ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ৯ মাঘ ১৪৩১

বিশেষ সংখ্যা

বিশেষ সংখ্যা বিভাগের সব খবর

একাত্তরের দেশান্তরী

একাত্তরের দেশান্তরী

ডিসেম্বর মাসের কোন একদিন। মেলবোর্নেরই এক বাড়িতে দাওয়াত। খাওয়া-দাওয়া শেষে কয়েকজন নারীর আলাপে, গল্পে মুক্তিযুদ্ধের কথা উঠলো। কেউ কেউ তাদের ছোটবেলায় ঘটে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর টুকটাক। স্মৃতি নাড়াচাড়া করছিলেন। কেউ বা মুক্তিযুদ্ধের ওপর দেখা কোন সিনেমা অথবা পড়া কোন বইয়ের কথা বলে যাচ্ছিলেন। একজন একটাও কথা না বলে চুপচাপ বসেছিলেন। অন্য কেউ তাকে উদ্দেশ করে বললেন -আপনি কিছু। বললেন নাতো? -আমি তো তখন স্কুলে; তেমন কিছুই জানি না আরেকজন রসিকতা করে বললেন হযরত মোহম্মদ (সঃ), গ্যালেলিও, সক্রেটিস, শেক্সপিয়ার তারা আমাদের জন্মেরও আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাদের কথাও কমবেশি আমরা জানি, তাই না? এই আলাপচারিতা কানে যাওয়াতে মনে হলো যে মুক্তিযুদ্ধের কথা জানার জন্য বয়স লাগে না। নিজে যুদ্ধে যেতে পারেনি, বয়স কম ছিল তাই কোন অভিজ্ঞতা অর্জন হয়নি। তাই বলে নিজের দেশের মুক্তিযুদ্ধকে জানবে না এটা কেমন কথা? আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা নানা বইয়ে নানা ভাষায় বলা হয়েছে, এখনও হচ্ছে। আপামর দেশবাসীর সেই ভয়ঙ্করের মুখোমুখি কাটানো নয়মাস ছিল যাতনা আর বিষাদের। তার কতটুকুই বা সবার জানা হয়েছে বা কতটুকুই। বা সবাইকে জানানো হয়েছে। একেক জনের এক এক রকম দুঃস্বপ্ন আর কষ্টের মাঝে কাটানো কাল। অনেকরই জানতে মন চায় কার কেমন কেটেছে নয়মাস। কেউ চাইলে জানতেও পারে। যুদ্ধের সময়ে মার্কিন কবি আলেক্স গিন্সবার্গের ভারতের শরণার্থী শিবির ভ্রমণ শেষে লেখা কবিতা ‘এ্যালং দ্য যশোর রোড’, মৌসুমী ভৌমিকের গাওয়া গান আছে ওই কবিতা নিয়েই, তারপর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ রুমির মা জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’, শব্দসৈনিক এম.আর. আখতার মকুলের ‘আমি বিজয় দেখেছি’ আরও কত কত কথা ও গাঁথা আমাদের পরিচয় করায় নিষ্ঠুর ও নির্মম বাস্তবতার সাথে। পশ্চিমা পাকিদের দূরভিসন্ধিমূলক মনগড়া ধারণা আমরা বাঙালীরা যথেষ্ট মুসলমান না। তাই। ধর্ম রক্ষার বাহানায় আমাদের শায়েস্তা করতে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ে ১৯৭১ সালের কালো রাত্রে। তারিখটা ছিল ২৬ মার্চ। ওইদিন সপ্তাহের কি বার ছিল সাধারণ মানুষের ততটা মনে রাখার কথা নয়। তবে সন, মাস, তারিখ জানা ইতিহাসের দাবি তাই ইতিহাসবিদ জানেন অবশ্যই। তারপরের দিন থেকেই দেশের মানুষ যে যার কর্তব্য ঠিক করে ফেলে।। মায়ের ছেলেরা যুদ্ধে যায় মুক্তি ছিনিয়ে আনতে। এদিকে অধিকৃত দেশে ঘরে ঘরে মায়েরা ছোটদের নিয়ে আল্লাহর কাছে দিবারাত্রি দেশের জয়, স্বস্থি ও শান্তি চেয়ে প্রার্থনা শুরু করেন। মানুষের মুখে শুনে, বইপত্র পড়ে ওই দিনগুলোর কথা বিস্তারিত জানার আগ্রহ অনেকের মতো আমারও। ইচ্ছা দুরন্ত ছিল দেখে একজন পরবাসেও ভালবেসে একটা বই পড়তে দিয়েছিলেন আমাকে। বইটি একজন ইতিহাসবিদের রচনা। বইটিতে ২৬ মার্চ বৃহস্পতিবার ছিল বলে জানতে পারি। পরদিন ২৭ মার্চ ছিল শুক্রবার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক, গবেষক ও স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস প্রণয়নের জন্য গঠিত প্রামান্যকরণ কমিটির সভাপতি ডঃ মফিজুল্লাহ কবীর তার বইতে লিখেছেন ওই শুক্রবারে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় থেকেও ঢাকার মসজিদ থেকে জুম্মার আজান ধ্বনি শুনতে পায়নি মানুষ। কি পরিহাস! ধর্ম রক্ষার নামে ওরা আজানকেই স্তব্ধ করে দিয়েছিল ওই শুক্রবারে। কারফিউ জারি ছিল শহরে। তাতে মুসল্লীদের জুম্মার নামাজে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পুরো বইতে চাক্ষুষ দৃশ্যগুলো বিবৃত হয়েছে নিখুঁতভাবে। সততার সাথে নিজস্ব ভীতিকর অনুভূতিও তুলে ধরেছেন ইতিহাসবিদ শিক্ষক। দুঃসহ দুর্গতির দিনগুলোতে কিছু লিখবেন বলে একটি চটি খাতা কিনে এনেছিলেন। তার মলাটে বাংলাদেশের জনক শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি ও তার দলের প্রতীক নৌকার ছবি ছিল।। লেখকের। ভীত স্ত্রী তাকে মলাটটি ছিঁড়ে ফেলতে অনুরোধ করেন। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অনবরত পাক আর্মি টহল দিয়ে যাচ্ছিল। ওই দিনগুলোতে আল্লাহর কাছে অধ্যাপক নিজস্ব বাক্যাবলী দিয়ে প্রতিরাতে একটি প্রার্থনা করতেন। প্রতি রাতেই তিনি নিজস্ব বন্দনাটি বাংলায় লিখতেন আবার ছিঁড়েও ফেলতেন। কারণ তখন যে স্বদেশেও মানুষ পরবাসী। তখন দেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হানাদার পাকবাহিনী। স্বাধীনতা নাই বাক্যেরও। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থী শিবিরেও দেশ থেকে পলাতক অনেক স্বদেশী ভাইবোনেরা অসহনীয় কাল কাটাচ্ছেন, যোদ্ধারাতো আছেনই। দেশের ভিতরেও মানুষ অস্বাভাবিক রকম স্বাভাবিকতার ভেক ধরে জীবন চালাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় খোলা ছাত্র নাই, স্কুল-কলেজও খোলা তাতেও নামমাত্র ছাত্র। পাকবাহিনীর সদম্ভ চেষ্টা সব ঠিকঠাক, সব স্বাভাবিক দেখানো আর মুক্তির জন্য মরিয়া মানুষের আপ্রাণ প্রয়াস ওদের সবকিছু ভণ্ডুল করে দেয়া। ওই নয়মাসের পরবাসে সাবালক, নাবালক, জ্যেষ্ঠ, কনিষ্ঠ সবাই এতো দীর্ঘ সময় জায়নামাজে বসে থেকেছেন, তাসবীহ্ জপেছেন হিসাব করে বের করা যাবে না। প্রার্থনা একটাই মুক্তিযোদ্ধার জয়, দেশের মুক্তি, মানুষের স্বাধীনতা। ডঃ মফিজুল্লাহ কবীর তার বইতে (ঊীঢ়বৎরবহপব ড়ভ ধহ ঊীরষব ধঃ ঐড়সব : খরভব রহ ঙপপঁঢ়রবফ ইধহমষধফবংয)। লিখছেন যে ২৬ মার্চের পরের বৃহস্পতিবার পাকবাহিনী ঢাকার কাছে জিঞ্জিরায় অভিযান চালায়। এখানে পুরো বইয়ের কাহিনী বর্ণনা নয় লেখকের কিছু কিছু পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করাই উদ্দেশ্য। তাই লেখকের ভাষ্য মুসলমানদের কাছে পবিত্র দিনগুলোকেই তারা হত্যা-ধ্বংস ও নির্যাতন চালানোর জন্য বেছে নিতে দ্বিধা করেনি। তথ্যে ঋদ্ধ বইয়ে নিজভূমে দমবন্ধ করা পরিবেশে ইতিহাসবিদের অনুভূতিও পাঠককে নাড়া দিয়ে যায়। কিছু ছবি রয়েছে বইটিতে যা থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জনগণের নিষ্ঠা-নিবেদন যেমন বোঝা যায় তেমনি আন্দাজ করা যায় আমাদের প্রতি পশ্চিমা পাকিদের নিষ্ঠুরতার মাত্রা। আলবদর, রাজাকাররা যে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল তাদের বেশি অংশ ছিলেন শিক্ষক। তাদের বিষয়ে তথ্যগুলো নিখুঁতভাবে আছে এই ইতিহাসবিদের লেখাতে। এবার অন্য ঘটনা বর্ণিত হচ্ছে তাও মুক্তিযুদ্ধেরই অংশ। বিদেশে বসেই শুনা। একজন স্কুল পড়ুয়া তার পরিবারের সাথে ভারতে শরণার্থী হিসেবে নয়মাস কাটিয়েছিলেন। তার বড়ভাই মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছেন। পরিবার হুমকির মুখে এ কারনে সীমান্ত সংলগ্ন এলাকা থেকে তাদের গোটা পরিবার পালিয়ে ভারতে চলে যায়। এপারে তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানপন্থীরা আর ওপারেও ঘটলো করুণ ঘটনা। তার মায়ের মৃত্যু ঘটে শরণার্থী শিবিরেই। যুদ্ধ শেষে তারা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ও ধ্বংসপ্রাপ্ত নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন। মা ফিরলেন না সাথে তাই জীবন হলো অনেক কষ্টের। তারপরও নানা সমস্যার মাঝ দিয়ে মাতৃহীন ছেলেটি পড়াশুনা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পেশায় যোগ দেয়। তবে তার মনে বরাবর জেগে ছিল ও আছে শরণার্থী শিবিরের দিনযাপনের কষ্ট ও শিবিরেই মাকে হারানোর দুঃখ। সবকিছু ঘটেছিল দেশের দুর্দিনের কারণে। মুক্তিযুদ্ধের ক্ষত বুকে নিয়ে জীবনযাপনকারী ওই মানুষটি বহুদিন পর একদিন ক্ষোভে ফেটে পড়লেন তারই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বয়োজ্যেষ্ঠ ভাইয়ের ওপর। জ্যেষ্ঠ ভাই এমনিতে মানুষ নাকি মানুষ খারাপ না। তবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার কোন আগ্রহ বা আবেগ দেখা যেতো না। একদিন সেই ভাইয়ের এক মন্তব্য শুনে দুঃখ আর ক্রোধে ফেটে পড়লেন শরণার্থী শিবিরে মা হারানো লোকটি দৃঢ় কণ্ঠে বললেন -ভাই আপনাকে আপনার কথা উইথড্র করতেই হবে; সবাই মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে গিয়েছিল ফায়দা আর সুবিধা লুটতে আপনার এই কথা একদম ঠিক নয়। বলতে হবে সবাই যায়নি, বলতে হবে। মতিয়ুরের পরিবার যায়নি। শেখ মতিয়ুর নামের সে শিক্ষক মেলবোর্নে বসে তার বিষাদময় এই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলেন যখন তার চোখে ছিল অসহনীয় দুঃখের ছায়া আর কণ্ঠে ছিল গভীর কান্না মাখানো ক্রোধ। এই সেই নয়মাসের ইতিহাস যার প্রতি পরতে পরতে গেঁথে আছে আবেগ অহঙ্কার, দুঃখ ও ভীতিকর অসংখ্য স্মৃতি। স্বদেশ থেকে বহুদূরে বাস করেও টের পাওয়া যায় তার রেশ।

জামিলার যুদ্ধ

জামিলার যুদ্ধ

জামিলার স্বামীর বদলির চাকরি। বদলি হলে তিনি একাই যান নিজের দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে। পরিবার নিয়ে টানাটানি করতে চান না। জামিলার কাছে সংসারের সব ভার তুলে দিয়ে নির্ভাবনায় চাকরি করেন। সপ্তার শেষে ছুটিতে বাড়িতে আসেন। হাতে থাকে ব্যাগ ভরা জিনিস সবার জন্য। তার আসার দিন জামিলা পথ চেয়ে বসে থাকে। রাত হয়। সবাই ঘুমায়ে যায়। রাস্তার ল্যাম্প পোস্ট আলো দেয়। বাড়ির গেটের সামনে রিক্সা থামে। ঘুমন্ত পাড়ার ভেতর একটা বাড়িতে আলো জ্বলে ওঠে। বাচ্চারা ঘুম থেকে জেগে ওঠে। হঠাৎ ঘরটা ভরে ওঠে তখন আলোর মতোই অথৈ আনন্দে। জামিলাকে তিনি দেখতে গিয়েছিলেন এক দূর গ্রামে। সেখানে যেতে হয় কপোতাক্ষ নদীতে নৌকায় করে। নৌকা ভিড়ে বাঁকড়া বাজারের ঘাটে। সেখান থেকে সাইকেলে চেপে এক অজপাড়াগাঁয়। কাঁচামাটির ধুলো ওড়া রাস্তা। হাত-মুখ ধুয়ে বাইরের দহলিজ ঘরে বসেছিলেন। নিজের চেয়ে বেঢপ মাপের বড় একটা শাড়ি পড়ে লম্বা ঘোমটা টেনে জামিলা সামনে এসেছিল। মুরুব্বিরা কেউ বলল, মা ঘোমটা একটু সরাও! তোমার মুখটা দেখি! এর মাঝে মুখটা দেখেছেন তিনি। অপরূপ সুন্দরী। গোলগাল গড়নের এক কিশোরী। এই কথাগুলো জামিলা শুনেছিল পড়ে তার শাশুড়ির কাছ থেকে। এ ভাবেই বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি যখন ছেলেকে জিগ্যেস করেছিলেন, কেমন দেখলি মেয়ে? তার আঙুলে আংটি পরানো হলো। আংটিও ছিল আঙুলের মাপের চেয়ে বড়। বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করে চলে গেল বরপক্ষ। স্কুল ছেড়ে, মায়ের বাড়ি ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে জামিলা স্বামীর হাত ধরে এসেছে নতুন শহরে। শহরের কত রকমের মানুষÑ বুঝতে তার সময় লেগেছে। ভাড়াবাসায় থেকেছে। তারপর একদিন উঠেছে নিজের বাড়ি। বাঁশ-চাটাই ও গোলপাতার ছাউনির বাড়ি থেকে ইটের বাড়ি। বড় উঠোন। উঠোনের এক পাশে পানির কুয়ো। একটা আলাদা রান্নাঘর। রাস্তার পাশ ঘেঁষে আরেকটা ঘর। সেই ঘরটা বরাদ্দ গৃহশিক্ষকের জন্য। মেহগনি কাঠের পালংটা সেখানে। ঘর ভরে বাচ্চাকাচ্চা তাদের সংসারে। ঘর সংসার সামলায় জামিলা এক হাতে। বাড়িতে দুটো দৈনিক সংবাদপত্র রাখা হয়। একটা ইংরেজি ও অন্যটা বাংলা। গৃহশিক্ষক ছিলেন যিনি এই সময়টাতে তার নাম শওকত। তার বাবা তাকে পাঠিয়েছেন শহরের কলেজে পড়াশোনা করার জন্য। তার একটা বড় ভাইও পড়তো একই কলেজে। থাকত মেসে। মাঝে মাঝে তাকে দেখতে আসত। জামিলাকে চাচি আম্মা বলে ডাকত। বলত, খিদে পেয়েছে! ভাত, লবণ আর কাঁচামরিচ দিলেই হবে! রান্নাঘরে বসে খেত। নিজেরা যা খেত সেই একই খাবার তুলে দিত তাদের পাতে। একাত্তর সালের প্রথম দিকে বিনা নোটিশে স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে গেল। পাড়ার কলেজ পড়ুয়া ছেলেরা শওকতের কাছে আসে। ওর ঘরে বসে খবরের কাগজের খবরগুলো চুলচেরা বিশ্লেষণ করে। বলে নিজেদের কি করা উচিত। ফিস ফিস করে কথা বলে। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা করে। শওকতের বড় ভাইয়ের মেস বন্ধ হয়ে গেছে। সে এসেছে এখানে। ব্যাংকের চাকরির জন্য সে শর্টহ্যান্ড শিখছে। তার পড়াশোনা শেষের দিকে। যুদ্ধের জন্য যদিও তখন সবকিছু বন্ধ। জামিলার স্বামী তখন ঝিনাইদহ শহরে। যশোর থেকে ৩০-৪০ মাইল দূর। সবখানে কার্ফু চলছে। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। স্বামীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই এখন। প্রতিবেশীরা আছে। কেউ কেউ শহর ছেড়ে চলে গেছে নিরাপদ জায়গায়। যারা আছে তাদের সঙ্গে কথা বলে। পরামর্শ করে। নিজেকে শক্ত করে। তার আটটা সন্তান, তার ভেতর একজন দুধের শিশু। ভেঙে পড়েননি তিনি। শুরু হলো তার নিজের যুদ্ধ। জামিলাদের বাড়ি শহরের পশ্চিমে ক্যান্টনমেন্টের কাছে। বড় রাস্তা থেকে দু-তিনটা বাড়ির পর তাদের বাড়ি। মিলিটারিরা নিয়মিত টহল দিচ্ছে। বড় বড় সাঁজোয়া ট্রাকগুলো রাস্তা দিয়ে শব্দ করে চলে যাচ্ছে। ভয়ে বাড়ির জানালা-দরজা বন্ধ করে রাখে। জামিলার চিন্তা কিছুতেই কমে না। তার মেয়েটা বড়। তারপর আরও সাতজন। এত বড় সংসার তুলে নিয়ে কোনদিকে যাবে! খবর নিয়ে জেনেছে বাবার কিংবা শ্বশুরবাড়ির দিকে যাবার কোনো উপায় নেই। সব পথে বাঁধা-বিপত্তি। মিলিটারি ও তাদের সহযোগীরা রাস্তায় রাস্তায়। একা এত বড় বিপদে কীভাবে সামাল দেবে! একদিন বিকেলে সোরগোল শোনা গেল। মিলিটারি আসছে! পাড়ার সবাই তড়িঘড়ি করে নিজেদের বাড়িতে ঢুকে জানালা-দরজা বন্ধ করে দিল। কারও কাছ থেকে হয়তো গোপনে খবর পেয়েছে। বাড়ির সামনে থামছে। হাত বেঁধে বাড়ি থেকে বের করছে। রাইফেলের বাঁট দিয়ে ঠেলা ও ধাক্কা দিয়ে ভ্যানে তুলছে। ঘরের ভেতরে অন্ধকার। চোখ বন্ধ করে সবাই দোয়া পড়ছে, যে দোয়া পড়েছিলেন নূহ নবী সমুদ্রে মাছের পেটে ঘোর বিপদে। মিলিটারি অপারেশন সেরে ফিরে গেল ক্যান্টনমেন্টে। এরপর একদিন দুদিন পার হয়ে যায়। যাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল তাদের কেউ ফিরে এলো না। পাড়ার দুজন ছেলে মঈন ও বাবুল। কারও বিপদে-আপদে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ত। পরে জানা গেল ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে তাদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করে। কোনো কথা বের করতে না পেরে মেরে ফেলে। লাশও ফেরত দেয়নি। এবার জামিলা বেগম খুব ভড়কে যায়। ম্যাট্রিক পাস করা একটা মেয়ে ঘরে। মিলিটারিরা মেয়েদেরও ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এখন এ নিয়ে চিন্তা করছে না সে। চিন্তা হলো সব গৃহশিক্ষক শওকত ও তার ভাইকে নিয়ে। পরের ছেলে তারা। বিপদ আসতে পারে যে কোনো সময়। তাদেরও ধরে নিয়ে যেতে পারে। মেরে ফেলতে পারে। জামিলা বেগম তাদের বলল, তোমরা বাড়ি চলে যাও, যেভাবে পার লুকায়ে ছুপায়ে। এই খানে থাকা এখন খুব বিপজ্জনক। কোনো একটা অঘটন ঘটে গেলে তোমাদের বাবা-মার কি বলে সান্ত্বনা দেব? শহরের অবস্থা ভালো না। দেখছো না নিজের চোখে! শওকত অবাধ্য হয়ে বলল, চাচি-আম্মা, চাচাজি নাই। এই ঘোর বিপদে আপনাদের একা ফেলে রেখে যেতে পারব না যতই বিপদ আসুক! নাছোড়বান্দা মানুষ জামিলা। ধমকের সুরে বললেন, দিনের আলো থাকতে রওনা দাও! তার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিলেন। শওকত ও তার ভাই খুব মন খারাপ করে বিদায় নিল। পাকিস্তানি আর্মিদের সঙ্গে বিহারিরাও যোগ দিয়েছে। প্রতিদিন খবর আসছে নিখোঁজ হওয়ার খবর। বাঙালি ধরতে পারলে জবাই করে গণকবর দিচ্ছে। ঘরবাড়ি লুটপাট করে আগুন ধরায়ে দিচ্ছে। পাড়ার ছেলেরাও অস্ত্র ধরেছে। গেরিলা স্টাইলে আক্রমণ চালাচ্ছে। বাড়ির পশ্চিম দিকে বিমান অফিস। সেখানে তাদের ঘাঁটি। গোলাগুলির শব্দ সারাক্ষণ। জামিলা তার আটটা বাচ্চাকে নিয়ে রাতের বেলা এই বাড়ি থেকে সেই বাড়িতে লুকায়। যেটুকু খাবার আছে, সবাই মিলে খায়। বাড়ির সামনের রাস্তা ধরে উত্তরে সামান্য গেলে বাম দিকে একটা গলি। ডেড এন্ড গলি এটা। বেশ নিরিবিলি। জামিলার চাচা ভাড়া থাকে এখানে। তার দুই বউ। পাশে এক মাস্টারের বাড়ি। দোতলার কাজ পুরো শেষ হয়নি। এই বাড়িতে একরাত কাটলো জামিলার। সকালে গোলাগুলির আওয়াজ কমে আসে। জামিলা তার বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ফিরে এলো নিজের বাড়িতে। দুপুরে তিন চারজন মুক্তিযোদ্ধা আসে দেওয়াল টপকে। জামিলা তাদের খেতে দেয়। সেই অতি সাধারণ খাবারে যেন অমৃতের স্বাদ। নিঃশব্দে দেওয়াল পার হয়ে আবার ঘাঁটিতে ফিরে যায়। জামিলা এখানে আর থাকবে না। বাবার বাড়ি কিংবা শ্বশুরবাড়ি, যেখানে যাওয়া সহজ সেদিকে রওনা দেবে। দরকারি কাজগুলো গুছায়ে ফেলে। থালা-বাটি এক সঙ্গে বেঁধে নিল। নিজের গহনা রাখল ঘরের ভেন্টিলেটরে। আর স্বামীর হলুদ খামের চিঠির বান্ডিল দিয়ে আড়াল করে রাখল। ঘরে তালা দিল। এখন বের হবে। শওকত কোথা থেকে এসে দাঁড়াল সামনে তখন। বলল আব্বা আমাকে বাড়িতে জায়গা দেননি। ফেরত পাঠিয়েছে। বলেছেন, যাদের বাড়িতে এতোদিন ছিলি, এতো বড় বিপদে তাদের একা ফেলে আসলি কেমনে? আমার ছেলে হয়ে পারলি এমন কাজ করতে?, শওকত বলল, চাচি-আম্মা! শহরের ভেতর দিয়ে কোথাও যাওয়া যাবে না। সবখানে মিলিটারিদের পাহারা। উপ-শহর দিয়ে আমাদের গ্রামের বাড়িতে যাওয়া বেশি নিরাপদ। পুরো পথটা মুক্তি সেনাদের দখলে। জামিলা বেগম বললেন, চলো বাবা!

মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু

মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন অকৃত্রিম বন্ধু পণ্ডিত রবিশঙ্কর।   ডিসেম্বরের ১১ তারিখ তাঁর মৃত্যুদিবস। ২০১২ সালের এই তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের কালিফোর্নিয়ার সানদিয়াগো হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় ৯২ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পুরো নাম ছিল রবিশঙ্কর চৌধুরী। কিন্তু শুধু রবিশঙ্কর নামেই তিনি পরিচিত।   তাঁর বাবার নাম শ্যামশঙ্কর চৌধুরী। মা হেমাঙ্গিনী দেবী। বাবা-মা’র সাত পুত্রের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। রবিশঙ্করের পৈতৃক বাড়ি ছিল বাংলাদেশে। বর্তমান নড়াইল জেলার কালিয়াতে। কিন্তু বাবার পেশাগত কারণে তাঁর জন্ম হয় উত্তর ভারতের বারানসিতে। ১৯২০ সালের ৭ এপ্রিল তারিখে। তাঁর এক ভাই উদয়শঙ্কর একজন খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পী ছিলেন। নিজস্ব একটা নাচের দলও ছিল তাঁর। খুব ছোটবেলায় এই ভাইয়ের কাছে তিনি নাচ শিখতে থাকেন। ১৯৩৮ সালে যখন তাঁর বয়স মাত্র ১৩ বছর, সে সময় ভাইয়ের নাচের দলের কনিষ্ঠতম সদস্য হয়ে তিনি প্যারিস যান। ওখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি কখনো নৃত্যশিল্পী, আবার কখনো সেতার বাদক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। এ ছাড়া একই দায়িত্ব নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে গমন করেন ইউরোপ ও আমেরিকাতে। এরপর থেকে তিনি সেতারবাদনে বেশি উৎসাহী হয়ে ওঠেন। তাই নাচ ছেড়ে সেতারবাজনা শিখতে শুরু করেন। সেতারবাজনা শেখার জন্য তিনি ওস্তাদ সন্ধান করতে থাকেন। ১৯৩৪ সালে এক অনুষ্ঠানে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র সেতারবাদ্য শুনে তিনি মুগ্ধ হন। পরের বছর তাঁর বড়ভাই উদয়শঙ্কর একটি অনুষ্ঠান পরিবেশন করার জন্য ইউরোপ গমন করেন। উক্ত অনুষ্ঠানে সেতার বাজানোর জন্য সঙ্গে করে নিয়ে যান ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’কে। সঙ্গে গেলেন রবিশঙ্করও। ওখানে গিয়ে সেতার বাজানোতে রবিশঙ্করের আগ্রহ দেখে মুগ্ধ হন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। উদয়শঙ্করকে তিনি বললেন, রবিকে তাঁর কাছে দিয়ে দেওয়ার জন্য। প্রস্তাবটা শুনে তো ভীষণ খুশি রবিশঙ্কর। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল! উদয়শঙ্করের অনুমতি নিয়ে রবিশঙ্করকে আলাউদ্দিন খাঁ নিয়ে গেলেন তাঁর বাড়ি ভারতের মধ্য প্রদেশের মাইহারে। এখন শুরু হলো রবিশঙ্করের যথাযথ সেতারবাজনা শেখা। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র কাছে। রবিশঙ্করকে আলাউদ্দিন খাঁ শেখাতে লাগলেন বিভিন্ন রাগ-রাগিনীর সেতারবাজনা। এটা ১৯৩৮ সালের কথা। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি সেতারবাজনায় বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে তিনি যুগলবন্দি বাজনা বাজাতে শুরু করেন খ্যাতিমান সরোদবাদক ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ’র সঙ্গে। শিষ্যের এ দক্ষতা দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হন গুরু ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। তাই অতি আগ্রহের সঙ্গে শিষ্যকে তিনি সেতারবাজনা শেখাতে থাকেন। মাত্র এক বছরের মধ্যে শিষ্য রবিশঙ্কর সেতার বাজনায় এত বেশি পারদর্শিতা লাভ করেন যে, অনেক অনুষ্ঠানে ওস্তাদের সঙ্গে তিনি সেতার বাজাতে থাকেন। তাঁর সেতারবাজনা এত দ্রুত উন্নতি লাভ করে যে, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ বেশিদিন তাঁকে প্রশিক্ষণ প্রদানের প্রয়োজনীয়তা বোধ করলেন না। মাত্র বছর ছয়েক পর ১৯৪৪ সালে তাঁর প্রশিক্ষণ প্রদান সমাপ্ত করে দেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র কাছ থেকে সেতার বাদন শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি ওস্তাদ এবং পণ্ডিত খেতাবপ্রাপ্ত হন। এরপর চলে যান মুম্বাইয়ে। সেখানে কনসার্ট পার্টির সদস্য হিসেবে যোগদান করেন পিপল্স থিয়েটারে।   এখানে বছর চারেক থাকার পর ১৯৪৯ সালে সংগীত পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে। এখানে ছিলেন ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ সাত বছরের মতো। এখানে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি কাজ করতে থাকেন চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক হিসেবে। খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ ও ‘অপুর সংসার’-এর সংগীত পরিচালক ছিলেন তিনি। ভারতের আরও অনেক  বিখ্যাত চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেন ওস্তাদ রবিশঙ্কর। এ ছাড়াও তিনি শিক্ষকতা করেন নিউইয়র্কের সিটি কলেজ অব মিউজিক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব আর্টস, আলী আকবর মিউজিক কলেজসহ অনেকগুলো সংগীতবিষয়ক প্রতিষ্ঠানে। ১৯৫২ সালে পশ্চিমা বিশ্বের বিখ্যাত বেহালাবাদক ইয়াহুদি মেনুহিন দিল্লিতে আসেন এক অনুষ্ঠানে বেহালা বাজাতে। ওই অনুষ্ঠানে এই বিখ্যাত মহান শিল্পীর সঙ্গে পরিচয় ঘটে ওস্তাদ রবিশঙ্করের। তাঁর সেতারবাদন শুনে মুগ্ধ হন ইয়াহুদি মেনুহিন। দু’জনার মধ্যে বন্ধুত্বের সৃষ্টি হয়। এর কিছুদিন পর জাতিসংঘের দশম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় ‘ইউনেস্কো সংগীত উৎসব’। এই অনুষ্ঠানে তাঁদের দু’জনের বেহালা ও সেতারের যুগলবন্দি বাজনা উপস্থিত শ্রোতাদেরকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করে। এরপর থেকে তাঁরা দু’জন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুগলবন্দি বাজনা বাজাতে থাকেন। যুগলবন্দির অ্যালবামও বের করেন তাঁরা। আমেরিকার অত্যন্ত জনপ্রিয় পপসংগীত শিল্পী জর্জ হ্যারিসন তাঁর কাছে সেতারবাজনা শেখেন। বাংলাদেশের জনগণ যে বিশেষ কারণে তাঁকে বিশেষভাবে সম্মান ও শ্রদ্ধা করে তা হচ্ছে, একাত্তরে এদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সবিশেষ ভূমিকা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট জর্জ হ্যারিসনকে নিয়ে তিনি নিউইয়র্কের মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনে আয়োজন করেন ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নামে এক জমকালো কনসার্ট অনুষ্ঠান। এতে হ্যারিসনের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মনমাতানো  সংগীতের সঙ্গে সেতার বাজান পণ্ডিত রবিশঙ্কর। এ অনুষ্ঠানে জর্জ হ্যারিসন ছাড়াও পশ্চিমা জগতের আরও অনেক বিখ্যাত শিল্পীরা সংগীত পরিবেশন করেন। কনসার্টে সেতারে পণ্ডিত রবিশঙ্কর ছাড়াও বেহালাতে ছিলেন ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, তবলায় আল্লারাখা খাঁ এবং তানপুরায় কমলা চক্রবর্তী। প্রায় ৪০ হাজার মানুষ এ কনসার্টটি উপভোগ করে। সংগৃহীত হয় প্রায় আড়াই কোটি ডলার। সব অর্থই তিনি দান করে দেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তহবিলে, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায়  বিশেষ সহায়ক হয়। বলাবাহুল্য, ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নামের এই বিশাল অনুষ্ঠানটির প্রধান উদ্যোক্তা এবং সার্বিক আয়োজন ও ব্যবস্থাপনায় ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্করই। সেতারের জন্য তিনি বেশকিছু  রাগ-রাগিনীর সুর সৃষ্টি করেন। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ‘বাংলাদেশের ধুন’ নামক সুরটি। এটি অত্যন্ত প্রাণমাতানো তাল-লয়ের সুর। সেতারে বিভিন্ন রাগিণীর সুর সৃষ্টিতে বিশ্বজয়ী অবদান এবং সেতারবাদ্যে অসামান্য দক্ষতার জন্য তিনি বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হন। সেসবের মধ্যে অন্যতমÑতপন সিংহ পরিচালিত রবীন্দ্রঠাকুরের কাহিনী ‘কাবুলিওয়ালা’ চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক হিসেবে ১৯৫৭ সালে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ পুরস্কার, ১৯৬২ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি পদক, একই বছরে সংগীত-নাটক একাডেমি পুরস্কার, ১৯৬৭ সালে পদ্মভূষণ পুরস্কার, ১৯৮১ সালে পদ্মবিভূষণ পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে ভারতরত্ন পুরস্কার। এ সবগুলোই দেশের এবং আন্তর্জাতিক মানের অতি সম্মানীয় পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত। বিশেষ করে শেষোক্ত পুরস্কারটি ছিল ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার। এ ছাড়া আরও অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন সেতার জাদুকর পণ্ডিত রবিশঙ্কর। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সেতারবাদনের মাধ্যমে শ্রোতাদেরকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করেন এবং উক্ত অনুষ্ঠান সমূহের প্রাপ্ত তাঁর সম্মানী অর্থ মুক্তিযুদ্ধের ফান্ডে দান করেন। তাই মুক্তিযুদ্ধে তাঁর এই বিশেষ সহায়ক অবদানের জন্য ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাঁকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হয়। দেশ-বিদেশে পণ্ডিত রবিশঙ্করের অসংখ্য সেতারবাদক ছাত্র-ছাত্রী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বিশ্বখ্যাত পপসংগীত গায়ক জর্জ হ্যারিসনের নাম তো আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমানের একজন খ্যাতিমান গায়িকা ও গীতিকার নোরা জোন্স তাঁর কাছে সেতারবাদ্য শেখেন। ভারতের প্রখ্যাত সেতারশিল্পী আনুশকা শঙ্করের সেতার শেখা পণ্ডিত রবিশঙ্করের হাতে। উল্লেখ্য যে, পণ্ডিত রবিশঙ্করেরই কন্যা আনুশকা শঙ্কর।

কোল্লাপাথর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত তীর্থভূমি

কোল্লাপাথর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত তীর্থভূমি

‘যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তি সেনা, দে-না তোরা দে-না, সে মাটি আমার অঙ্গে মাখিয়ে দে-না’। বাঙালির জাতীয় জীবনের প্রধানতম অর্জন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালে এই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন ৩০ লক্ষ বাঙালি। সম্ভ্রম হারিয়েছেন দু’লক্ষ মা-বোন। মুক্তিযুদ্ধের মহান শহীদদের সমাধি হয়েছে সেই মাটির বুকে, যে মাটির মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য তারা নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মৃত্যুবরণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কবরও এই মাটির বুকেই হয়েছে। তাইতো এ-মাটি ধন্য। এ-মাটি আমাদের পরম আরাধ্য, পুণ্যময় ও পবিত্রভূমি। লাখো লাখো মুক্তিযোদ্ধাদের কবর, অসংখ্য গণকবর ও বধ্যভূমি এই দেশের নানা স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তেমনি একটি সমাধিস্থল দেশের শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার বায়েক ইউনিয়নে অবস্থিত। যেখানে শুয়ে আছেন মহান মুক্তিযুদ্ধের ৫০জন বীর শহীদ। ভারত সীমান্তবর্তী সালদা নদী ঘেঁষা কোল্লাপাথর গ্রামে রয়েছে এই সমাধিসৌধ। কোল্লাপাথর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি উল্লেখযোগ্য সমাধিস্থল। একটি ছোট টিলার উপরে এই সমাধিস্থল অবস্থিত। কোল্লাপাথরে দুজন বীর বিক্রম, দুজন বীর উত্তম, দুজন বীর প্রতীক পদকপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাসহ মোট ৫০ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধি রয়েছে। দুজন অমুসলিম বীর মুক্তিযোদ্ধাও এখানে শায়িত আছেন। যা মুক্তিযোদ্ধাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরিচায়ক। অজ্ঞতনামা তিন জন ছাড়া বাকি ৪৭টি কবরের উপরে প্রত্যেক বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম লেখা রয়েছে। শালদা নদী যুদ্ধক্ষেত্র ও কোল্লাপাথর সমাধি ক্ষেত্র তৈরির প্রেক্ষাপট কসবা বাংলাদেশের একটি সীমান্তবর্তী উপজেলা। মুক্তিযুদ্ধের সময় কসবা ২ নম্বর সেক্টরের আওতায় ছিল এবং এর দক্ষিণ-পূর্ব পাশের ভারতের আগরতলা, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘মেলাঘর’ মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। সীমান্ত এলাকা ও মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থাকার কারণে এ অঞ্চলটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্যে পরিণত হয়। তাঁরা কসবায় তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে। ফলে অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এ এলাকায় বেশি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ সকল যুদ্ধে বিপুল সংখ্যক (সংখ্যা) পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয় এবং শাহাদাতবরণ করেন (সংখ্যা) দেশমাতৃকার শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাগণ। কোল্লাপাথর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরত্বে রয়েছে শালদা নদী যুদ্ধক্ষেত্র। এই সম্মুখ সমরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট বড় (সংখ্যা) বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ যুদ্ধ বলা হয়ে থাকে এই সালদা নদীর যুদ্ধগুলোকে। সালদা নদী সাব সেক্টর সামরিক দিক থেকেও ছিল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। শালদা নদী এমন একটি নদী যেটি ভারত থেকে উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশের ভেতরে এসেছে। ভারত সীমান্তবর্তী হওয়ায় মুক্তিবাহিনী এই অঞ্চল দিয়ে ভারত প্রশিক্ষণে আসা-যাওয়া করত। কয়েক কিলোমিটারের কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে শালদা নদী ও মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশন। মন্দভাগ ও শালদা নদী গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার আরেকটা কারণ হলো এই রেললাইন ধরে পাকবাহিনীকে ঢাকা চট্টগ্রাম আসা-যাওয়া করতে হতো। তাদের খাদ্য গোলাবারুদসহ অন্যান্য রসদ এই পথেই আনা নেওয়া করতে হতো। ফলে এটি ছিল তাদের লাইফ লাইনের মতো। শালদা নদী স্টেশনটা ছিল ভারত সীমান্তবর্তী, পাকিস্তানি বাহিনী সর্বপ্রথম সালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন ও নয়নপুর বাজারে ৩০ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানি নিয়োজিত রেখেছিল। অপরদিকে মুক্তিবাহিনী চেয়েছিল সালদা নদী অঞ্চল দখল করে মুক্তাঞ্চলে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। এই অঞ্চলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সর্বপ্রথম রেললাইনসহ গোটা এলাকা দখল করতে হবে। কারণ তাতে করে বন্ধ হয়ে যাবে ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে রেল যোগাযোগ। যা ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য লাইফ লাইন। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে এই অঞ্চলে যুদ্ধ করেছিলেন মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিভিন্ন প্লাটুনের যোদ্ধারা। ২ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ পরিকল্পনায় ও পরবর্তীতে দায়িত্বপ্রাপ্ত মেজর এটিএম হায়দারের নির্দেশে ক্যাপ্টেন আশরাফ, ক্যাপ্টেন এম এ গাফফার, মেজর সালেক-এর নিয়ন্ত্রণাধীন তিনটি পদাতিক কোম্পানি এবং ক্যাপ্টেন আবদুল আজিজ পাশার মুজিব ব্যাটারির ফায়ার সাপোর্ট নিয়ে কোম্পানি কমান্ডারেরা এখানে বেশ কয়েকটি অপারেশন পরিচালনা করেন। তাঁরা আগস্টের শেষের দিক থেকে শালদা নদী রেল স্টেশন নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। কেবল একবার ছাড়া তা মুক্তিযোদ্ধাদের কখনোই আর হাতছাড়া হয়নি। যেভাবে তৈরি হলো কোল্লাপাথর সমাধিস্থল : ১৯৭১ সালে সালদা নদী যুদ্ধ ক্ষেত্রসহ কসবা এলাকার বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ৯ মাস ধরেই এই যুদ্ধে অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় মাঝামাঝি জুলাই মাসের দিকে সিলেটের তৈয়ব আলী নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা সম্মুখ যুদ্ধে আহত হন। মৃত্যুর পূর্বে আহত অবস্থায় তিনি সহযোদ্ধাদের কাছে আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন যে, ‘আমিতো মনে হয় আর বাঁচবো না। মৃত্যুর পরে আমার লাশটি যেন বাংলাদেশের মাটিতে কবরস্থ করা হয়।’ তখন প্রায় সমগ্র বাংলাদেশই পাকিস্তানি হানাদারদের দখলে ছিল। কোল্লাপাথর সীমান্ত সংলগ্ন হওয়ায় এলাকাটি একটি মুক্ত এলাকা ছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা তৈয়ব আলীর শেষ আকাক্সক্ষা পূর্ণ করার জন্য মন্দভাগ সাব সেক্টরের কমান্ডার, ক্যাপ্টেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আবদুল গাফফার হালদার (বীর উত্তম) সীমান্তের আশপাশে কোন্ জায়গায় তাঁকে সমাহিত করা যায় তা খোঁজ নেওয়ার জন্য লোক পাঠান। তখন তারা কবর দেওয়ার জায়গার সন্ধান করতে এসে এই কোল্লাপাথরে আবদুল করিম নামে এক ব্যক্তির সন্ধান পান। মুক্তিযোদ্ধারা আবদুল করিমসহ আবদুল করিমের বাবা আ. মান্নান (বেনু ফকির)-এর কাছে এসে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা তৈয়ব আলীকে তাঁদের পৈতৃক ভিটায় কবর দেওয়ার অনুমতি চান। আ. মান্নান স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গেই বীর শহীদের জন্য কবরস্থানের জায়গা দিতে রাজি হয়ে যান। শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা তৈয়ব আলীকে কবর দেওয়ার মাধ্যমেই কোল্লাপাথর সমাধিসৌধের গোড়াপত্তন হয়। যুদ্ধের সময় এই এলাকাটি যেহেতু মুক্ত এলাকা ছিল, সীমান্তের দুই পাড় থেকে এসে তখন বহু মানুষ তৈয়ব আলীর জানাজা নামাজে অংশগ্রহণ করেন। এরপর কসবা পার্শ্ববর্তী এলাকা, শালদা নদী এলাকা ও সীমান্ত এলাকায় যেখানেই কোনো মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছে, সেই মুক্তিযোদ্ধাদের এখানে এনে কাফন-দাফন করে সমাহিত করা হয়। পাহারের টিলা কেটে মাটি সমান করে কবরস্থানের জন্য উপযুক্ত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস জুড়ে একে একে এখানে ৫০জন বীর শহীদের কবর প্রতিষ্ঠিত হয়। কবর সংরক্ষণ, নাম ফলক স্থাপন ও সৌন্দর্য বর্ধন দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা প্রশাসক অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের কবরগুলো সংরক্ষণ করেন। তখন প্রতিটি কবরে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অঙ্কন করা ও নাম স্মৃতিফলক তৈরি করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ক্যাপ্টেন আবদুল গাফফার একটি ডাইরি মেনটেইন করতেন। কবরের নামফলক নির্ধারণে তাই ক্যাপ্টেন আবদুল গাফফারের সহযোগিতা নেওয়া হয় বলে জানা যায়। পরবর্তীতে বিভিন্ন সরকারের আমলে টিলার চতুরপাশে পাশে বাউন্ডারি ওয়াল স্থাপনসহ স্থানটিতে অনেক উন্নয়ন কাজ করা হয়। দর্শনার্থীদের জন্য এখানে একটি আধুনিক একটি রেস্ট হাউস ও একটি মসজিদ, পুকুরে পাকা ঘাট ও যাতায়াতের জন্য রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। মরহুম আবদুল করিমও এই জায়গাটি কবরস্থানের স্মৃতি রক্ষার উদ্দেশ্যেই স্থায়ীভাবে দান করে গেছেন। উল্লেখ্য, একসঙ্গে এতগুলো শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আর কোথাও নেই। দেশের বিভিন্ন স্থানের মুক্তিযোদ্ধারা এখানে যারা শহিদ হয়েছেন তাঁদের আত্মীয়স্বজনরা প্রতিবছর এই স্থানে তাঁদের কবর জেয়ারত করতে আসেন। অনেক সাধারণ মানুষরাও বিভিন্ন সময় এখানে এসে থাকেন। বিশেষ করে ১৬ই ডিসেম্বর এবং ২৬ মার্চে ব্যাপক জনসমাগম হয়। লোকজন বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এখানে সমবেত হন। দর্শনার্থীদের আনাগোনায় এলাকাটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এক তীর্থভূমিতে পরিণত হয়েছে। কোল্লাপাথরে সমাহিত ৫০জন বীর শহীদদের নাম : (উল্লেখ্য, কবরের সিরিয়ালের নাম অনুযায়ী এই লেখা প্রস্তুত করা হয়নি) দেশের বিভিন্ন জেলার ১০ জন তাঁরা হলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার তৈয়ব আলী (সিলেট), বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জাকির হোসেন (বীর প্রতীক) (আর কে মিশন রোড-ঢাকা), বীর মুক্তিযোদ্ধা নায়েক সুবেদার বেলায়েত হোসেন (বীর উত্তম) (চট্টগ্রাম), বীর মুক্তিযোদ্ধা নায়েক সুবেদার মো. আবদুল সালাম (বীর বিক্রম) (নোয়াখালী), বীর মুক্তিযোদ্ধা ল্যান্স নায়েক আবদুস সাত্তার (বীর বিক্রম) (বগুড়া), বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক দর্শন আলী (ঠাকুরগাঁও), বীর মুক্তিযোদ্ধা নায়েক মোজাম্মেল হক (ময়মনসিংহ), বীর মুক্তিযোদ্ধা সিপাহি মুসলীম মৃধা (ফরিদপুর), বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম (শরীয়তপুর) ও বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্রী আশুরঞ্জন দে (কিশোরগঞ্জ) (অমুসলিম মুক্তিযোদ্ধা)। কুমিল্লার ১৩ জন। তাঁরা হলেনÑ  নায়েক সুবেদার মইনুল হোসেন (বীর উত্তম) (তার নামে ঢাকা সেনানিবাস এলাকার শহীদ মইনুল সড়কের নামকরণ করা হয়), বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোশারফ হোসেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা সিপাহী আক্কাছ আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা সিপাহী জসিম উদ্দীন, বীর মুক্তিযোদ্ধা সিপাহী হুমায়ুন কবির, বীর মুক্তিযোদ্ধা ল্যান্স নায়েক আজিজুর রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুল কাসেম (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী),  বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. তারু মিয়া, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জামাল উদ্দিন, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সিরাজুল ইসলাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ফরিদ মিয়া, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাকিল মিয়া, বীর মুক্তিযোদ্ধা সিপাহী মো. আবদুল বারী খন্দকার। চাঁদপুরের ৩ জন। তাঁরা হলেনÑ বীর মুক্তিযোদ্ধা আনসার ইলাহী বক্স পাটোয়ারী (বীর প্রতীক), বীর মুক্তিযোদ্ধা সিপাহী মো. নুরুল হক, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জাহাঙ্গীর আলম। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ২১ জন। তাঁরা হলেন- বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুল জব্বার, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাহিদ নুরু মিয়া, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ফারুক আহম্মদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ফকরুল আলম, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নোয়াব আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুল অদুদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ল্যান্স নায়েক মো. আ. খালেক, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুল কাইয়ুম, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শওকত, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুস সালাম সরকার, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আমির হোসেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা সিপাহী শহিদুল হক, বীর মুক্তিযোদ্ধা সিপাহী আনোয়ার হোসেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুল আউয়াল, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জাবেদ আহাম্মদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্রী পরেশ চন্দ্র মল্লিক, (অমুসলিম মুক্তিযোদ্ধা) বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মতিউর রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুর রশিদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রফিকুল ইসলাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোরসেদ মিয়া ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. তাজুল ইসলাম। এছাড়াও অজ্ঞাতনামা আরও ৩জন বীর মুক্তিযোদ্ধা এখানে শায়িত আছেন। উপসংহার : মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির গৌরব ও অহংকার। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন। ১৯৭১ সালে এই দেশের মানুষ যদি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করত এবং যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন না করত তাহলে জাতি হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্র ও ইতিহাস থেকে আমাদের নাম চিহ্ন মুছে যেত। যারা জীবনবাজি রেখে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন সেই সমস্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ এ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদেরকে আমাদের সারাজীবন মনে রাখতে হবে, সম্মান করতে হবে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের বুকে ধারণ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। আমাদের নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তুলতে পারলে যাদের দেহ গ্রহণ করে এ মাটি ধন্য হয়েছে তাদের আত্মত্যাগ সফল হবে। উল্লেখ্য, এটি একটি অসম্পূর্ণ লেখা। কোল্লাপাথরের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস ও এখানে শায়িত সকল মুক্তিযোদ্ধার জীবনী লেখার জন্য তথ্য সংগ্রহ চলছে। উপরিউক্ত লেখায় কোনো তথ্যে অসংগতি দেখলে বা নতুন কোনো তথ্য পেলেও তা  আমাদের জানানোর জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।

বিজয়ের মাস ॥ সামগ্রিক ভাবনা

বিজয়ের মাস ॥ সামগ্রিক ভাবনা

যে কয়টি মানবধারা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে বিবর্তনে যুক্ত হয়েছিল তার শেষ দুটি ধারার একটি নিয়েনডার্থাল আর অন্যটি হোমোসেপিয়ান বা বর্তমান মানুষ। একসময় নিয়েনডার্থালরা বেঁচে থাকার লড়াইতে হোমোসেপিয়ানদের কাছে হেরে হেরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হয়তো রেখে গেছে তাদের কিছু প্রত্নচিহ্ন হোমোসেপিয়ানদের মধ্যে। কিন্তু রয়ে গেছে বাঁচার লড়াই মানে টিকে থাকবার সংগ্রাম একই রকম। নিয়েনডার্থালদের হারিয়ে হোমেসেপিয়ানদের বাঁচার লড়াইয়ে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে এবং তারপর সে সব টপকে আজকের রাষ্ট্রে আর রাষ্ট্রের লড়াই জাতিতে জাতিতে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক লড়াই অব্যাহত আছে ধারার নব নব বদলে। আজ হোমোরা নিজেরাই নিজেদের পক্ষ এবং প্রতিপক্ষ। তাই মানুষকে লড়াইটা করতেই হচ্ছে, রাষ্ট্রের জন্যে, নিজ অধীনতা অর্জনের জন্য, জীবন ধারণের যুক্তিসঙ্গত বিধির জন্য, মানুষ হিসেবে মুক্তির প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে। আজ স্বাধীনতা কথাটি সামগ্রিক, একটি শব্দের মধ্যেই রয়েছে ব্যক্তির ব্যাস্টির সকল মৌলিকগুলো। সে কারণেই ব্যক্তি এককের আকাক্সক্ষা যখন ব্যস্টির আকাক্সক্ষায় ছড়িয়ে পড়ে তখন গোষ্ঠীর স্বার্থ ক্ষীয়মান হয় এবং সমস্টি তার স্বভাবসুলভ আচরণ দ্বারা তা অস্বীকার করতে শুরু করলে লড়াইটা অনিবার্য হয়ে পড়ে। এই লড়াইয়ে যখন ব্যস্টি জিতে যায় তখন তাকে আমরা বিজয় বলি, এই বিজয় কেবল মাত্র একটা গোষ্ঠীর আধিপত্যের অবসানের বিজয় নয়, বরং তার ইচ্ছে, শাসন শোষণ খর্ব করে সংগঠিত হয় একটি জাতি যাঁরা আগামীর। এখানে নির্মিত হয় তার সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিশ্চয়তার সকল বিধানগুলো। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমরা যে জিতেছিলাম তারও লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা। সে স্বাধীনতা ভূখণ্ডগত কেবল নয়, সামগ্রিক জীবন ক্ষেত্রের মুক্তির।  ১৬ ডিসেম্বর সেই বিজয়ের মাস একটি অপশাসনকে হঁটিয়ে একটা নতুন সমাজের প্রবর্তনার এক মহান দিন। কিন্তু বেদনাদায়ক হলো এই দিনটির তাৎপর্যে এক ধরনের  ‘মেলা মেলা’ ভাব আরোপের মধ্যে আটকে জাতীয় অনুভব থেকে অন্যসব বিজয়ের ক্ষেত্রের প্রয়োজনীয়তাকে আড়াল করে ফেলেছে। বড় অভাব প্রকৃত সংস্কৃতির চর্চার এবং ঐতিহ্যকে নবায়নের মধ্য দিয়ে শক্তিশালী জাতীয় সংস্কৃতির বোধ তৈরি করার। গণমানুষ এক অপসংস্কৃতির জোয়ারের তোড়ে তার নিজ সংস্কৃতির শক্তিটাও পরখ করতে পারেনি। অপসংস্কৃতিতে কেবলমাত্র গণমানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, বরং সংস্কৃতির কর্মীরাও তার অসুখে অসুস্থ থাকে এবং রুগ্ন পিতার মতো রুগ্ন সংস্কৃতির উন্মেষ ঘটায়, যা জাতিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করে। তোষণ পোষণ ভরণাকাক্সক্ষার চেতনায়  লেখক শিল্পী কবি সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা ভুলে গেছে প্রকৃত তাৎপর্য বিজয়ের। এ বিজয় যে তাঁর প্রকাশের অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে, নতুন দেশ নতুন মানুষ নতুন সমাজ গড়ার সুযোগ এনে দিয়েছে এবং এমন কী বিদ্রোহ প্রকাশ যোগ্য হবার অধিকার নির্মাণ করেছে তা তারা ভুলে গেছেন সুবিধা হাতিয়ে নেয়ার লোভে। লোভে যে সৃষ্টি হয় তা খোড়া, ল্যংড়া, খোজা, অন্ধ; তা’ দিয়ে নতুন স্বপ্ন নির্মাণ কখনও সম্ভব নয়। অথচ এই দীনতাকে নিয়েই প্রতি বছর কত সাহিত্য কবিতা সঙ্গীত রচিত হয়, কিন্তু কোনো কিছুই মানুষের মনন জগতে লাগসই চিন্তার বৃত্ত তৈরি করে না। ফলে বিজয় দিবস একদল পুঁজিপতিদের করায়ত্ত থেকে তার বাণিজ্যিক সুবিধাকে সম্প্রসারিত করে। অবশ্যই এটা জাতির জন্য দুর্যোগের কারণ সংস্কৃতির কর্মকাণ্ড থেকেই সে শেখে পড়তে. লিখতে, জানতে, বুঝতে, অনুধাবন করতে এবং চিন্তাকে সম্পসারিত করে নিজের দিকে তাকাতে নিজেকে পুনরাবিষ্কার করতে। একটি ভাল সাহিত্য যেমন আনন্দের পরিচায়ক তেমনি সে একটি জীবন-সমাজ বুঝবার জানবার এবং ইতিহাস লগ্ন হবারও উপকরণ। একটি কবিতা যেমন নন্দনের তেমনি ভাষা ও জীবনের বহুমাত্রিকতা দেয়ারও প্রকৃষ্ট উদহরণ। সাহিত্য থেকে আমরা সমাজজীবনের যত গভীর বিষয়কে অবলোকন করতে পারি, চিনতে পারি জানতে পারি সম্ভবত অন্য কোন উপকরণ থেকে তা’ হৃদয়ঙ্গম করতে পারি না। সাহিত্য সংস্কৃতিরই একটি জোরালো অংশ। এর মধ্যদিয়ে একটি জাতি তাকে অধীন করার শক্তিকে চিনতে পারে। শিল্প-সাহিত্যের অনুরক্ততা জ্ঞানার্জনের আকাক্সক্ষাকে জাগ্রত করে ন্যায়ের অনুসন্ধানে, ন্যায় এবং অন্যায়ের বিভাজন রেখা নিজ বোধের কাছে স্পষ্টাকরণের শক্তির নির্মাণ করে। একটি ভালো কবিতা, একটি বিপ্লবী শিল্প, একটি বিপ্লবী নাটক, কিংবা সঙ্গীত যাতে জীবন বোধ আছে, পশ্চাতচিন্তা অপসারণের সুযোগসহ স্নিগ্ধ হবার উপায় আছে, হৃদয়কে তৃপ্ত করার অনুষঙ্গ আছে যা আমাদের সমাজের ঐতিহ্য লগ্ন এবং নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টির পথে সংযোগ ঘটায় বিজয় তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, স্মরণ করিয়ে দেয় মানুষকে তার বীরত্ব তার সাহস এবং যুক্ত করে ইতিহাসে। মানুষ কেমন করে মানুষ এ প্রসঙ্গটি খুব একটা অমীমাংসিত নয় এখন, কারণ মানুষ ভাবতে পারে, মানুষের উষ আছে। দেকার্ত বলেছিলেন আমি যে বেঁচে আছি তা অনুভব করতে পারি কারণ আমি চিন্তা করতে পারি। মানুষ কেবল মানুষ নামক প্রাণিই নয় তার মধ্যে ভাষা আছে, ভাষায় প্রকাশ আছে, পরিপাশর্^ বদলাবার উদ্যম আছে। কেউ কেউ মনে করেন সমাজবদ্ধ হবার পর মানুষ সমাজবদ্ধ জীবের প্রত্ন নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। ফলে জন্মের পরের স্তরগুলো সে অনায়াসে স্ব-সামাজের সামাজিক জীব হিসেবেই অতিক্রম করতে পারে। হতে পারে এ কারণেই মানুষ সামাজিক জীব এবং পরবর্তী জীবন প্রবাহে সে সমাজ দ্বারাই পরিপুষ্ট হয়। সাহিত্য একজনের প্রকাশ আর এই প্রকাশ মুক্ত স্বাধীন গতিময় হলে তা’ মানুষের সম্পদ হয়ে ওঠে। একটি প্রকৃত সাহিত্যে অতিরঞ্জন থাকতে পারে শিল্পের নিয়মে কিন্তু তার পরিমিতি যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন সাহিত্যিকের সৎসাহস। জাতিগতভাবে যে সাহস ’৭১ আমাদের মানুষেরা দেখাতে পেরেছিল শিল্পী সাহিত্যিকরা সে সাহসের কথা ভুলে গেছে এবং তারাও তাদের স্বার্থপরতার সৃষ্টি দিয়ে জনগণকেও ভুলে যাবার আবর্তে ফেলেছে। ফলে চর্চার ক্ষেত্রে এক মুখিনতা প্রবল হয়ে বিশ^-সাহিত্যের গতিধারা থেকে বহুতর দূরে আমাদের সাহিত্য দাঁড়িয়ে আছে। যে দিতেও পারছে না নিতেও পারছে না। যদিও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সমাজ-রাজনীতি লগ্ন হয়েই বেড়ে ওঠে, কিন্তু কখনও কখনও ব্যক্তিবোধ, অনুভব, চেতনাজাত উপাত্ত হয়ে উন্মুক্ত করে নতুন চেতনার জগত যা ঋদ্ধি দেয় বে-পথগামী সামাজিক চেতনাকে। আলোড়িত করে, নতুন ভাবনার জন্ম দেয় এবং মানুষকে নতুন ভাবনায় যুক্ত হতে প্রেরণা জোগায়। সে কারণে আমরা দেখি গ্রীক সমাজ পিছিয়ে থাকলেও তার শিল্প-সাহিত্য অকল্পনীয়ভাবে সেই সমাজের সেই সময়ের গর্দভজাত চিন্তা থেকে অনেকখানি অগ্রসরমানতায় এগিয়ে এনেছিল। অয়নীয়রাই ছিল এ ক্ষেত্রে অগ্রপথিক। আমরা দেখি তলেস্টয় কৃষকের দুর্বিসহ জীবনকে সাহিত্যে যথাযথভাবে চিত্রায়িত করার ফলে রুশ সমাজজীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। সংস্কৃতির কাঠামোর মধ্যেই ধর্ম-দর্শন-আইন, সাহিত্য, শিল্প আবর্তিত হয়। রাজনীতি যদি হয় স্বৈরতান্ত্রিক জনগণস্বার্থ অলগ্ন এবং ইচ্ছেবৃত্তির, সেখানে অন্যায় অনিয়ম নীতিহীনতার ওপর থেকে নিচে গড়িয়ে সব কিছুকে কলুষিত করে। আর তার প্রভাবে গোটা সমাজের পারস্পরিক স্বার্থ ছিঁড়ে গিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ প্রবল হয়ে ওঠে। ঝড়ের প্রবল দাপটে যেমন ঘরবাড়ি গাছগাছালি উপড়ে উড়ে ওলটপালট হয় তেমনি জনজীবনের ঐতিহ্যবাহী বিশ^াসগুলো, মূল্যবোধগুলো, ন্যায়গুলো, নিয়মগুলো টুকরা টুকরা হয়ে নানা চাপে তাপে লোভে বাষ্প হয়ে যায়। ফলে একদিকে ভোগ চূড়ান্তরূপ পায় আর অন্যদিকে মানুষ নিঃস্ব হয়ে ঠিকানা খোঁজে। অন্ধবিশ^াস, কুসংস্কার, নিয়তি নির্ভরতা বাড়ে এবং পুরোহিতদের স্বার্থান্ধতাও মানুষকে মোহাবিষ্ট করে মূল ধর্মবিশ^াস থেকে বিচ্ছিন্ন করে, সে বিচ্ছিন্ন হয় তার নিয়মাচার থেকে, আর তা তকে সুন্দর থেকে সরিয়ে নানা সংস্কারপ্রিয় রোবটে পরিণত করে। ফলে একদল লোক অন্যকে উসকায় এবং ভ্রান্তিকে ঈশ^রের নির্দেশ বলে চাপিয়ে পুণ্য হাসিল করতে চায় [সে পুণ্য মূলত অদৃশ্য স্বার্থের, সে ধর্মকে পণ্য করে]।  আর এগুলোও সংস্কৃতির পরিপুষ্টতাকে জীর্ণ করে। অথচ সংস্কৃতির মধ্যেই পরকালের বোধ ন্যায় হয়ে মিশে আছে। আর এসব ঘটে পরিকল্পিতভাবে রাজনৈতিক পরিকল্পনায়। কারণ বিভ্রান্ত করো, শাসন করো, শোষণ করো, লাঠাও পিটাও ও বিচ্ছিন্ন করো, সংঘশক্তির বিলোপ ঘটাও, যাতে তারা সংঘবদ্ধ হতে না পারে, ফিরেও তাকাতে না পারে। তাদেরকে স্বাধীনতার কথা বলো এবং স্বাধীনতা আকাক্সক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন করো। তৈরি করো এমন এক স্বাধীনতা যাতে সে আছে, সে ভাবে সে আছে, অথচ জানে না স্বাধীনতা আসলে কি?  স্তবস্তুতিকারী বেছে নাও কতিপয় বুদ্ধিবৃত্তিক সম্প্রদায় থেকে, সুবিধা দাও, মেডেল দাও এবং তাদেরকে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করো আগামী প্রজন্ম। বিজয় যদি কেবল কতক লোককে হটিয়ে কতক লোককে ক্ষমতাসীন করে তার খড়গের তলে মাথা নুইয়ে দেয়া তা হলে তা হয়ে পড়ে অর্থহীন। অথচ বিজয় অর্জনকালে গণচেতনার রূপটি ছিল আধুনিক এবং গতিময়। সাহিত্যিকদের যে স্বপ্ন নিয়ে তখন থেকে শুরুর প্রয়োজন ছিল তা না ঘটার ফলে পরিস্থিতিটা বিপরীত দিকেই গেছে। শুধু অনুষ্ঠান থেকে মানুষ মনে রেখেছে বিজয়, কিন্তু প্রকৃত তাৎপর্য হারিয়ে হয়ে আছে কতোগুলো পোস্টার কয়টা টিভি নাটক এবং কয়টা বিজয়দিবস সংখ্যার উদ্বোধন। প্রয়োজন নেই এসবের তা সত্য নয়, রয়েছে কিন্তু প্রকাশটা তার বন্দনার হলে তো চেতনার বৈপ্লবিক উত্তরণ বিকলাঙ্গ হয়েই থাকবে। অথচ বিজয় মানেই সব কিছুর উপর বিজয় আর্জন নতুন নির্মাণে শারীরিক, মানসিক প্রস্তুতি। আবর্জনাকে চিহ্নিত করা সংস্কৃতি কর্মীর কাজ তার সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। অথচ এই আবর্জনা আজ চারপাশে আদর্শ হয়ে আছে। এদের কারো কারো একটা অতীত ছিল, আজ আর তার অবশিষ্টটুকু নেই, অথচ সেই অতীতটাই তাদের তোষামোদের দরজায় প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে। এখন আদর্শই যদি না থাকে, কি লিখছি কেন লিখছি, আমার লেখা দ্বারা আমার মতপ্রকাশের দ্বারা রাষ্ট্রশক্তিকে কতটা সচেতন করতে পারছি, কতটা অধিকারের প্রশ্ন কতটা কর্তব্যের সামাজিক দাবি সেই ভাবনালোকে কতটা সহায়তা দিচ্ছি, বা কিভাবে দিতে পারবো, কোন পদ্ধতিতে লেখাগুলো মানুষের হৃদয়কে জাগরিত করবে, ভাবতে বুঝতে সহায়তা দেবে, জানতে অনুসন্ধানে যুক্ত হতে প্রেরণা হবে এবং সত্য ও মিথ্যের প্রভেদরেখাকে ছুঁইতে পারবে এই অনুসন্ধান সকল নির্মাণে প্রতিফলিত না হলে বিভ্রন্তির প্রকাশই ছড়িয়েই পড়বে কাব্যে শিল্পে আনন্দে। ক্ষীণ হয়ে আসবে সম্ভাবনার সাহিত্য বা সৃজনশীল কাজ। এই প্রস্তুতির দায়িত্বটা নিতে হবে আজ সকল পর্যায়ের সংস্কৃতি কর্মীর, গড়ে তুলতে হবে স্বাধীন সংস্কৃতির আন্দোলন।

উষ্ণতার খোঁজে!

উষ্ণতার খোঁজে!

হেমন্ত বিদায়ের পথে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে দুয়ারে দাঁড়ায়ে শীত। এখনি লেপ-কম্বলের প্রয়োজন পরে গেছে। কারিগররাও ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। ক’দিন পর তাদের ব্যস্ততা আরও বেড়ে যাবে। তাই ঝটপট দেখে নিন আপনার ঘরের লেপ-তোষকগুলো ঠিকঠাক এবং পর্যাপ্ত আছে কিনা। সেভাবে তৈরি করে নিন উষ্ণতার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় আপনার ঘরের লেপ-তোষক। না হয় শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে হবে। এক সময় কাঁধে ধুনকার নিয়ে এলাকায় হাঁক দিয়ে বেড়াত ধুনকেরা-‘বানাইবেন লেপ-তোষক’। এখন খুব বেশি দেখা যায় না তাদের। আর ধুনক থাকলেও সেই ধুনকার নেই। এখন তুলা ধুনে মেশিনে। ধুনকার দেখতে ছিল ধনুকের মতো, আকারে বেশ বড়। একটা ছোট লাঠির মাথায় গোল বলের মতো থাকতো। সেটা দিয়ে সুতায় বাড়ি দিলে সুন্দর তালে ঝপাং ঝপাং করে সুরেলা শব্দ হতো। মাঝে মাঝে গানের সুরের আড়ির মতো ঝং করে ছন্দ বদল করত। সেই তালে তুলাগুলো ঝুপ ঝুপ করে উড়ত। আর পাতলা হয়ে আরও বেশি নরম হতে থাকত। কি দারুণ লাগত সেই সুর। আর তুলাধুনা দেখতেও খুব ভালো লাগত। দাম ও পরিমাণ: কথা হলো মগবাজারের কারিগর রমজান মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানালেন, লেপ-তোষক কার্পাস তুলায় বানানো হয়। বড় সাইজের একটা লেপ বানাতে ৪ কেজি তুলা আর ১০ গজ কাপড় লাগে। জায়গাভেদে দাম পড়বে ১৬০০-২০০০ টাকা। লেপের জন্য সাধারণত লাল রঙের কাপড়ই ব্যবহার করা হয়। আর তোষক ও জাজিমে গাঢ় রঙের চেক কাপড়। এসব কাপড়ের গজ ৬০-৭০ টাকা। মাঝারি লেপে লাগবে ৩ কেজি তুলা আর সাড়ে ৭ গজ কাপড়। দাম পড়বে জায়গা ভেদে ১৩০০-১৫০০ টাকা। তবে মজুরি একই, ৪০০ টাকা। জাজিম তৈরি করতে নারিকেলের ছোবড়া ব্যবহার হয়। ছোবড়ার উপরে-নিচে গার্মেন্টেসের এক ধরনের তুলা থাকে। রামপুরার শারমিন বেডিংয়ের দেলোয়ার জানান, এখন ব্যস্ততা বাড়ছে। কয়েকদিন পর দামও ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেড়ে যাবে। জানতে চাইলাম– এখন তো লেপের চাইতে কম্বল, কমফোর্টার বেশি চলছে। তাহলে কি লেপের চাহিদা কমে যাচ্ছে? জবাবে দেলোয়ার জানালেন, লেপের মতো ওম আর আরাম কম্বল বা কমফোর্টারে নেই।

নারী জাগরণের যোদ্ধা

নারী জাগরণের যোদ্ধা

৯ ডিসেম্বর পালিত হলো নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া দিবস। আবার ডিসেম্বর মাস এলেই বিজয়ের রথ যেমন নির্দেশনা পায় একইভাবে নারী নিগ্রহের করুণ আখ্যানও দুঃখজনক। দীর্ঘ নয় মাসের অতৃপ্ত অস্থিরতায় দেশ যখন পাকিস্তানি হানাদারদের নির্মম পেষণে দিশেহারা সেখানে সমসংখ্যক নারীর যে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ তাও ইতিহাসের পাতায় অবিচ্ছেদ্য আর্তনাদ। ত্রিশ লাখ শহীদানের উৎসর্গিত জীবন যেভাবে স্বাধীনতার রক্তস্নানে প্লাবিত হয়েছিল একইভাবে নারীদের সম্ভ্রমহানিতার ইতিবৃত্তি ও দুঃসহ এক পালাক্রম। ধারণা করা হয় ২ লাখ নারীর লাঞ্ছিত দাবানলে রক্তিম সূর্যের যে কালো দাগ সেটা কোনোভাবে মুছে যাওয়ার মতোই নয়। ঘোর অমাবস্যা রাত্রির নির্মম আচ্ছাদন। তাই এই মাসটি স্মরণে, বরণে, তিক্ততায়, নৃশংসতার মিলিত এক বাতাবরণ। আবার ৯ ডিসেম্বর নারীশক্তির আধার বেগম রোকেয়ার জন্ম এবং মৃত্যু দিবস।

জনকণ্ঠ প্রতিষ্ঠাতা আতিকউল্লাহ খান মাসুদের জন্মবার্ষিকীতে দোয়া অনুষ্ঠিত

জনকণ্ঠ প্রতিষ্ঠাতা আতিকউল্লাহ খান মাসুদের জন্মবার্ষিকীতে দোয়া অনুষ্ঠিত

দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বৃহস্পতিবার দোয়া অনুষ্ঠিত হয়েছে।  বৃহস্পতিবার বিকেলে বনানী কবরস্থানে গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের পক্ষ থেকে মরহুমের কবর জিয়ারত করা হয়। কবর জিয়ারত করেন মরহুমের বড় ছেলে গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান মিশাল এ খানসহ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাগণ।  এ ছাড়া বাদ আছর জনকণ্ঠ ভবনে অবস্থিত মসজিদে আতিকউল্লাহ খান মাসুদের জন্য বিশেষ দোয়া করা হয়। জনকণ্ঠের বিভিন্ন বিভাগের কর্মীরা এই দোয়া অনুষ্ঠানে যোগ দেন।  বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ ১৯৫১ সালের ২৯ আগস্ট ভারতের বর্তমান মিজোরাম রাজ্যের লাংলী জেলার ডিমাগিরি নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মোহাম্মদ দবির উদ্দিন খান চাকরি করতেন ভারতীয় বন বিভাগে। চাকরিসূত্রে তিনি সপরিবারে থাকতেন ওখানে। তাদের পৈত্রিক বাড়ি মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং থানার মেদিনীম-ল গ্রামে।   আতিকউল্লাহ খান মাসুদ স্বাধীনতা যুদ্ধে ২নং সেক্টরে কমান্ডার হিসেবে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেন এবং অনেক বড় বড় অপারেশনে অংশ নেন। বিশিষ্ট এই মুক্তিযোদ্ধা একজন সফল শিল্পপতি হিসেবে দৈনিক জনকণ্ঠসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানা গড়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।  তিনি সবাইকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে হঠাৎ করেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২০২১ সালের ২২ মার্চ ভোরে ইন্তেকাল করেন।

সাহসী সম্পাদক ছিলেন আতিকউল্লাহ খান মাসুদ

সাহসী সম্পাদক ছিলেন আতিকউল্লাহ খান মাসুদ

সত্য প্রকাশে দ্বিধাহীন সাহসী সাংবাদিক বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিকউল্লাহ খান মাসুদের আজ বৃহস্পতিবার ৭৩তম জন্মবার্ষিকী। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ডিজিটাল সংবাদপত্রের জনক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। তৎকালীন সফল তরুণ শিল্পপতিদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তিনি বিভিন্ন শিল্প-কারখানা গড়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।  ১৯৯৩ সালে তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে সফল সংযোজন দেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’ প্রকাশ করেন। দেশে তখনো বাংলা ভাষাভিত্তিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অন্তরে ধারণ করে এমন পত্রিকা তেমন একটা ছিল না। দৈনিক জনকণ্ঠই প্রথম বাংলাদেশের আত্মপরিচয়কে তুলে ধরতে অতুলনীয় ভূমিকা পালন করেছে। এখনো সেটা করে চলেছে জনকণ্ঠ। এটি সম্ভব হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদের সাহসী অনুপ্রেরণার কারণে।  শুধু বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অন্তরে ধারণই নয়, আতিকউল্লাহ খান মাসুদই দেশে প্রথম প্রযুক্তিভিত্তিক পত্রিকা বের করার কথা চিন্তা করেন। প্রযুক্তিতে ৩২৪ বছর পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের জন্য এটি ছিল এক অনন্য অগ্রযাত্রা। কারণ, তখনো দেশে অনলাইন ইন্টারনেটের যুগ শুরু হয়নি।