বাঙালির প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ
বাঙালির প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ যা সর্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। একাত্ম হয়ে মিশে আছে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ থেকে সূচনা হয় বাংলা নববর্ষের। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার হাজারো আয়োজন থাকে। নববর্ষ বাঙালির একটি সর্বজনীন লোক উৎসব। নববর্ষ কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক। অতীতের ভুল-ত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় বাংলাদেশের মতো ভারতের পশ্চিম বাংলায় উদযাপিত হয় নববর্ষ।
এক সময় নববর্ষ পালিত হতো ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। কৃষিকাজ ঋতুনির্ভর হওয়ায় এ উৎসবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কৃষির। তাই কৃষক সমাজের সঙ্গে বাংলা সাল এবং নববর্ষের একটি গভীর আত্মিক সম্পর্ক গ্রথিত প্রোথিত হয়ে আছে ঐতিহাসিকভাবে। কেননা, বাংলা সালের উৎপত্তি হয় কৃষিকে উপলক্ষ করেই।
ঐতিহ্যগতভাবেই বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে সবাই তাদের নিজ নিজ জমিতে চাষ দিত। সব জমিতে একদিনে চাষ দেওয়া সম্ভব নয় বিধায় বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে প্রত্যেকটি জমিতেই এক পাক কিংবা দুই পাক করে লাঙ্গল দিয়ে রাখত। এই রীতির নাম ছিল ‘হাল বৈশাখ’। বর্তমানেও অনেক জায়গায় এই রীতি প্রচলিত রয়েছে। হাল বৈশাখের অংশ হিসেবে বৈশাখের প্রথম দিনে গৃহপালিত গরুকে স্নান করিয়ে কপালে সিদুরের ফোঁটা দেওয়া হয়।
এছাড়া কৃষিতে ব্যবহার হয় এমন উপকরণ, যেমন- লাঙ্গল, জোয়াল, মই ইত্যাদি পরিষ্কার করে পানি দিয়ে ধুয়ে সবগুলোর গায়ে তিনটি সিঁদুরের ফোঁটা দেওয়া হতো। হাল বৈশাখ সম্পন্ন করার পর চাল, ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে খাওয়া হয়। এছাড়া হাল বৈশাখের দিন আরেকটি কাজ করা হয়। সোলা দিয়ে গোল ফুলের আকৃতি তৈরি করা হয়। এই ফুলটি বিভিন্ন রঙের কাপড় দিয়ে সাজানো হয়। এরপর ওই ফুলটি ক্ষেতের মাঝখানে পুঁতে দেওয়া হয়। এরপর ফসলের শুভকামনায় জমির মালিক ফুলটি ক্ষেতের মাঝখানে পুঁতে দিতেন।
বৈশাখপূর্ব বাঙালির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আচার হলো চৈত্রসংক্রান্তি। সংক্রান্তি মানে এক ক্রান্তি তথা এক কিনারা থেকে আরেক কিনারায় যাওয়া। চৈত্র মাসে চৈতালী ফসল উঠে গিয়ে পুরা মাঠই শুকনা খরখরে হয়ে যেতে পারে। এ সময় প্রকৃতিতে কি কি খাদ্য মানুষের এবং অন্য প্রাণীর জন্য থাকে তা জানা দরকার। তাই চৈত্রসংক্রান্তিতে প্রকৃতির খোঁজখবর নেওয়া হয়। চৈত্রসংক্রান্তির খাদ্য তালিকায় কোন মাছ-মাংস থাকবে না, থাকবে চৌদ্দ প্রকারের কুড়িয়ে পাওয়া শাক।
চৌদ্দরকম শাকের মধ্যে থাকে হেলেঞ্চা, ঢেঁকি, সেঞ্চি, কচু, থানকুনি, তেলাকুচা, নটে শাক, গিমা, খারকোন, বতুয়া, দন্ডকলস, নুনিয়া, শুশ্নি, হাগড়া, পাট, সাজনা ইত্যাদি। পরিবেশ-প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের আন্তঃসম্পর্কের বিষয়টি প্রাগৈতিহাসিক। পূর্বে মানুষ বিশ্বাস করত প্রকৃতির মধ্যে অতি-ভৌতিক, জীবনধাত্রী এবং জীবনধারণ করার মতো সব শর্ত বিদ্যমান রয়েছে। এজন্য প্রাগৈতিহাসিক সময়ের মানুষ প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা দেখাত, প্রার্থনা করত। প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা মিশ্রিত চেতনা ছিল বলেই মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সহমর্মিতার সম্পর্ক দৃঢ় ছিল।
কৃষির উৎপাদন পদ্ধতি এবং মানুষের জীবিকার উৎসকে কেন্দ্র করে যে সবাই আচার অনুষ্ঠান সমাজে গড়ে উঠেছিল সেসব উৎসব নানান কারণে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। যদি আমরা আবার স্থায়িত্বশীল কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে পারি, তাহলে কৃষির মাধ্যমে মানুষ ও প্রকৃতি-পরিবেশের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পুনর্প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। যে কৃষি ও প্রকৃতি মানুষের প্রাণ বাঁচায়, সেই কৃষি ও প্রকৃতি যদি বাঁচে তবে তার সঙ্গে জীবনের উৎসবসমূহ বাঁচবে অনন্তকাল।
বাংলা সনের জন্মলগ্ন থেকে নববর্ষের উৎসব বাংলার গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষ এবং কৃষকদের কাছে দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হওয়ায় খাজনার দায় পরিশোধের বিষয়টি না থাকলেও সামর্থ্য মতো সারা বছরের ধার-দেনা পরিশোধ করে নতুন বছরে নতুন জীবন শুরু করার চিন্তা সব কৃষকের মনে থাকে বর্তমান সময়েও। আর সে কারণেই আজো কৃষকরা নববর্ষে বাড়িঘর পরিষ্কার রাখে, কৃষি ও ব্যবহার্য সামগ্রী ধোয়ামোছা করা, গবাদি পশুর জন্য প্রচুর পরিমাণ খাওয়া রেডি রাখা।
সেদিন মাঠে পারতপক্ষে কাজ না করা এবং সকালে গোসল সেরে পুতপবিত্র হয়ে সেজে গুজে দিন অতিবাহিত করা। এদিনটিতে বিশেষ ভালো খাওয়া, ভালো থাকা, ভালো জামা কাপড় পরতে পারা এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে পারস্পরিক সম্প্রীতি বজায় রাখতে পারাকে তারা ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক মনে করে। এদিন ঘরে ঘরে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং পাড়া প্রতিবেশীদের আগমন ঘটে। মিষ্টি, পিঠা, পুলি-পায়েসসহ নানারকম লোকজ খাবার তৈরি ও খাওয়ানোর ধুম পড়ে যায়।
একে অপরের সঙ্গে নববর্ষের বিশুদ্ধ শুভেচ্ছা বিনিময় চলে। এছাড়া নববর্ষকে আরও উৎসবমুখী করে তোলে বৈশাখী মেলা। সর্বজনীন লোকজ এ মেলা অত্যন্ত আনন্দঘন ও উৎসবমুখর আমেজে উদযাপিত হয় দেশের বিভিন্ন গ্রাম-পল্লীতে বটতলায়, নদীর ঘাটে, হাটে, গঞ্জে। অবশ্য শহরাঞ্চলে মেলা বসে নগর সংস্কৃতির আদলে, ভিন্ন আমেজে, ভিন্ন আঙিকে। কৃষকদের নববর্স পালন একটু ভিন্ন আমেজ আর শুভ সুন্দরের বারতা নিয়ে হাজির হয় প্রতি বছর বৈশাখের প্রথম লগনে।
বাংলা নতুন বছরে নতুন অঙ্গীকারে আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ এবং নতুন নতুন প্রযুক্তি ও কলাকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে নতুনভাবে আত্মনিয়োগ করে অধিক ফসল উৎপাদনে। বাংলা নববর্ষে সবার মতো কৃষকরাও আশা করে- প্রতিটি নতুন বছর উপহার দেবে অনাবিল প্রশান্তি, উজ্জ্বল ভবিষ্যত। বাঙালির চিরন্তন উৎসব পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ ও কৃষি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে সুপ্রাচীনকাল থেকেই এবং এখনো টিকে আছে ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিসেবে।