পান্নার চেয়ে দামি
ওর আসল নাম কি, তা আমি জানি না। জানলেও আজ আর মনে নেই। কণা নামেই ওকে আমি ডাকতাম। আমার দেওয়া নামটা না কি তার ভারি ভালো লাগত। আমার প্রশস্ত বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে যেন পরম নির্ভরতার সঙ্গে ও বলত, ‘ভোরের একটি বিন্দু শিশিরের সত্তায় তোমার জীবনে শুধু একটি কণা হয়ে আমি যে বেঁচে থাকতে চাই শিশিরদা।’
আমি বলতাম, ‘কণা হতেই যদি এত সাধ, তবে তা শিশিরের না হয়ে মহাসমুদ্রের হওয়াটাতেই তো বেশি সার্থকতা।’
প্রতিবাদ করে ও বলত, ‘না শিশিরদা, সমুদ্রের জলে অনেক হিং¯্র প্রাণীর বাসা। আর তা দূষিত হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। তার সত্তার কণা হয়ে নিজে দূষিত হওয়ার ভয়ও অমূলক নয়। তার চাইতে শিশিরের কণা হতে পারাটাতেই সার্থকতা অনেক বেশি। কারণ শিশিরের মাঝে আর যা কিছুই থাকুক না কেন, অন্তত হিং¯্র প্রাণীর বাসা সেখানে নেই। আর দূষিত হওয়ার সম্ভাবনাও সেখানে অনেক কম।’
পাল্টা যুক্তি উপস্থাপন করে আমি বলতাম, ‘কিন্তু সমুদ্রের জল কোনোদিন তো শেষ হয় না কণা। জীবন যে সেখানে অবিনশ্বর।’
কণা প্রতিবাদ করে বলত, ‘শিশিরের বিন্দু নশ্বর, এ কথা তোমাকে কে বললে শিশিরদা?’
আমি বলি, ‘দেখো না, ভোর হওয়ার পরে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই কেমন করে মিলিয়ে যায় সে শিশিরের বিন্দু।’
ও বলে, ‘এ তোমার ভুল ধারণা শিশিরদা। তাতে যে শিশিরের জীবন অস্তিত্বহীন হয়ে যায়, তোমাকে তা কে বললে? চন্দ্র যখন অস্তমিত হয় নীল আকাশের বুকে, অনেক সাধনায় রচিত ছোট্ট বাসাটাতে কপোতের বুকে মুখ লুকিয়ে পরম নিশ্চিন্তের সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ে শ্রান্ত কপোতি, আকাশে তারকার বাসর সাজাতে মিটিমিটি ফুটে ওঠে এক ঝাঁক তারকার মালিকা, বনের মধ্যে বরণমালা সাজাতে ঝিরঝির ঝরে পড়ে গুচ্ছ গুচ্ছ শুভ্র শেফালি সবুজ তৃণের শীর্ষেÑ তখনই স্বর্গের প্রশান্তি নিয়ে আকাশ থেকে নেমে আসে কয়েক ফোঁটা শিশিরের বিন্দু।
সজীবতা আনে সে শ্যামল দুর্বাশীর্ষে আর আধফোটা কলির লাজুক অধরে। তারপর আকাশ থেকে পৃথিবীর বুকে যখন নেমে আসে একঝাঁক সোনালি আলোর দীপালি, তখন কলির সে লাজুক অধরে বসে কেমন করে মুক্তো ঝরায় সে শিশিরের কণাÑ তুমি এসব দৃশ্য দেখোনি শিশিরদা?
আমি বলি, ‘দেখেছি। কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর এখনো তো আমি পাইনি কণা।’
কণা বলে, ‘আমার কথাও তো এখনো শেষ হয়নি। তুমি জানতে চাও, অস্তিত্বহীন হয়েও সে শিশিরের সমুদ্র কেমন করে বেঁচে থাকে। তাই না শিশিরদা? কি জানো? অস্তিত্বহীন বলে যাকে তুমি ভাবো, আসলে সে তা নয়। দু’চোখ দিয়ে হয়তো তাকে তুমি দেখতে পাও না; কিন্তু সারাটি ভুবন জুড়েই সে বিরাজমান থাকে। তাই লগ্ন এলেই আবার সে ফিরে আসে পৃথিবীর বুকে নতুন করে বাসর সাজাতে।’
আমি বলি, ‘তবে সূর্যের আলোর মাঝে ওকে দেখা যায় না কেন?’
কণা বলে, ‘পৃথিবীর মানুষ বড় স্বার্থপর। রূপ-রস আর সুগন্ধ-সুষমা দিয়ে যে তাকে বাঁচিয়ে তোলে, জীবনকে নতুন করে ফিরে পেয়ে সেই নতুন প্রাণদায়িনীর কথা সে ভুলে যায়। নতুন তেজোদীপ্ত বন্ধুর সন্ধান পেয়ে তাকেই সবচাইতে আপন ভেবে সে বন্দি হয়ে কৃতার্থ হয় তার কাছে। পুরনো কথা স্বীকারে কিছুটা সংকোচ হয় তার। তার সেই সংকোচ স্বভাবটাকে তুমি ঘৃণিত কর্ম বলে আখ্যায়িত করতে পারো শিশিরদা। প্রতিক্রিয়াশীল পৃথিবীর সে ঘৃণা থেকে মুক্তি পেতে তাই সে ক্ষণিকের জন্য লুকিয়ে থাকে সর্বচক্ষুর অন্তরালে।’
কণার কথার শেষের দিকটাতে যেন কিছুটা প্রচ্ছন্ন বিদ্রƒপের আভাস পাই। তাই বলি, ‘আমাকে তুমি অবিশ্বাস করো। তাই না কণা?’
আমার প্রশ্নে আহত হয় কণা। বলে, ‘আমাকে তুমি ভুল বুঝো না শিশিরদা। এতকিছু চিন্তা করে কথাগুলো আমি বলিনি। সেটুকু আস্থা তোমার ওপর আমার আছে। শিশির হারিয়ে গেলে তার কণাও যে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে শিশিরদা।’
আমি হেসে বলি, ‘তুমিই তো বললে কণা, শিশির কোনোদিন হারিয়ে যায় না, ক্ষণিকের জন্য তার অনুপস্থিতি ঘটে মাত্র। লগ্ন হলে সে তো আবার ফিরে আসে।’ যেন এক অযাচিত বেদনার পরশ লাগে কণার বুকে। বলে, ‘না না না শিশিরদা, এতটুকু সময়ের জন্যও তোমাকে আমি হারাতে পারবো না। আমি তা সইতে পারবো না শিশিরদা।’
Ñ ‘পাগলি মেয়ে!’ বেদনাক্লিষ্ট হাসি দিয়ে কণাকে কাছে টানি আমি। আমার বুকের মধ্যে যেন এক পরম নির্ভরতার আশ্রয় খুঁজে পায় কণা। বেশ কিছুটা নীরব মুহূর্ত কেটে যাবার পর আস্তে করে আমি ডাকি, ‘কণা।’
‘বলো শিশিরদা।’Ñ মৃদুভাবে জবাব দেয় কণা।
‘তোমাকে ঘিরে আমার এ বুকে কত যে স্বপ্ন, একমাত্র ভগবানই তা জানেন।’
‘কণা বলে, ‘লাভ কি তাতে শিশিরদা?’
বিস্মিত কণ্ঠে আমি প্রশ্ন করি, ‘তার মানে?’
কণা বলে, ‘সবকিছু ব্যাপারেই ভগবানের ওপর নির্ভর করে বসে থাকাতে ধার্মিকতা থাকতে পারে, কিন্তু অন্তত কোনো বাহাদুরি নেই তাতে।’
আমি বলি, ‘কেন?
কণা বলে, ‘ভগবানের অভিপ্রেতও তা নয়। অধার্মিকের চাইতে কাপুরুষ হওয়াটাই ভগবানের কাছে অনেক বড় অপরাধ। মানুষকে ভগবান অনেক সামর্থ্য দিয়েছেন। তাই কাপুরুষের মতো ভগবানের ওপর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকবার চাইতে আপন ব্যক্তিত্বের শক্তিতে নিজের অদৃষ্টকে সৃষ্টি করে নেওয়াটাই সত্যিকারের মানবগুণের লক্ষণ। আর এই মনুষ্যত্বের ওপর কোনো ধর্ম নেই শিশিরদা। তা ছাড়া ভগবানের অজানা কিছুই নেই। তাই তাঁকে জানানোর মাঝে বাহাদুরি বলতে কিছু নেই। আত্মশক্তিটাকে সর্বচোখে প্রকাশ করাটাতেই তো বাহাদুরি বেশি।
আমি অবাক হই কণার মুখ থেকে এমনি ধরনের দার্শনিক উক্তি শুনে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে নীরবে চিন্তা করি কণার কথাগুলো নিয়ে। তারপর বলি, ‘তাহলে ভগবানের শক্তি কি মিথ্যে কণা?’
কণা বলে, ‘তা হবে কেন? সবসময় সেই শক্তির ওপর আস্থা রেখে নিশ্চিন্ত হওয়র মতো মিথ্যে হয়তো আর নেই।’
কণার কথাগুলো ধাপে ধাপে দার্শনিকতার সিঁড়ি বেয়ে ওপরের দিকে আশ্রয় খুঁজছে। সত্যি-মিথ্যে যাচাইয়ের সামর্থ্যটাকে যেন হারিয়ে ফেলতে চলেছি আমি।
আমাকে নীরব দেখে কণা ডাকে, ‘শিশিরদা।’
সম্বিত ফিরে আমি জবাব দেই, ‘বলো।’
এবার গভীরভাবে আমার বক্ষলগ্না হয়ে কণা বলে, ‘এ পরম নির্ভরতম আশ্রয় থেকে আমাকে তুমি হারিয়ে যেতে দিও না শিশিরদা।’
আমি বলি, ‘ঝড়ের আঘাতে যদি কোনোদিন পাখি তার নীড়ছাড়া হয়ে যায়, সেজন্য তো দোষ নীড়ের নয় কণা।’
অবাক হয়ে কণা প্রশ্ন করে, ‘তবে কার শিশিরদা?’
আমি বলি, ‘যে পাখি সেই নীড় রচনা করে, তার।’
আহত কণ্ঠে কণা প্রশ্ন করে, ‘কেন শিশিরদা?’
আমি বলি, ‘হৃদয়ের ভালোবাসার শক্তি দিয়ে যে নীড় রচিত হয়, সে নীড় হয় মজবুত। আর তেমন নীড় তো নষ্ট হওয়ার কথা নয়। আশঙ্কাও থাকে না তা ভাঙবার।’
কণা বলে, ‘তবুও তো সর্বনাশা প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের আঘাতে অনেক যতেœ বুকের রক্তে গড়া সে নীড় অনেক সময় চূর্ণ হয়ে যায়।’
আমি বলি, ‘কিন্তু নিষ্ঠার অভাব না থাকলে তাতে কোনো ক্ষতি হয় না পাখির। উড়ে যাওয়া ভাঙা নীড়ের টুকরোগুলোকে সংগ্রহ করে নিয়ে ভেঙে যাওয়া নীড়টাকে আবার নতুন করে গড়ে নেয় সে।’
আবেশে ভেঙে পড়ে আমার বক্ষমাঝে আত্মবিসর্জিতা হয়ে কণা বলে, ‘আশীর্বাদ করো শিশিরদা, এতটুকু নিষ্ঠা চিরদিনই যেন আমার থাকে।’
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে নিষ্ঠাকে সজীব করে রাখতে সক্ষম হয়নি কণা। জানি না, ওর জন্য আশীর্বাদ কোনোদিন আমি করেছিলাম কি না। আর করলেও হয়তো আমার মনের অজান্তে কোনো কৃত্রিমতা ভর করেছিল তাতে। তাই একদিন সকল অঙ্গীকারের কথা ভুলে গিয়ে, পুরনো নীড়ের মায়া কাটিয়ে ও চলে গেল আর এক নতুন নীড়ের আশ্রয়ে। শিশির থেকে মুক্তি নিয়ে সে কণা মিশে গেল অনন্ত সমুদ্রের অগাধ বারিধিম-লে। সে সমুদ্রের মাঝে ওর প্রশান্তি কতটুকু মিলেছিল, জানি না, তবে অনেক মণি-মুক্তো আর চুনি-পান্নার সন্ধান সে পেয়েছিল। শিশির সত্তায় মিশে এক হয়ে সূর্যের সঙ্গে সপ্তরঙের মিতালি পাতিয়ে নকল মুক্তো হওয়ার চাইতে আসল মুক্তোর অধিকারী হয়ে অসুখি হওয়ার পেছনে কোনো বলিষ্ঠ যুক্তিকে আমি খুঁজে পাইনি।
কণার কথা ভুলে যেতে আমি অনেক চেষ্টা করেছি। প্রথমে খুব কষ্ট হতো তাতে। কারণ সে প্রচেষ্টা যত বেশি প্রবল হয়েছে, তত বেশি শক্তি নিয়ে এগিয়ে এসে অক্টোপাসের মতো করে অসহ্য বন্ধনে আঁকড়ে ধরেছে তা আমাকে। ব্যর্থ হয়েছি বারবার। দোষ দিয়েছি আমার অদৃষ্টকে। ত্রুটি খুঁজেছি আমার ভালোবাসায়। আমার সাধনায়। কিন্তু ব্যর্থতার চরম আঘাতে বারবার জর্জরিত হয়েছি আমি।
এরপর নতুন নীড় বাঁধবার স্বপ্ন নিয়ে আমার জীবনে এলো সুস্মিতা। বাবার অন্তিম ইচ্ছাতেই তাকে আশ্রয় দিতে হলো আমার বিধ্বস্ত নীড়ে। সুস্মিতা আমাকে ভালোবাসলো তার হৃদয়ের সবটুকু দিয়ে। এতটুকু খাদ ছিল না আমার প্রতি তার ভালোবাসায়।
কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও আমার জীবনে সুস্মিতার অস্তিত্বকে মন থেকে আমি মেনে নিতে পারিনি। তবু সুস্মিতা তার অন্তরের সাধনা দিয়ে আমাকে পেতে চেষ্টা করতে লাগল। ক্রমাগত সাধনায় এক সময় সে বিজয়িনী হলো। ওর পবিত্র ভালোবাসার শক্তিতে একদিন আমি মুক্তি পেলাম কণা নামের একটি নিদয়া নারীর অশুভ ছায়া থেকে। কণার কথা আর মনে রাখিনি। রাখার প্রয়োজন হয়তো তেমন হয়নি।
কিন্তু দীর্ঘদিন পরে সেদিন অপ্রত্যাশিতভাবে ওর নিজের হাতের লেখা চিঠিটা পেয়ে আবার নতুন করে মনে পড়ে গেল ওকে। কণা নামের বিস্মৃত অধ্যায়ের এক নায়িকাকে। ও লিখেছেÑ
‘শিশিরদা, অনেক দিন পর তোমাকে লিখছি। তোমার সাথে আমার শেষ দেখাÑ সে আজ থেকে প্রায় বছর ত্রিশেক আগে হবে। এমনি করে তোমাকে আবার লিখতে হবে, ভাবিনি। কিন্তু মানুষ যা ভাবে তাই যদি হতো, তাহলে জীবনের ব্যর্থতা নিয়ে তাকে এমনি করে সারাটা জীবন বেদনার বোঝা বয়ে বেড়াতে হতো না। আমার ওপর কতবড় ঘৃণ্য ধারণা নিয়ে তুমি আছো, তা আমি জানি। সেটা স্বাভাবিকও। আমার কোনো কথা আজ তুমি বিশ্বাস করবে না, তা জানি। কতবড় অভিশাপকে সম্বল করে তোমার সাথে আমার স্বপ্নের নীড় থেকে আমি ছিটকে পড়েছিলাম, সে শুধু আমিই জানি। বিলাসব্যসন আর প্রাচুর্য আমি কম পাইনি। কিন্তু মনকে উপোস রেখে দেহের পরিচর্যা সে যে কত বড় যন্ত্রণা, আজ আমাকে দিয়ে আমি তা নির্মমভাবে উপলব্ধি করছি। ইচ্ছা ছিল জীবনে যদি আর কোনোদিন তোমার দেখা পাই, আমার সব কথা তোমাকে বলবো। আমার ব্যর্থতার কথা। আমার পরাজয়ের কথা। সকল অভিশাপের কাহিনী। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আজ আমার কোনো কথাকেই তুমি বিশ্বাস করবে না। এতদিনে নিশ্চয়ই অনেক অপ্রীতিকর বিশেষণে অভিযুক্ত আমি হয়েছি। আজ আরও একটা বিশেষণে যুক্ত হতে আমার অনভিপ্রেত হলেও তা থেকে আমি নিবৃত্ত থাকতে পারছি না।
জীবনের প্রথম প্রহরে শুধু চেয়েই এসেছি তোমার কাছে। নিয়ে এসেছি শুধু, দিতে পারিনি কিছুই। শেষবারের মতো আজও তাই আবার নতুন করে চাইতে এসেছি তোমার কাছে। এটুকু চাওয়ার প্রাপ্তিতে তোমার কাছ থেকে নিরাশ হবো না, এ বিশ্বাস তোমার ওপর এখনো আমার আছে। কারণ পৃথিবীর সব রকম নিচুতর বিশেষণে আমি বিশেষায়িত হতে পারি; কিন্তু অন্তত তোমাকে তেমন করে দেখার নিচুতাকে আজও আমি অর্জন করে নিতে পারিনি।
আচ্ছা শিশিরদা, আমাকে তুমি খুব ভালোবাসতে। তাই না? অথচ একটি নীড়ের যুগল বাসিন্দা আমরা হতে পারলাম না। তার জন্য কে অপরাধী? দয়া করে সে প্রসঙ্গ আজ আর তুমি টেনে এনো না শিশিরদা। শুধু একটা কথার জবাব আমি তোমার কাছ থেকে জানতে চাই। এই যে আমাদের নির্মম পরিণতি, এতে কি এতটুকু আহত হয়েছো তুমি? এতটুকু বেদনা কি সঞ্চিত তোমার বুকে? আমার এ মূর্খ প্রশ্নের জবাব তুমি না দিলেও আমি তা জানি। কিন্তু শিশিরদা, আমরা যা পেলাম না, পৃথিবীর আর কেউ যদি তা পেতে চায়, তুমি কি তাতে বাধা দেবে? না কি নিজের জীবনে যে শান্তির পরশটুকু তুমি পেলে না, অতি আপন আর একজনের সে শান্তি দেখে তুমি মরতে চাও? তোমার আমার জীবনের এ চরম ব্যর্থতার বেদনা তোমার সবচাইতে প্রিয়জনের বুকেও বাজুক, এখন যাকে তুমি প্রাণের চাইতেও ভালোবাসো, তার জীবনেও এমনি একটা অভিশাপের বোঝা নেমে আসুকÑ এমনটি তুমি নিশ্চয়ই চাইবে না। তোমার মনকে বুঝে এ কথা আজও আমি জোর গলায় বলতে পারি। আর সেটুকু আস্থা নিয়েই তোমার কাছে আজকে আমার এই ভিক্ষার আকুতি।
আজকের জীবনে আমার একমাত্র মণি, আমার কলিজার টুকরো স্বাতী। ও ভালোবাসে ভাস্করকে। এজন্য স্বাতীকে অনেক রকমের শাস্তিই আমি দিয়েছি। কিন্তু যেদিন আমি জানলাম, ভাস্কর তোমার একমাত্র সন্তান, সেদিন থেকে নিজকে যেন বড় বেশি দুর্বলা মনে হয়েছে আমার। স্বাতীকে শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে মা হয়েও যেন ওর বান্ধবী সেজে ওর পাশে দাঁড়াতে আমার সাধ হয়। বারবার মনে হয়, জীবনে যা আমরা পেলাম না, যে অভিশাপের ডালি মাথায় নিয়ে আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি, মা স্বাতী আর বাবা ভাস্কর অন্তত কিছুটা তার প্রায়শ্চিত্ত করুক। রুদ্রদিনের শেষ ক্লান্ত পৃথিবীর বুকে আবার নেমে আসুক নরম রাত্রির একটুখানি প্রশান্তি। আবার ডুবে যাক চাঁদ। একটা ছোট্ট বাসাতে কপোতের বুকে মুখ লুকিয়ে পরম নিশ্চিন্তের সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ুক একটি শ্রান্ত কপোতি। তাদের বাসর সাজাতে আকাশের বুকে মিটিমিটি ফুটে উঠুক এক ঝাঁক তারকার মালিকা। ঝিরঝির ঝরে পড়ুক কয়েক গুচ্ছ শুভ্র শেফালি সবুজ তৃণের শীষে। স্বর্গের প্রশান্তি আকাশ থেকে নেমে আসুক কয়েক ফোঁটা শিশিরের বিন্দু। এক ঝঁক সোনালি আলোর দীপালিতে তার মাঝে জন্ম নিক হাজার মুক্তোর কণাÑ সমুদ্রের মণি-মুক্তো আর হীরে-পান্নার চেয়ে যা অনেক দামি।’