
আমরা কি সত্যিই আমাদের শৈশবের মুহূর্তগুলো মনে করতে পারি? হয়তো আপনার মনে হয়, আপনি শিশুকালে দোলনায় শুয়ে ছিলেন, কিংবা প্রথম জন্মদিনের কেকের স্বাদ এখনো মনে আছে। কিন্তু বিজ্ঞান বলছে, এসব স্মৃতি আসলে বাস্তব নয়।
গবেষণা অনুযায়ী, বেশিরভাগ মানুষ জীবনের প্রথম কয়েক বছরের ঘটনা মনে রাখতে পারে না। তবে নতুন এক গবেষণা বলছে, শিশুরা আসলে খুব ছোট বয়স থেকেই স্মৃতি তৈরি করতে শুরু করে। শুধু তা-ই নয়, বিজ্ঞানীরা এবার প্রথমবারের মতো শিশুদের মস্তিষ্কে সেই স্মৃতির গঠন হতে দেখেছেন—তা-ও সরাসরি!
গবেষণায় কী পাওয়া গেছে?
ইয়েল এবং কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এক অভিনব পরীক্ষা চালান। তারা ৪ থেকে ২৫ মাস বয়সী শিশুদের মস্তিষ্কের বিশেষ স্ক্যান করেন, যাতে তারা দেখতে পান, শিশুরা কোনো বস্তু বা মুখ দেখার সময় কীভাবে তাদের মস্তিষ্কে স্মৃতি গঠিত হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, যখন কোনো শিশু প্রথমবারের মতো একটি ছবি দেখে, তখন তার হিপোক্যাম্পাস (স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মস্তিষ্কের অংশ) সক্রিয় হয়ে ওঠে। পরে একই ছবি আবার দেখানো হলে, শিশু সেটির দিকে বেশি সময় ধরে তাকিয়ে থাকে—যা প্রমাণ করে, সে আগের দেখা ছবিটি চিনতে পারছে!
গবেষণার প্রধান গবেষক ট্রিস্টান ইয়েটস বলছেন, "আমাদের গবেষণা প্রমাণ করছে যে শিশুরা আসলেই স্মৃতি তৈরি করতে পারে। তবে সেই স্মৃতি কতদিন থাকে, সেটাই বড় প্রশ্ন।"
আমরা কবে থেকে স্মৃতি তৈরি করতে শুরু করি?
বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, শিশুরা সাধারণত ১৮-২৪ মাস বয়সের পর থেকে ব্যক্তিগত স্মৃতি তৈরি করতে পারে। কিন্তু নতুন গবেষণা বলছে, এই প্রক্রিয়া আরও আগেই শুরু হয়।
২-৩ মাস বয়স থেকেই শিশুরা কিছু ধরনের স্মৃতি তৈরি করতে শুরু করে, যেমন—
মুখ, ভাষা ও রুটিনের প্যাটার্ন বুঝতে পারা (স্ট্যাটিস্টিকাল লার্নিং)
শারীরিক দক্ষতা ও প্রতিক্রিয়া শেখা (ইম্প্লিসিট মেমোরি)
কিন্তু নির্দিষ্ট ঘটনা মনে রাখার ক্ষমতা, যাকে "এপিসোডিক মেমোরি" বলা হয়, সেটি বিকাশ পেতে কিছুটা সময় লাগে। কারণ এটি মূলত হিপোক্যাম্পাসের পূর্ণ বিকাশের ওপর নির্ভর করে।
আমরা কেন শৈশবের স্মৃতি মনে রাখতে পারি না?
এটি এতটাই সাধারণ ব্যাপার যে, বিজ্ঞানীরা একে "ইনফ্যানটাইল অ্যামনেশিয়া" বলে নাম দিয়েছেন।আগে মনে করা হতো, শিশুদের মস্তিষ্ক তখনো স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য তৈরি হয়নি। কিন্তু নতুন গবেষণা বলছে, শিশুদের মস্তিষ্ক আসলে স্মৃতি তৈরি করে, কিন্তু আমরা বড় হয়ে গেলে সেই স্মৃতিগুলো হারিয়ে যায়।
এর পেছনে বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে—
নতুন নিউরন তৈরি হওয়া: ছোটবেলায় আমাদের মস্তিষ্ক এত দ্রুত নিউরন তৈরি করে যে, পুরনো স্মৃতিগুলো হয়তো তার নিচে চাপা পড়ে যায়। ইঁদুরের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, যদি এই নিউরন তৈরির গতি কমিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তারা বেশি দিন স্মৃতি ধরে রাখতে পারে।
ভাষার অভাব: ছোটবেলায় আমাদের ভাষাগত দক্ষতা না থাকায় আমরা স্মৃতিগুলোকে চিন্তা বা কথার মাধ্যমে সংরক্ষণ করতে পারি না।
শিক্ষার জন্য পুরনো স্মৃতি বাদ দেওয়া: কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন, আমাদের মস্তিষ্ক হয়তো অপ্রয়োজনীয় পুরনো স্মৃতিগুলো মুছে ফেলে, যাতে আমরা নতুন তথ্য আরও ভালোভাবে শিখতে পারি।
কিছু মানুষ কি শৈশবের স্মৃতি মনে করতে পারে?
অনেকে বলেন, তারা তাদের শৈশবের কিছু মুহূর্ত স্পষ্ট মনে করতে পারেন। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, এগুলো মূলত "সূত্র বিভ্রান্তি" (source misattribution) এর ফল।
অর্থাৎ, হয়তো আপনি ছোটবেলায় কোনো ঘটনায় কেঁদেছিলেন, কিন্তু আপনি সেটি মনে রাখেননি। পরে যখন বাবা-মা গল্প করেছেন, বা পুরনো ছবি দেখেছেন, তখন সেই তথ্যকে নিজের স্মৃতি বলে ধরে নিয়েছেন।
ভবিষ্যতে কি শৈশবের স্মৃতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব?
এটি এখনো রহস্য, আমাদের শৈশবের স্মৃতিগুলো পুরোপুরি মুছে যায়, নাকি মস্তিষ্কের গভীরে কোথাও লুকিয়ে থাকে।
ইঁদুরের ওপর করা গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, বিশেষ পদ্ধতিতে মস্তিষ্কের কোষ পুনরায় সক্রিয় করলে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তবে মানুষের ক্ষেত্রে এটি এখনো সম্ভব হয়নি।
কিছু গবেষক মনে করেন, কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে হয়তো শৈশবের স্মৃতি ফিরে পাওয়া সম্ভব। তবে এর সত্যতা যাচাই করা বেশ কঠিন।বিজ্ঞান এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত নয় যে, আমরা শৈশবের স্মৃতি কেন হারিয়ে ফেলি। তবে এটি নিশ্চিত, শিশুরা খুব ছোট বয়স থেকেই স্মৃতি তৈরি করতে শুরু করে।
হয়তো কোনো একদিন আমরা জানতে পারব, আমাদের হারিয়ে যাওয়া শৈশবের স্মৃতিগুলো কি মস্তিষ্কের কোথাও গোপনে লুকিয়ে আছে, নাকি সত্যিই চিরতরে হারিয়ে গেছে!
সূত্র: আল-জাজিরা
আফরোজা