বাংলাদেশের অনেক উৎসব রয়েছে কৃত্যাচার কেন্দ্রিক। অর্থাৎ বিশেষ উপলক্ষে, যেমনÑ জন্মাষ্টমী কিংবা মহররম। কিন্তু মুসলমানদের জন্য দুটি ধর্মীয় উৎসব ঈদ যুক্ত রমজান মাসের এক মাস রোজা রাখার সঙ্গে, যাÑ ঈদুল ফিতর এবং আরেকটি পবিত্র হজব্রতের সঙ্গে, যাÑ ঈদুল আজহা। শাওয়াল চাঁদের প্রথম দিবসে রমজানের রোজা ভঙ্গের উৎসব ঈদুল ফিতর। আর জিলহজ চান্দ মাসের ১০ তারিখে কোরবানি উৎসব ঈদুল আজহা।
গ্রাম-বাংলায় দুটি ঈদেরই আনন্দ উৎসবে এসেছে পরিবর্তন। টেলিভিশনের প্রবেশ যখন গ্রাম-বাংলায় ঘটেনি তখন রেডিও ছিল ইলেকট্রনিকস মিডিয়ার সংবাদ শোনা ও বিনোদন উপভোগের একমাত্র অবলম্বন। ঈদুল ফিতর উদযাপন করার জন্য ঈদের আগের দিন সবাই অপেক্ষায় থাকত সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে কখন রেডিওতে নজরুলের গানটি বেজে উঠবেÑ ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন্ আসমানি তাগিদ।/তোর শোনা-দানা বলাখানা সব রাহেলিল্লাহ।/দে জাকাত মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিদ। আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে॥/যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ॥/আজ ভুলে যা তোর দোস্ত ও দুশমন হাত মিলাও হাতে॥/তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ^ নিখিল ইসলামে মুরিদ॥/ঢাল হৃদয়ের তোর তশ্তরিতে র্শিনি তৌহিদের।/তোর দাওয়াত কবুল করবে হজরত হয় মনে উম্মীদ॥’ ওই গানটি শিশু-কিশোরদের মাঝে ঈদ উৎসবের অন্যরকম আনন্দ উৎসব ছিল। ঈদুল আজহার আগের দিন রেডিওর মাধ্যমেই জানা যেত আরবে ঈদ উৎসব পালিত হয়েছে।
ঈদ মানে খুশি, আনন্দ, উৎসব। এই আনন্দ গ্রাম-বাংলার শিশু-কিশোরদের পোশাক-আশাকে প্রকাশ পেত। প্রকাশ পেতো হৈ-হুল্লোড়, লোকমেলা এবং বাড়িতে খাবার-দাবারের আয়োজনের মাধ্যমে; এখনো পাচ্ছে। তবে সময়ের সঙ্গে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে পরিবর্তন ঘটেছে বিস্তার। একসময় ঈদ এলেই শিশু-কিশোরদের জন্যে তৈরি হতো কাগজের রঙিন টুপি। আমরা গত শতকের আশির দশক পর্যন্ত কাগজের টুপির প্রচলন দেখেছি। বর্তমানে নেই বললেই চলে। গ্রামের শিশু-কিশোরী থেকে শুরু করে বয়স্ক নারীরাও পা ও আঙুল সাজাতো আলতায় এবং নখ পালিশ ব্যবহার করত হাতের-পায়ের নখে। অনেকেই নখ রঙিন করত মেহেদী পাতায়। বর্তমানে আলতার প্রচলন নেই বললেই চলে। গ্রামে এক ধরনের ফেরিওয়ালার দেখা মিলত। এক ধরনের ছোট পুটলি অর্থাৎ নাপা টেবলেটের সাইজে এক প্রকারের রঙিন পুটলি ফেরিওয়ালা বিক্রি করতেন। ওই পুটলি গুলিয়ে আলতা তৈরি করা হতো।
লোকবাংলার ঈদ উৎসব মানেই সকালে ঢেঁকিতে কুটা চালের গুঁড়ার রুটি ও চালের গুঁড়ার হাতে তৈরি সেমাই পিঠা এবং ঈদের মাঠ শেষে কিশোর-কিশোরীরা এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি ঘুরে বেড়ানো। আর সেমাই রুটি খাওয়া। বর্তমানে গ্রাম-বাংলায় চালের গুঁড়ার সেমাই পাওয়া ভার। ঈদের খুশি মানে নতুন জামা, নতুন পাঞ্জাবি, নতুন শাড়ি, নতুন ফ্রক, সালোয়ার কামিজ। তবে নতুন কাপড়গুলো সুন্দর করে ভাঁজের জন্য ছিল চিরায়ত কৌশল। ইস্ত্রি করার জন্য লন্ড্রি তেমন ছিল না। থাকলেও ভিড় ভাটটা এবং টাকার জন্যই চিরায়ত কৌশল ব্যবহার করা হতো। জামা-কাপড় ভাঁজ করে বালিশের নিচে রেখে ঘুম যেত শিশু-কিশোররা। বালিশের নিচে মাথার চাপে সারারাত ধরে থাকায় একটি সুন্দর ভঁাঁজ তৈরি হতো পরার কাপড়ের। আবার কেউ কেউ পিতল বা কাসার ঘড়ায় গরম করা কয়লা ঢুকিয়ে সেই গরম হওয়া ঘড়া কাপড়-চোপড় ইস্ত্রি করে নেওয়া হতো।
সময়ের প্রয়োজনে তা আর করা হয় না। বর্তমানে বিদ্যুতায়নের ফলে লোকবাংলায়ও বিদ্যুতে সমৃদ্ধ। সবার ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় আগেকার দিনের লোকায়ত জ্ঞানের যে ইস্ত্রি তা আর প্রয়োজন হয় না তাছাড়া এখন তো হাটে বাজারে বিদ্যুতিক ইস্ত্রি বা লন্ড্রি ঘরের অভাব নেই। ঈদুল আহজার যে কোরবানি উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ছিল, যে গরু বা ছাগলটিকে কোরবানি দেওয়া হবে তার পরিচর্যা করা। ঈদের তিন চার দিন বা দুই-তিন দিন আগে যদি কেনা হয়ে যেত তাহলে তার কাছে গিয়ে একটু আদর করা, গোলস করানো এসবে খুবই মজা পাওয়া যেত। ছাগলকে কাঁঠাল পাতা খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে শিশু-কিশোরদের আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। সম্প্রদায়িক-সম্প্রীতির যে বন্ধন তার পাশাপাশি অন্যতম আরেকটি বিশেষ দিকের কথা বলতেই হয় ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ ঘোচানো হয়ে যেত কোরবানির মাংস বিতরণের মধ্য দিয়ে। আমার আব্বার কাছে শুনেছি। আমাদের ময়মনসিংহের ঈশ^রগঞ্জের খৈরাটি গ্রামের যে ঈদগাটি আছে এখানে সবার গরু জবাই করা হতো। পাড়ার বা গ্রামের যারা কোরবানি দিতে পারতো না, তাদের জন্যও সমানভাবে গোস্ত বণ্টন করে দেওয়া হতো।
এমন প্রতিবেশীবান্ধব সংস্কৃতি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে লোকবাংলায়। এরই ধারাবাহিককতার রেশ বাড়িতে বাড়িতে কোরবানি দেওয়া জনদের মধ্যে দেখা যেত বেশ কিছুকাল। (এরপর ১৮ পৃষ্ঠায়)
কোরবানির তিন ভাগ গোস্তের এক ভাগ বণ্টন করে দেওয়া হতো দরিদ্রদের মধ্যে। কিন্তু এমন পরম্পরাও আর নেই। বণ্টন হয় তবে তা ঘরের ভেতর নেওয়ার পর। গ্রাম-বাংলায় ঈদের মেলা বসত ঈদকে কেন্দ্র করে। তবে ঈদের মেলা বর্তমানে তেমন চোখে পড়ে না। লোকবাংলার প্রাণ বিভিন্ন উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করে লোকমেলা। আবার লোকবাংলার ঐতিহ্য ঈদ লোকমেলার ঐতিহ্যের পুনর্নির্মাণ হতে পারে। লোক-পোশাকের যে ঐতিহ্য তাকে আবার ধরে রাখা সম্ভব এই মেলার মধ্য দিয়ে।
ঈদ উপলক্ষে হা-ডু-ডু খেলার দারুণ প্রচলন ছিল। এপাড়া বনাম ওপাড়া, ওমুকের দল বনাম তমুকের দল, বিয়াত্য বনাম অবিয়াত্য (বিবাহিত বনাম অবিবাহিত)Ñএসব বিভিন্ন নামে দল বিভাজন থাকত। বিনোদনের অন্যতম খোরাক জোগাত গ্রাম-বাংলায় হা-ডু-ডু। বর্তমানে খুব একটা চোখে পড়ে না। গ্রাম-বাংলার সিনেমার হলগুলোর সামনে ঈদ উপলক্ষে বিশেষ সিনেমার বড় বড় ব্যানার টানানো থাকত। সিনেমা ব্যানার আর্টিস্টদের হাতে আঁকা সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলোর ছবি বিশেষভাবে আকর্ষণ করত। ফলে কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে সবধরনের বয়সের লোকদের ঈদ উপলক্ষে সিনেমা দেখার হিড়িক থাকত। বর্তমানে মোবাইলেই বিনোদনের নানান উপকরণ দেখতে পাওয়া যায়। উপলক্ষের সিনেমা আর দেখা হয়ে ওঠে না গ্রাম-বাংলার মানুষের।
অবশ্য মানতেই হবে এখনো লোকবাংলার ঈদকে আনন্দমুখর ও উৎসবে পরিণত করে রেখেছে শহর থেকে গ্রামমুখী মানুষেরা। মধ্যবিত্ত ও নি¤œমধ্য শ্রেণির অনেক মানুষ শহরে চাকরি বা ব্যবসা সূত্রে বসবাস করলেও নাড়ির টান থেকে গেছে গ্রাম-বাংলাতেই। ফলে আমরা দেখবÑপরিবার-পরিজন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ঈদ করতে ছুটে গেছেন তারা। শিশু-কিশোররা গ্রামের বাড়িতে দাদা-দাদি ও নানা নানির সঙ্গে ঈদ আনন্দে যুক্ত হচ্ছে।
এই সময়ের গ্রাম-বাংলায় ঈদ আনন্দকে উপভোগ করতে ছুটে যাওয়া মানুষদের মধ্যে অন্যতম একটি পেশাজীবী শ্রেণি হচ্ছে গার্মেন্টস শ্রমিক। মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামীর বাড়ির বা স্ত্রীর বাড়ির লোকজনরাও অপেক্ষায় থাকেন তাদের নিয়ে ঈদ করার জন্য। গ্রাম-বাংলায় ঈদ উৎসব পালনের পরিবর্তন ঘটেছে সত্য কিন্তু আনন্দ উৎসবের কমতি ঘটেনি।