ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৩ বৈশাখ ১৪৩২

বঙ্গবন্ধুর অবদান

আমির হোসেন

প্রকাশিত: ০০:৪৪, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

বঙ্গবন্ধুর অবদান

বঙ্গবন্ধুর অবদান

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলে পাকিস্তানে একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। সে প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। দেশ বিভাগের পূর্বে ছাত্রদের একমাত্র সংগঠন ছিল নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ। ১৯৪৭ সালের আগস্টে এই সংগঠনের প্রচেষ্টায় পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব বাংলার কর্মী সম্মেলনে। এর কারণ ছিল বাঙালির ভাষা কৃষ্টির প্রতি সম্ভাব্য হামলার প্রতিরোধ এবং জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করা।

এরা আগেই অনুমান করেছিলেন মুসলমানদের জন্য দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বদলে এক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতির উপর আঘাত আসবে এবং ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বদলে পাকিস্তানের উপনিবেশ পরিণত হবে। উক্ত সম্মেলনে গৃহীত হয় ভাষা বিষয়ক কিছু প্রস্তাব। প্রস্তাবগুলো পাঠ করেন সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। এভাবেই ভাষার দাবি প্রথমে উচ্চারিত হয়েছিল। (সূত্র : ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা, গাজীউল হক, ভালোবাসি মাতৃভাষা, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অমর একুশে তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশনা উপ-কমিটি কর্তৃক ভাষা-আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি স্মারক গ্রন্থ, ২০০২ সাল।)
ভাষা আন্দোলনের শুরুতে তমদ্দুন মজলিসের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বহুকাজে সাহায্য ও সমর্থন করেছিলেন সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বাংলা ভাষার দাবির সপক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানে অংশগ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন সভা সমাবেশসহ মিছিলে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৪৭ সালের ৫ ডিসেম্বর পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সরকারি বাসভবন তৎকালীন বর্ধমান হাউসে। (বর্তমানে বাংলা একাডেমি) বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক চলাকালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে অনুষ্ঠিত মিছিলে অংশগ্রহণ করেন এবং নেতৃত্ব দান করেন শেখ মুজিবুর রহমান ।
১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে সমকালীন রাজনীতিবিদসহ ১৪ জন ভাষাবীর সর্বপ্রথম ভাষা-আন্দোলনসহ অন্যান্য দাবি সংবলিত ২১ দফা দাবি নিয়ে একটি ইস্তেহার প্রদান করেছিলেন। ইস্তেহারে ২১ দফা দাবির মধ্যে দ্বিতীয় দাবিটি ছিল রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত। এই ইস্তেহার প্রণয়নে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ছিল অনস্বীকার্য এবং তিনি ছিলেন অন্যতম স্বাক্ষরদাতা।

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের ১০ দফা দাবির মধ্যে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার ও সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের নিয়োগ এবং বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষার দাবি ছিল অন্যতম দাবি। পাকিস্তানের জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয় ভাষার দাবিটি। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে পূর্ব বাংলার অন্যতম প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ‘উর্দু-ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার দাবি জানান।’

পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান প্রস্তাবটিকে ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করেন এবং পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন বাংলা নয় বরং উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবি জানান। এ ঘোষণার পর উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলা। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক কর্মীদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এবং ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট ঘোষণা করা হয়।
১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলে তমদ্দুন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়। এই সংগ্রাম পরিষদ গঠনে শেখ মুজিব বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন এবং তাঁর ভূমিকা ছিল যেমন বলিষ্ঠ তেমনি সুদূরপ্রসারী।
১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘটে পিকেটিং করেন শামসুল হক, শেখ মুজিব, অলি আহাদ প্রমুখ। এটাই ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এদেশে প্রথম সফল হরতাল। এই হরতালে শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেপ্তার হন। ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন খাজা নাজিমুদ্দিন।

তার সাথে চুক্তি মোতাবেক সেদিন সন্ধ্যায় শেখ মুজিব প্রমুখরা মুক্তি পান। ওই সময় অন্যান্য বন্দি রণেশ দাশগুপ্ত, ধরণী রায় প্রমুখদের অন্য মামলার অজুহাতে মুক্তি দিতে সরকার অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু ভাষা অন্দোলনের বন্দীরা বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমান বিশেষভাবে চাপাচাপি করলে ১৫ মার্চ রণেশ দাশগুপ্ত ও ধরণী রায়কে বন্দীদের সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেয়া হয়। (বাংলাদেশের ইতিহাস-মোহাম্মদ হান্নান, পৃষ্ঠা-৪২)
১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে এক সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় শেখ মুজিব জালাময়ী বক্তৃতা করেন। সেদিন কোনো মিছিল করার কর্মসূচি না থাকলেও ‘চলো চলো অ্যাসেম্বলি চলো’ বলে শেখ মুজিব এক বিরাট মিছিল নিয়ে অ্যাসেম্বলি হলের দিকে আসর হন। তখন পরিষদের অধিবেশন চলছিল।
১৯৪৮ সালের ১৭ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বানে নঈমুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভায় শেখ মুজিব অংশগ্রহণ করেন। (সূত্র: জাতীয রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫, অলি আহাদ),  ১৭ তারিখে দেশব্যাপী শিক্ষায়তনে ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত করা হয় এবং ঐ দিনের ধর্মঘট অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে।

শেখ মুজিব একজন বলিষ্ঠ প্রত্যয়সম্পন্ন এবং অসম সাহসী যুবনেতা হিসেবে ছাত্র সমাজে এই সময় থেকেই ধীরে ধীরে স্বীকৃতি লাভ করতে থাকেন। শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, নঈমুদ্দিন আহমদ, শওকত আলী, আবদুল মতিন, শামসুল হক প্রমুখ যুবনেতার কঠোর সাধনার ফলে বাংলা ভাষার আন্দোলন সমগ্র পূর্ব বাংলায় একটি গণআন্দোলন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ল। 
১৯৪৯ সালের ১৫ অক্টোবর খাদ্যের দাবিতে ভূখা মিছিলে নেতৃত্বদানের সময় শেখ মুজিব বন্দী হন এবং মুক্ত হন ২০ ফেব্রুয়ারি ৫২ সালে। তবে এ সময় তাঁর মুক্তির দাবিতে পোস্টার, স্লোগান, লিফলেট, স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।
এদিকে টানা ২৬ মাস জেলে থাকার পর অসুস্থ হয়ে পড়ায় শেখ মুজিবকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এখানে বসেই তিনি ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতা তোয়াহা, শওকত মিয়াসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে গোপন বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন ও সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠনকরা হবে। পাশাপাশি ১৬ ডিসেম্বর থেকে কারাগার থেকে মুক্তির জন্যে শেখ মুজিব অনশন ধর্মঘট পালন করবেন বলেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এর দুইদিন পরই শেখ মুজিবকে হাসপাতাল থেকে কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। কারাগারে পৌঁছেই আরেক সহকর্মী মইনুদ্দিনের সাথে আলোচনা করে তিনি কারা কর্তৃপক্ষের কাছে ১৫ তারিখের মধ্যে কারামুক্তি দেওয়ার আবেদন করেন, অন্যথায় ১৬ তারিখ থেকে অনশন ধর্মঘট পালন করবেন বলে দরখাস্ত লিখেন।
১৫ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব ও মইনুদ্দিন দুইজনকেই ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তরের আদেশ আসে। সেদিন রাত ১১টার সময় নারায়ণগঞ্জ থেকে তাদেরকে ফরিদপুর নেওয়ার উদ্দেশ্যে জাহাজে তোলা হয়। পরদিন ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় অনশন ধর্মঘট। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকাসহ সারা দেশেই গোলমাল শুরু হয়। রেডিওতে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন মারা যাওয়ার কথা প্রচার হতে থাকে। ফরিদপুরে সেদিন হরতাল চলছিল।

ছাত্র-ছাত্রীসহ অনেকেই মিছিল করে জেল গেটে এসে স্লোগান দিতে থাকে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ‘বাঙালিদের শোষণ করা চলবে না’ এবং ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’। ২৭ ফেব্রুয়ারি তাদের মুক্তির আদেশ এলে মইনুদ্দিন নিজে পাশে বসে ডাবের পানি খাইয়ে শেখ মুজিবের অনশন ভাঙ্গালেন।
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পাঠ করে জানা যায় যে, ফরিদপুর জেলে অনশন করতে গিয়ে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিলেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমাদের অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে এসেছে যে, যে কোনো মুহূর্তে মৃত্যুর শান্তি ছায়ায় চিরদিনের জন্য স্থান পেতে পারি। সিভিল সার্জন সাহের দিনের মধ্যে পাঁচ-সাতবার আমাদের দেখতে আসেন।

২৫ তারিখ সকালে যখন আমাকে তিনি পরোখ করেছিলেন দেখলাম তার মুখ গম্ভীর হয়ে গেছে। তিনি কোনো কথা না বলে মুখ কালো করে বেরিয়ে গেলেন। আমি বুঝলাম, আমার দিন ফুুরিয়ে গেছে। কিছু সময় পরে আবার ফিরে এসে বললেন, এভাবে মৃত্যুবরণ করে কি কোনো লাভ হবে? বাংলাদেশ যে আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করে। আমার কথা বলতে কষ্ট হয়, আস্তে আস্তে বললাম, অনেক লোক আছে। কাজ পড়ে থাকবে না। দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালোবাসি, তাদের জন্যই জীবন দিতে পারলাম, এই শান্তি।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী পৃ. ২০৪)।
 ১৯৫২ সালের ২৭ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সম্মেলন হয় আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে। অপরাহ্ন আড়াইটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত এই সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, দীর্ঘ আড়াই বছর কারাবাসের পর আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। আপনারা ভাষা সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, আমি তখন কারাগারে অনশণরত।

আপনারা সংঘবদ্ধ হোন, মুসলিম লীগের মুখোশ খুলে ফেলুন। এই মুসলিম লীগের অনুগ্রহে মওলানা ভাসানী, অন্ধ আবুল হাসিম ও অন্যান্য কর্মী আজ কারাগারে। আমরা বিশৃঙ্খলা চাই না। বাঁচতে চাই, লেখাপড়া করতে চাই, ভাষা চাই। রাষ্ট্রভাষার ওপর গণভোট দাবি করে শেখ মুজিব বলেন, ‘মুসলিম লীগ, লীগ সরকার আর মর্নিং নিউজ গোষ্ঠী ছাড়া প্রত্যেকেই বাংলাভাষা চাই। এই সম্মেলনে মোট ২২টি প্রস্তাব দেওয়া হয়।’

১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে যে কর্মসূচী নেয় তা পালনের জন্য আওয়ামী লীগ সম্পাদক শেখ মুজিব নির্দেশ দেন। ঐদিন সকাল থেকে শেখ মুজিবুর রহমান সাইকেলে করে গোটা ঢাকা শহরে টহল দিয়ে বেড়ান এবং মিছিলের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। পরে আরমানিটোলা ময়দানে লক্ষাধিক লোকের সভায় শেখ মুজিব বক্তৃতা দেন। তাঁর অনুরোধে গাজীউল হক নিজের লেখা প্রথম গানটি ‘ভুলবো না’ পরিবেশন করেন।

সভায় অন্যান্য স্লোগানের মধ্যে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, গণপরিষদ ভেঙ্গে দাও, গণপরিষদ ভেঙ্গে দাও, সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক ইত্যাদি এবং চারটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বিস্ফোরণের পর ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে কাজে লাগিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিব সমকালীন রাজনীতি এবং বাংলা ভাষার উন্নয়নে অবদান রাখেন। পরবর্তীকালেও শেখ মুজিব বাংলাভাষা ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের অধিকারের সেই একই দাবি ও কথাগুলো আরও বর্ধিত উচ্চারণে জাতির সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হন।

১৯৫৬ সালের ১৭ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত আইন পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু সংসদের দৈনন্দিন কর্মসূচি বাংলা ভাষার মুদ্রণ করার দাবি জানান। সে সময় এই কর্মসূচি শুধু ইংরেজী ও উর্দু ভাষা সংক্রান্ত প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাও রাষ্ট্রীয় ভাষা হোক’। ১৬ ফেব্রুয়ারি তারিখের আইন সভার অধিবেশনেও তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান।

একই সালের ৭ ফেব্রুয়ারির অধিবেশনে তিনি খসড়া শাসনতন্ত্রের অন্তর্গত জাতীয় ভাষা সংক্রান্ত প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, পূর্ববঙ্গে আমরা সরকারি ভাষা বলতে রাষ্ট্রীয় ভাষা বুঝি না। কাজেই খসড়া শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রের ভাষা সম্পর্কে যে সব শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তা কুমতলবে করা হয়েছে। পাকিস্তানের জনগণের শতকরা ৫৬ ভাগ লোকই বাংলা ভাষায় কথা বলে, এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, রাষ্ট্রীয় ভাষার প্রশ্নে কোনো ধোঁকাবাজি করা যাবে না।

পূর্ববঙ্গের জনগণের দাবি এই যে বাংলাও রাষ্ট্রীয় ভাষা হোক। ১৬ ফেব্রুয়ারি তারিখের আইন সভার অধিবেশনেও তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা করার দাবি জানান।
১৯৭২ সালের পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাংলা ভাষায় প্রণীত সংবিধানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমৃত্যু ভাষার একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে বাংলা  ভাষা প্রচলনের, উন্নয়ন-বিকাশ ও সার্থক ও যোগ্য নেতা ছিলেন বলেই তো বিশ্বের বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায় এবং বাংলা ভাষা ও বাংলা ভাষীদের আর্জাতিক অঙ্গনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।

শুধু দেশের নয় বিশ্ব দরবারে বাংলা ভাষাকে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য ১৯৭৪ সালে ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে যে ঐতিহাসিক নজির সৃষ্টি করেছিলেন তা চিরস্বরণীয় হয়ে স্বর্ণাক্ষরে দেখা যাবে। বিশ্বসভায় ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এইটাই ছিল প্রথম সফল উদ্দেশ্য।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমৃত্যু বাংলা ভাষার একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে বাংলা ভাষার বিকাশে ও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের ক্ষেত্রে সার্থক ও যোগ্য নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই মহান নেতা বিশ্বের দরবারে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায় এবং বাংলাভাষা ও বাংলাভাষীদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। 
লেখক : প্রাবন্ধিক

×