বাংলার প্রথম চিত্র
পূর্ব এবং পশ্চিম দুই বাংলা মিলে যে বাংলার কথা আমরা জানি, সেই বাংলার কোনো সীমারেখা ছিল না গুপ্তদের শাসনামলের পূর্বে। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের বাংলা আক্রমণের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ শাসন শুরু হয় এবং বাংলার মূল চিত্র স্পষ্ট হতে থাকে। চন্দ্রগুপ্তের শাসনামলে মৌর্য সম্রাটরা বৌদ্ধধর্মকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ফলে হিন্দুধর্ম পালন এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের শিল্পকর্ম ও আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি।
বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে সব কিছুই ম্লান হয়ে গিয়েছিল। তবে গুপ্ত স¤্রাটরা এক পর্যায়ে বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুধর্মকেও গুরুত্ব দেওয়া শুরু করেন। এক পর্যায়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের হিন্দুধর্ম পালনেও উৎসাহ প্রদান করেন। ফলে তখন থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের লৌকিক দেব-দেবীর মূর্তি নির্মাণ এবং পূজা শুরু করেন।
পূজা উপলক্ষে পূজা ম-পকে অলংকৃত করার প্রয়োজন দেখা দিলে মেয়েরা এর সমাধানে এগিয়ে আসেন। তারা পূজা ম-পের সামনে চালের গুঁড়ার পিটালীর সাহায্যে আঁকেন মনোমুগ্ধকর রেখাচিত্র। এই চিত্রই আলপনা ‘চিত্র’ হিসেবে পরিচিত। এই আলপনা চিত্রে যে সকল বিষয় স্থান পায় সেগুলো হলোÑ লতা, পাতা, ফুল, শঙ্খ, লক্ষ্মীর পদচিহ্ন, শিশু শ্রীকৃষ্ণের পদচিহ্ন, মাছ এবং পদ্ম-পাপড়ি ও পদ্ম।
আলপনা চিত্রে ব্যবহৃত এ সকল বিষয়ের মধ্যে পদ্ম বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। কারণ পদ্ম বা পদ্ম-পাপড়ি দেব-দেবী পূজার প্রয়োজনে ব্যবহার হতে থাকে। এ কারণে পূজার সঙ্গে পদ্ম এবং পদ্ম পাপড়ির সম্পর্ক হয় সুদৃঢ়। এই আলপনাই ছিল বাংলার লোকায়ত শিল্পচর্চা। লোকায়ত শব্দের অনেক অর্থ রয়েছে। যেমনÑ প্রাচীন হিন্দু দার্শনিক চার্বারের মতানুসারী, নাস্তিক এবং পরলোকে ও ঈশ্বরে অবিশ্বাসী। কিন্তু এগুলোর সঙ্গে আলপনা শব্দের সম্পর্ক সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
এজন্য প্রাচীন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা লোকায়তকে ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে বিবেচনা করেছেন বলে মত পাওয়া যায়। গুপ্ত যুগে শিল্পকলা বলতে বাংলার মেয়েদের সৃষ্ট আলপনাকেই বুঝাতো। এ তথ্য প্রমাণ করে যে, আলপনার শুরু গুপ্তযুগ থেকে। অর্থাৎ ৩২০ থেকে ৫৫০ অব্দের সময়কালে। গুপ্ত স¤্রাটদের এই সময়কালকে বলা হয় স্বর্ণযুগ। কারণ এ সময়কালে আবিষ্কার, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি, বাস্তুবিদ্যা, শিল্প, ন্যায়শাস্ত্র, সাহিত্য, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, ধর্ম এবং দর্শনের ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছিল। হিন্দু সংস্কৃতির যে রমরমা অবস্থা তা সেই যুগেরই ফসল বলে মনে করা হয়।
সুতরাং আলপনার উৎসও যে, গুপ্ত যুগেরই হয়েছে এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না। তবে অনেকেই বলেছেন আলপনার চর্চা ঠিক কোন সময় শুরু হয়েছে তা সঠিক করে বলা যায় না। অনেকে মনে করেন যে, আলপনা ব্রত ও পূজার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং এর উৎপত্তি আর্যদেরও আগমনের পূর্বে। ভারতে সর্বশেষ আগমনকারীরা হচ্ছে আর্যজাতি। সুতরাং তাদের আগমনের পূর্বে যে আষ্ট্রিক জাতি ভারতে বসবাস করতো তাদের কাছ থেকেই পাওয়া গেছে আলপনা চিত্র।
শ্রী অমিত কুমার বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন যে, খ্রিষ্টের জন্মের দেড় বা দুই হাজার বছর পূর্বে অর্থাৎ আজ থেকে চার হাজার বছর পূর্বে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের কাছে আর্য জাতির এক শাখা পশ্চিম পাঞ্জাবে উপস্থিত হয়। অর্থাৎ আজ থেকে চার বছর পূর্বে যে, আর্যদের আগমন ঘটে তারও পূর্বে যারা বসবাস করেছে ভারতে তারাই আলপনা চিত্রের উদ্ভাবক।
গুপ্তযুগের তথ্যে বলা হয়েছে যে, হিন্দু সম্প্রদায় ধর্ম পালনের অনুমতি পাওয়ার পর যে পূজার প্রচলন করেন সেই পূজা উপলক্ষেই আলপনা চিত্রের উদ্ভব। কিন্তু বাংলা পিডিয়ায় বলা হয়েছে যে, কৃষি কাজের উন্নয়ন এবং প্রচুর শস্য উৎপাদনের লক্ষ্যেও অপদেবতাদের বিতাড়নের উদ্দেশ্যে আলপনা চিত্রের উদ্ভব হয়েছে।
আলপনা চিত্রের উদ্ভব বা সময়কাল নিয়ে বিতর্ক থাকলেও আলপনা যে মেয়েরাই আঁকতো এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই। পূর্বেই উল্লেখ করা (এরপর ১৮ পৃষ্ঠায়)
হয়েছে যে, ভিজা চালের গুঁড়ার পিটুলীকে সাদা রং হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে আলপনা আঁকতে। তবে কেউ কেউ হলুদ রংও ব্যবহার করে থাকে সাদা রঙের সঙ্গে। এ ক্ষেত্রে হলুদ বাটা ব্যবহার করা হয়। চালের এবং হলুদের যে রং তৈরি করা হয় তার মধ্যে একটুকরো কাপড় বা চটের টুকরো চুবিয়ে অনামিকা বা কনিষ্ঠার সংলগ্ন আঙ্গুলের সাহায্যে আলপনার রেখাংকন করা হয়।
রেখার সাহায্যে আঁকা এ চিত্র মূলত দ্বিমাত্রিক। এ চিত্র সাধারণত সামাজিক অনুষ্ঠানাদি এবং ধর্মীয় উৎসবে মেয়েরা আলপনার চিত্র অংকন করে থাকেন। গুপ্ত যুগে সৃষ্ট বাংলার প্রথম চিত্র আলপনার পর দীর্ঘ সময় চিত্রকরার আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। কারণ গুপ্ত যুগের পর রাজা শশাঙ্ক ৬০৬ সালে গৌড়ে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেও শিল্প সংস্কৃতির তেমন কোনো সন্ধান মেলেনি।
তাছাড়া রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পর প্রায় একশ’ বছরও কোনো ক্ষেত্রেই উন্নয়নের কোনো কিছু ঘটেনি। ফলে এই একশ’ বছরকে বলা হয় অন্ধকার এবং অরাজকতার যুগ। এই অন্ধকার যুগ পার হয়ে পাল রাজাদের যুগের শুরু হয় এবং এই সময় সর্বক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে। এ সময় তালপাতায় নির্মিত পুঁথি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ সময় এই তালপাতার পুঁথিতেই ছবি আঁকা হয়েছে। অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতক এই সময়কালে পাল রাজাদের সহায়তায় চিত্রের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে।
এসব চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হলো বর্ণ বিন্যাস বা ক্যালিগ্রাফি। অধ্যাপক শ্রীসরসী কুমার সরস্বতী পাল আমলের চিত্রকলা নামক গ্রন্থে ৬০টি পুঁথির কথা উল্লেখ করেছেন। এ সকল পুঁথি অগণিত চিত্রকর্ম দ্বারা সুশোভিত ছিল। বাংলার চিত্রকলা বলতে যা বুঝায় তার যাত্রা শুরু এ সময় থেকেই বলে মনে করা হয়।
শিল্পকলা পারিপার্শ্বিক অবস্থা, উপাদান, ধর্মবিশ্বাস এবং দর্শন দ্বারা প্রভাবিত যে হয়ে থাকে তা গুপ্ত এবং পালযুগের চিত্রে প্রমাণিত। গুপ্ত যুগে দেব-দেবীর পূজা উপলক্ষে সৃষ্টি হয়েছে আলপনা চিত্র। পাল যুগের দিকে দৃষ্টি ফেরালেও দেখা যাবে বৌদ্ধধর্মকে কেন্দ্র করেই বচিত্র হয়েছে চিত্র। পাল যুগে বৌদ্ধ গ্রন্থ অষ্টসহস্রিকা প্রজ্ঞাপাবমিতা এবং বৌদ্ধধর্মের অন্যান্য পুঁথিকে কেন্দ্র করে যে সকল চিত্রের সন্নিবেশ ঘটেছিল সেগুলোকেই পাল পুঁথিচিত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। যার সিংহভাগই গৌতম বুদ্ধের জীবন ভিত্তিক চিত্র। গুপ্তযুগের আলপনা এবং পাল যুগের চিত্রকলা পরবর্তী সময়ে বাংলার চিত্রকলাকে সমৃদ্ধ করতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে।