যে কয়টি মানবধারা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে বিবর্তনে যুক্ত হয়েছিল তার শেষ দুটি ধারার একটি নিয়েনডার্থাল আর অন্যটি হোমোসেপিয়ান বা বর্তমান মানুষ। একসময় নিয়েনডার্থালরা বেঁচে থাকার লড়াইতে হোমোসেপিয়ানদের কাছে হেরে হেরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হয়তো রেখে গেছে তাদের কিছু প্রত্নচিহ্ন হোমোসেপিয়ানদের মধ্যে। কিন্তু রয়ে গেছে বাঁচার লড়াই মানে টিকে থাকবার সংগ্রাম একই রকম। নিয়েনডার্থালদের হারিয়ে হোমেসেপিয়ানদের বাঁচার লড়াইয়ে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে এবং তারপর সে সব টপকে আজকের রাষ্ট্রে আর রাষ্ট্রের লড়াই জাতিতে জাতিতে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক লড়াই অব্যাহত আছে ধারার নব নব বদলে। আজ হোমোরা নিজেরাই নিজেদের পক্ষ এবং প্রতিপক্ষ। তাই মানুষকে লড়াইটা করতেই হচ্ছে, রাষ্ট্রের জন্যে, নিজ অধীনতা অর্জনের জন্য, জীবন ধারণের যুক্তিসঙ্গত বিধির জন্য, মানুষ হিসেবে মুক্তির প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে। আজ স্বাধীনতা কথাটি সামগ্রিক, একটি শব্দের মধ্যেই রয়েছে ব্যক্তির ব্যাস্টির সকল মৌলিকগুলো। সে কারণেই ব্যক্তি এককের আকাক্সক্ষা যখন ব্যস্টির আকাক্সক্ষায় ছড়িয়ে পড়ে তখন গোষ্ঠীর স্বার্থ ক্ষীয়মান হয় এবং সমস্টি তার স্বভাবসুলভ আচরণ দ্বারা তা অস্বীকার করতে শুরু করলে লড়াইটা অনিবার্য হয়ে পড়ে। এই লড়াইয়ে যখন ব্যস্টি জিতে যায় তখন তাকে আমরা বিজয় বলি, এই বিজয় কেবল মাত্র একটা গোষ্ঠীর আধিপত্যের অবসানের বিজয় নয়, বরং তার ইচ্ছে, শাসন শোষণ খর্ব করে সংগঠিত হয় একটি জাতি যাঁরা আগামীর। এখানে নির্মিত হয় তার সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিশ্চয়তার সকল বিধানগুলো।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমরা যে জিতেছিলাম তারও লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা। সে স্বাধীনতা ভূখণ্ডগত কেবল নয়, সামগ্রিক জীবন ক্ষেত্রের মুক্তির। ১৬ ডিসেম্বর সেই বিজয়ের মাস একটি অপশাসনকে হঁটিয়ে একটা নতুন সমাজের প্রবর্তনার এক মহান দিন। কিন্তু বেদনাদায়ক হলো এই দিনটির তাৎপর্যে এক ধরনের ‘মেলা মেলা’ ভাব আরোপের মধ্যে আটকে জাতীয় অনুভব থেকে অন্যসব বিজয়ের ক্ষেত্রের প্রয়োজনীয়তাকে আড়াল করে ফেলেছে। বড় অভাব প্রকৃত সংস্কৃতির চর্চার এবং ঐতিহ্যকে নবায়নের মধ্য দিয়ে শক্তিশালী জাতীয় সংস্কৃতির বোধ তৈরি করার। গণমানুষ এক অপসংস্কৃতির জোয়ারের তোড়ে তার নিজ সংস্কৃতির শক্তিটাও পরখ করতে পারেনি। অপসংস্কৃতিতে কেবলমাত্র গণমানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, বরং সংস্কৃতির কর্মীরাও তার অসুখে অসুস্থ থাকে এবং রুগ্ন পিতার মতো রুগ্ন সংস্কৃতির উন্মেষ ঘটায়, যা জাতিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করে। তোষণ পোষণ ভরণাকাক্সক্ষার চেতনায় লেখক শিল্পী কবি সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা ভুলে গেছে প্রকৃত তাৎপর্য বিজয়ের। এ বিজয় যে তাঁর প্রকাশের অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে, নতুন দেশ নতুন মানুষ নতুন সমাজ গড়ার সুযোগ এনে দিয়েছে এবং এমন কী বিদ্রোহ প্রকাশ যোগ্য হবার অধিকার নির্মাণ করেছে তা তারা ভুলে গেছেন সুবিধা হাতিয়ে নেয়ার লোভে। লোভে যে সৃষ্টি হয় তা খোড়া, ল্যংড়া, খোজা, অন্ধ; তা’ দিয়ে নতুন স্বপ্ন নির্মাণ কখনও সম্ভব নয়। অথচ এই দীনতাকে নিয়েই প্রতি বছর কত সাহিত্য কবিতা সঙ্গীত রচিত হয়, কিন্তু কোনো কিছুই মানুষের মনন জগতে লাগসই চিন্তার বৃত্ত তৈরি করে না। ফলে বিজয় দিবস একদল পুঁজিপতিদের করায়ত্ত থেকে তার বাণিজ্যিক সুবিধাকে সম্প্রসারিত করে। অবশ্যই এটা জাতির জন্য দুর্যোগের কারণ সংস্কৃতির কর্মকাণ্ড থেকেই সে শেখে পড়তে. লিখতে, জানতে, বুঝতে, অনুধাবন করতে এবং চিন্তাকে সম্পসারিত করে নিজের দিকে তাকাতে নিজেকে পুনরাবিষ্কার করতে। একটি ভাল সাহিত্য যেমন আনন্দের পরিচায়ক তেমনি সে একটি জীবন-সমাজ বুঝবার জানবার এবং ইতিহাস লগ্ন হবারও উপকরণ। একটি কবিতা যেমন নন্দনের তেমনি ভাষা ও জীবনের বহুমাত্রিকতা দেয়ারও প্রকৃষ্ট উদহরণ। সাহিত্য থেকে আমরা সমাজজীবনের যত গভীর বিষয়কে অবলোকন করতে পারি, চিনতে পারি জানতে পারি সম্ভবত অন্য কোন উপকরণ থেকে তা’ হৃদয়ঙ্গম করতে পারি না। সাহিত্য সংস্কৃতিরই একটি জোরালো অংশ। এর মধ্যদিয়ে একটি জাতি তাকে অধীন করার শক্তিকে চিনতে পারে। শিল্প-সাহিত্যের অনুরক্ততা জ্ঞানার্জনের আকাক্সক্ষাকে জাগ্রত করে ন্যায়ের অনুসন্ধানে, ন্যায় এবং অন্যায়ের বিভাজন রেখা নিজ বোধের কাছে স্পষ্টাকরণের শক্তির নির্মাণ করে। একটি ভালো কবিতা, একটি বিপ্লবী শিল্প, একটি বিপ্লবী নাটক, কিংবা সঙ্গীত যাতে জীবন বোধ আছে, পশ্চাতচিন্তা অপসারণের সুযোগসহ স্নিগ্ধ হবার উপায় আছে, হৃদয়কে তৃপ্ত করার অনুষঙ্গ আছে যা আমাদের সমাজের ঐতিহ্য লগ্ন এবং নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টির পথে সংযোগ ঘটায় বিজয় তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, স্মরণ করিয়ে দেয় মানুষকে তার বীরত্ব তার সাহস এবং যুক্ত করে ইতিহাসে।
মানুষ কেমন করে মানুষ এ প্রসঙ্গটি খুব একটা অমীমাংসিত নয় এখন, কারণ মানুষ ভাবতে পারে, মানুষের উষ আছে। দেকার্ত বলেছিলেন আমি যে বেঁচে আছি তা অনুভব করতে পারি কারণ আমি চিন্তা করতে পারি। মানুষ কেবল মানুষ নামক প্রাণিই নয় তার মধ্যে ভাষা আছে, ভাষায় প্রকাশ আছে, পরিপাশর্^ বদলাবার উদ্যম আছে। কেউ কেউ মনে করেন সমাজবদ্ধ হবার পর মানুষ সমাজবদ্ধ জীবের প্রত্ন নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। ফলে জন্মের পরের স্তরগুলো সে অনায়াসে স্ব-সামাজের সামাজিক জীব হিসেবেই অতিক্রম করতে পারে। হতে পারে এ কারণেই মানুষ সামাজিক জীব এবং পরবর্তী জীবন প্রবাহে সে সমাজ দ্বারাই পরিপুষ্ট হয়। সাহিত্য একজনের প্রকাশ আর এই প্রকাশ মুক্ত স্বাধীন গতিময় হলে তা’ মানুষের সম্পদ হয়ে ওঠে। একটি প্রকৃত সাহিত্যে অতিরঞ্জন থাকতে পারে শিল্পের নিয়মে কিন্তু তার পরিমিতি যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন সাহিত্যিকের সৎসাহস। জাতিগতভাবে যে সাহস ’৭১ আমাদের মানুষেরা দেখাতে পেরেছিল শিল্পী সাহিত্যিকরা সে সাহসের কথা ভুলে গেছে এবং তারাও তাদের স্বার্থপরতার সৃষ্টি দিয়ে জনগণকেও ভুলে যাবার আবর্তে ফেলেছে। ফলে চর্চার ক্ষেত্রে এক মুখিনতা প্রবল হয়ে বিশ^-সাহিত্যের গতিধারা থেকে বহুতর দূরে আমাদের সাহিত্য দাঁড়িয়ে আছে। যে দিতেও পারছে না নিতেও পারছে না।
যদিও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সমাজ-রাজনীতি লগ্ন হয়েই বেড়ে ওঠে, কিন্তু কখনও কখনও ব্যক্তিবোধ, অনুভব, চেতনাজাত উপাত্ত হয়ে উন্মুক্ত করে নতুন চেতনার জগত যা ঋদ্ধি দেয় বে-পথগামী সামাজিক চেতনাকে। আলোড়িত করে, নতুন ভাবনার জন্ম দেয় এবং মানুষকে নতুন ভাবনায় যুক্ত হতে প্রেরণা জোগায়। সে কারণে আমরা দেখি গ্রীক সমাজ পিছিয়ে থাকলেও তার শিল্প-সাহিত্য অকল্পনীয়ভাবে সেই সমাজের সেই সময়ের গর্দভজাত চিন্তা থেকে অনেকখানি অগ্রসরমানতায় এগিয়ে এনেছিল। অয়নীয়রাই ছিল এ ক্ষেত্রে অগ্রপথিক। আমরা দেখি তলেস্টয় কৃষকের দুর্বিসহ জীবনকে সাহিত্যে যথাযথভাবে চিত্রায়িত করার ফলে রুশ সমাজজীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। সংস্কৃতির কাঠামোর মধ্যেই ধর্ম-দর্শন-আইন, সাহিত্য, শিল্প আবর্তিত হয়। রাজনীতি যদি হয় স্বৈরতান্ত্রিক জনগণস্বার্থ অলগ্ন এবং ইচ্ছেবৃত্তির, সেখানে অন্যায় অনিয়ম নীতিহীনতার ওপর থেকে নিচে গড়িয়ে সব কিছুকে কলুষিত করে। আর তার প্রভাবে গোটা সমাজের পারস্পরিক স্বার্থ ছিঁড়ে গিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ প্রবল হয়ে ওঠে। ঝড়ের প্রবল দাপটে যেমন ঘরবাড়ি গাছগাছালি উপড়ে উড়ে ওলটপালট হয় তেমনি জনজীবনের ঐতিহ্যবাহী বিশ^াসগুলো, মূল্যবোধগুলো, ন্যায়গুলো, নিয়মগুলো টুকরা টুকরা হয়ে নানা চাপে তাপে লোভে বাষ্প হয়ে যায়। ফলে একদিকে ভোগ চূড়ান্তরূপ পায় আর অন্যদিকে মানুষ নিঃস্ব হয়ে ঠিকানা খোঁজে। অন্ধবিশ^াস, কুসংস্কার, নিয়তি নির্ভরতা বাড়ে এবং পুরোহিতদের স্বার্থান্ধতাও মানুষকে মোহাবিষ্ট করে মূল ধর্মবিশ^াস থেকে বিচ্ছিন্ন করে, সে বিচ্ছিন্ন হয় তার নিয়মাচার থেকে, আর তা তকে সুন্দর থেকে সরিয়ে নানা সংস্কারপ্রিয় রোবটে পরিণত করে। ফলে একদল লোক অন্যকে উসকায় এবং ভ্রান্তিকে ঈশ^রের নির্দেশ বলে চাপিয়ে পুণ্য হাসিল করতে চায় [সে পুণ্য মূলত অদৃশ্য স্বার্থের, সে ধর্মকে পণ্য করে]। আর এগুলোও সংস্কৃতির পরিপুষ্টতাকে জীর্ণ করে। অথচ সংস্কৃতির মধ্যেই পরকালের বোধ ন্যায় হয়ে মিশে আছে। আর এসব ঘটে পরিকল্পিতভাবে রাজনৈতিক পরিকল্পনায়। কারণ বিভ্রান্ত করো, শাসন করো, শোষণ করো, লাঠাও পিটাও ও বিচ্ছিন্ন করো, সংঘশক্তির বিলোপ ঘটাও, যাতে তারা সংঘবদ্ধ হতে না পারে, ফিরেও তাকাতে না পারে। তাদেরকে স্বাধীনতার কথা বলো এবং স্বাধীনতা আকাক্সক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন করো। তৈরি করো এমন এক স্বাধীনতা যাতে সে আছে, সে ভাবে সে আছে, অথচ জানে না স্বাধীনতা আসলে কি? স্তবস্তুতিকারী বেছে নাও কতিপয় বুদ্ধিবৃত্তিক সম্প্রদায় থেকে, সুবিধা দাও, মেডেল দাও এবং তাদেরকে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করো আগামী প্রজন্ম।
বিজয় যদি কেবল কতক লোককে হটিয়ে কতক লোককে ক্ষমতাসীন করে তার খড়গের তলে মাথা নুইয়ে দেয়া তা হলে তা হয়ে পড়ে অর্থহীন। অথচ বিজয় অর্জনকালে গণচেতনার রূপটি ছিল আধুনিক এবং গতিময়। সাহিত্যিকদের যে স্বপ্ন নিয়ে তখন থেকে শুরুর প্রয়োজন ছিল তা না ঘটার ফলে পরিস্থিতিটা বিপরীত দিকেই গেছে। শুধু অনুষ্ঠান থেকে মানুষ মনে রেখেছে বিজয়, কিন্তু প্রকৃত তাৎপর্য হারিয়ে হয়ে আছে কতোগুলো পোস্টার কয়টা টিভি নাটক এবং কয়টা বিজয়দিবস সংখ্যার উদ্বোধন। প্রয়োজন নেই এসবের তা সত্য নয়, রয়েছে কিন্তু প্রকাশটা তার বন্দনার হলে তো চেতনার বৈপ্লবিক উত্তরণ বিকলাঙ্গ হয়েই থাকবে। অথচ বিজয় মানেই সব কিছুর উপর বিজয় আর্জন নতুন নির্মাণে শারীরিক, মানসিক প্রস্তুতি। আবর্জনাকে চিহ্নিত করা সংস্কৃতি কর্মীর কাজ তার সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। অথচ এই আবর্জনা আজ চারপাশে আদর্শ হয়ে আছে। এদের কারো কারো একটা অতীত ছিল, আজ আর তার অবশিষ্টটুকু নেই, অথচ সেই অতীতটাই তাদের তোষামোদের দরজায় প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে।
এখন আদর্শই যদি না থাকে, কি লিখছি কেন লিখছি, আমার লেখা দ্বারা আমার মতপ্রকাশের দ্বারা রাষ্ট্রশক্তিকে কতটা সচেতন করতে পারছি, কতটা অধিকারের প্রশ্ন কতটা কর্তব্যের সামাজিক দাবি সেই ভাবনালোকে কতটা সহায়তা দিচ্ছি, বা কিভাবে দিতে পারবো, কোন পদ্ধতিতে লেখাগুলো মানুষের হৃদয়কে জাগরিত করবে, ভাবতে বুঝতে সহায়তা দেবে, জানতে অনুসন্ধানে যুক্ত হতে প্রেরণা হবে এবং সত্য ও মিথ্যের প্রভেদরেখাকে ছুঁইতে পারবে এই অনুসন্ধান সকল নির্মাণে প্রতিফলিত না হলে বিভ্রন্তির প্রকাশই ছড়িয়েই পড়বে কাব্যে শিল্পে আনন্দে। ক্ষীণ হয়ে আসবে সম্ভাবনার সাহিত্য বা সৃজনশীল কাজ। এই প্রস্তুতির দায়িত্বটা নিতে হবে আজ সকল পর্যায়ের সংস্কৃতি কর্মীর, গড়ে তুলতে হবে স্বাধীন সংস্কৃতির আন্দোলন।