ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২২ এপ্রিল ২০২৫, ৯ বৈশাখ ১৪৩২

মস্তিষ্ক ঠিক কীভাবে শেখে? গবেষণায় মিলল অজানা তথ্য!

প্রকাশিত: ১১:৫১, ২২ এপ্রিল ২০২৫

মস্তিষ্ক ঠিক কীভাবে শেখে? গবেষণায় মিলল অজানা তথ্য!

আমরা প্রতিদিন কিছু না কিছু শিখি,কখনো অভিজ্ঞতা থেকে, কখনো শুনে কিংবা দেখে। কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ক ঠিক কীভাবে এই শেখার প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে, তা কি আমরা জানি? এতদিন ধরে বিজ্ঞানীরা ধারণা করতেন মস্তিষ্ক নির্দিষ্ট নিয়মে তথ্য গ্রহণ ও বিশ্লেষণ করে শেখে। 


তবে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে এক চমকপ্রদ তথ্য,আমাদের শেখার পদ্ধতি সম্পর্কে এতদিন যা ধারণা ছিল, তা সম্পূর্ণ নয়! নতুন এই গবেষণায় মানুষের মস্তিষ্কের অজানা এক শিক্ষণ প্রক্রিয়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, যা নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন করে ভাবনা।

আপনি যখন নতুন কোনো রান্না শেখেন, কারও পরামর্শে নতুন বই পড়েন বা কোনো আন্তর্জাতিক খবর পড়েন—আপনার মস্তিষ্ক সেই তথ্যগুলো ধরে রাখে অনেক বছর, এমনকি জীবনের শেষ পর্যন্ত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাদের মস্তিষ্ক এই অসাধ্য কাজটা কীভাবে করে?


‘সায়েন্স’ জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এতদিন আমরা মস্তিষ্কের শেখার পদ্ধতি সম্পর্কে যা জেনে এসেছি, তার বড় অংশই ভুল। নতুন আবিষ্কারে উঠে এসেছে—মস্তিষ্ক শেখার জন্য একটিমাত্র নিয়ম মেনে চলে না, বরং একই সঙ্গে একাধিক নিয়ম অনুসরণ করে।


মস্তিষ্কের শেখার গোপন রহস্য
আমাদের মস্তিষ্কে বিলিয়ন সংখ্যক নিউরন বা স্নায়ুকোষ রয়েছে। প্রতিটি নিউরন বৈদ্যুতিক সংকেত চালনা করে, যার মাধ্যমে তথ্য পরিবাহিত হয়,একটু যেন কম্পিউটারের ‘বাইনারি কোড’ সিস্টেমের মতো।


এই নিউরনগুলো একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত ‘সিন্যাপ্স’-এর মাধ্যমে। প্রতিটি নিউরনের শাখামতো অংশ, অর্থাৎ ডেনড্রাইট, হাজার হাজার ইনপুট গ্রহণ করতে পারে। এই ইনপুটগুলো মস্তিষ্কের প্রধান নিউরনে পৌঁছায় এবং তখন তা নতুন বৈদ্যুতিক সংকেত তৈরি করে।


নিউরনের এই সম্মিলিত সংকেতই আমাদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও তথ্যের মানসিক প্রতিচ্ছবি তৈরি করে। এখন পর্যন্ত মনে করা হতো, এই শেখার প্রক্রিয়া একটিমাত্র নিয়মে চলে—যেটি বলা হয় Hebbian learning rule, অর্থাৎ যেসব নিউরন একসঙ্গে সক্রিয় হয়, তারা একে অপরের সংযোগ শক্তিশালী করে।


গবেষণায় কী দেখা গেল?
গবেষকরা এই পুরনো ধারণা ভাঙতে গিয়ে আশ্চর্য তথ্য খুঁজে পান। তাঁরা ইঁদুরের মস্তিষ্কে জেনেটিকভাবে একধরনের বায়োসেন্সর প্রবেশ করান, যা নিউরন ও সিন্যাপ্সের কার্যক্রম ‘রিয়েল টাইম’-এ দেখাতে পারে। এরপর সেই ইঁদুরগুলোকে একটি নির্দিষ্ট শব্দ শুনে একটি লিভার নির্দিষ্ট জায়গায় ঠেলে পানি পাওয়ার মতো একটি টাস্ক শেখানো হয়।


গবেষণায় দেখা যায়, একেকটি নিউরনের বিভিন্ন শাখা বা ডেনড্রাইটে থাকা সিন্যাপ্সগুলো ভিন্ন ভিন্ন নিয়মে কাজ করছে। কিছু সিন্যাপ্স হেবিয়ান নিয়মে চলেছে, অর্থাৎ একসঙ্গে সক্রিয় হয়ে সংযোগ শক্তিশালী করেছে। আবার কিছু সিন্যাপ্স সম্পূর্ণ আলাদা নিয়মে পরিবর্তিত হয়েছে,এমনকি কখনো কখনো নিউরনের সাধারণ বৈদ্যুতিক সক্রিয়তার সঙ্গেও তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না!


মস্তিষ্ক শেখে মাল্টিটাস্কিং করে!
এই গবেষণার সবচেয়ে বড় উপসংহার হলো,নিউরন একযোগে একাধিক শিখনপদ্ধতি অনুসরণ করতে পারে। অর্থাৎ, মস্তিষ্ক একসঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ইনপুট প্রসেস করে, তাদের আলাদাভাবে সমন্বয় করে, এবং এই মাল্টিটাস্কিং-এর মাধ্যমে অনেক বেশি তথ্য শেখা ও সংরক্ষণ সম্ভব হয়।এটি একটি বড় ব্রেকথ্রু, কারণ এর মানে হলো মস্তিষ্ক এতদিন যা ভাবা হতো তার চেয়েও অনেক বেশি বুদ্ধিমান ও নমনীয়।


মানসিক স্বাস্থ্যে নতুন দিগন্ত খুলতে পারে এই আবিষ্কার
গবেষণাটি শুধু তাত্ত্বিক নয়, বরং মানসিক রোগ এবং নিউরোডিজেনারেটিভ ডিজঅর্ডার বোঝার ক্ষেত্রেও দারুণ গুরুত্বপূর্ণ।
উদাহরণ হিসেবে, বিষণ্ণতার ক্ষেত্রে অনেক সময় মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে সিন্যাপ্টিক সংযোগ অস্বাভাবিকভাবে দুর্বল হয়ে যায়। ফলে আনন্দ বা উত্তেজনার অনুভূতি অনেকটাই নিস্প্রভ হয়ে পড়ে। এই গবেষণা জানাতে সাহায্য করতে পারে—এই সংযোগগুলো কেন ভাঙে এবং কীভাবে সেগুলোকে আবার মজবুত করা যায়।


এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাতেও বড় সম্ভাবনা
বর্তমানে এআই বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স যেভাবে কাজ করে, তা অনেকাংশে মানব মস্তিষ্ক অনুকরণ করেই। তবে এক্ষেত্রে একটি বড় সীমাবদ্ধতা হলো-এআই সিস্টেমে সাধারণত একটিমাত্র ‘লার্নিং রুল’ ব্যবহার করা হয়, যা বাস্তব জীবনের মতো জটিল নয়।
এই গবেষণার সূত্র ধরে বিজ্ঞানীরা এমন ধরনের এআই তৈরি করতে পারবেন, যা অনেক বেশি বাস্তবঘনিষ্ঠ, দক্ষ ও নমনীয় হবে।


গবেষণাটি নতুন দিগন্ত খুললেও এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর অধরা। যেমন,কোন সিন্যাপ্স কীভাবে নির্ধারণ করে কোন নিয়ম অনুসরণ করবে? মস্তিষ্ক কীভাবে এই নিয়মগুলো নির্বাচন করে? এমনকি এই মাল্টিপল লার্নিং-সিস্টেমের আরও কোন অজানা সুবিধা থাকতে পারে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে আরও গবেষণা প্রয়োজন। তবে আপাতত এটি স্পষ্ট আমাদের মস্তিষ্কের শেখার পদ্ধতি শুধু বিস্ময়কর নয়, বরং অনেক বেশি কার্যকর ও সুচিন্তিত।

 

 

 

সূত্র:https://tinyurl.com/yc6yn54u

আফরোজা

×