৃতি আমায় হাতছানি দিয়ে ইশারা করছে তা হচ্ছে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক ছবি। এই ছবি তুলে ধরেছেন সুগায়িকা রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা তাঁর প্রবন্ধে। কোন একসময়ে বন্যারা জুটেছেন সবে একসাথে তাদের প্রিয় মোহরদিকে ঘিরে। ঐ আসরে মোহরদি মানে কণিকা কি একটি গান গেয়েছিলেন। গানটিতে হরি বা ঈশ্বর শব্দের জায়গায় আল্লাহ্ শব্দ বসিয়ে কণিকা গেয়েছিলেন যা রেজওয়ানাদের আপ্লুত করেছিল। এতে শিল্প বিকৃত হয়নি, বর্ধিত হয়েছিল মাত্র কণিকার উদারতার পরশে। আর কণিকা? ওঁনার অস্তিত্ব বিরাট হয়ে, বিশাল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল চারপাশে।
এবার বলি তবে শ্রীকান্ত আচার্যের কাহিনী। কুড়ি বছর আগে মেলবোর্নে অনুষ্ঠান করতে এসে শুধু গান নয়, গল্পেও মুখর ছিলেন শ্রীকান্ত। প্রসঙ্গক্রমে অত্যন্ত গুণী গায়ক সুমনের কথা বলতে যেয়ে খুব সচেতন উদারতায় কবির সুমন বলেই নামটি উল্লেখ করেন। এতে সুমনের ব্যক্তিগত পছন্দকে সম্মান দেখানোর উদার মানসিকতা যে শ্রীকান্ত আচার্যের রয়েছে, তা ফুটে উঠেছিল।
ক্যাসিয়াস ক্লেকে মোহাম্মদ আলী বলে সম্বোধন করতে অনেকেরই অনেকদিন লেগেছিল। শ্রীকান্ত আচার্য সে সংকীর্ণমনাদের দলে অবশ্যই পড়েন না তা বোঝা গেল।
স্মৃতিরা বলে গেল গান শুনে অনুদার আচরণকারীকে মা-মাসী, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্রীকান্ত আচার্য করুণা ছাড়া কিছুই দিতে পারছেন না। গল্পের মত সত্য ঘটনার বয়ান যখন শেষ করবো ভাবছি, তখনই বাংলাদেশের তারেক মাসুদ পরিচালিত ‘মাটির ময়না’ ছবিটি দেখার সুযোগ হল। অনেক পুরস্কারে ভূষিত। এছাড়াও ‘মাটির ময়না’ প্রথম বাংলাদেশী চলচ্চিত্র যা অস্কার পাওয়ার জন্য নমিনেশনপ্রাপ্ত বিদেশী ছবির তালিকাভুক্ত হয়। ঐ ছবির এক্সট্রা ফিচারে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের (যিনি প্রধান চরিত্র কাজীর ভূমিকার অভিনেতা) সাক্ষাৎকার দেখি। জয়ন্ত অতি গুণী আবৃত্তি শিল্পী। সাক্ষাৎকার সূত্রে জানা গেল, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় প্রতাপশালী গোঁড়া ব্রাক্ষ্মণ পরিবারের সন্তান। তা সত্ত্বেও সেই কবে কোন্ একদিন জয়ন্তের বাবা তাদের গ্রামের প্রথম হজ করে ফেরা হাজিকে গ্রামের প্রবেশদ্বারে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করতে দ্বিধা করেননি।
এই গল্পের শেষ নেই। যার শেষ নেই তার উপসংহার টানা যাবে কিভাবে?
তবে শ্রদ্ধেয় অম্লান দত্তের প্রবন্ধ ‘দেশ’ (২ জুলাই ২০০৫) শেষ কথাটি বলার সুযোগ করে দিল। ‘পরিবারে- পরিবারে, পল্লীতে-পল্লীতে, দেশে-দেশে মানুষকে পারস্পরিক প্রীতি ও সহযোগিতার সূত্রে আবদ্ধ রাখবার শক্তি কাজ করে যায় অপেক্ষাকৃত কোলাহলের বাইরে, অগ্রসর হয় শান্ত চরণে। এই শক্তিতেই সমাজ আজও টিকে আছে।’