ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৯ মার্চ ২০২৫, ৫ চৈত্র ১৪৩১

মহাকাশে প্রথম মানব বসতি, সেখানে কেমন কাটে জীবন?

প্রকাশিত: ২২:২০, ১৮ মার্চ ২০২৫

মহাকাশে প্রথম মানব বসতি, সেখানে কেমন কাটে জীবন?

ছবি: সংগৃহীত।

শূন্যে ভাসছে বিশাল এক কাঠামো, যেখানে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ নেই, নেই দিন-রাতের হিসাব। প্রতি ৯০ মিনিটে একবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে, আর একদিনে ১৬ বার সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখতে পায় এখানকার বাসিন্দারা। এই কাঠামোটি হল ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন (আইএসএস), যা মানব সভ্যতার অন্যতম বিস্ময়কর প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন।

আইএসএস কি এবং কেন তৈরি করা হয়েছিল? ১৯৯৮ সালে প্রথম মডিউল উৎক্ষেপণের মাধ্যমে শুরু হয় আইএসএস-এর যাত্রা। এটি কেবল একটি গবেষণাগার নয়, বরং ভবিষ্যতের মহাকাশ অভিযানের একটি পরীক্ষাকক্ষ। পৃথিবীর মহাকর্ষীয় শক্তি থেকে মুক্ত হয়ে বিজ্ঞানীরা এখানে গবেষণা চালান—মানবদেহের উপর মহাকাশের প্রভাব, মহাকাশ কৃষি, নতুন ধরনের ওষুধের সম্ভাবনা, এবং এমন সব গবেষণা যা পৃথিবীতে সম্ভব নয়।

নাসা, রাশিয়ান স্পেস এজেন্সি রসকসমস, জাপান এরোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি (জ্যাকসা), ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ), এবং ক্যানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি (সিএসএ)—এই পাঁচ মহাকাশ সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তৈরি হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন। এখানে মানুষ প্রথমবারের মতো মহাকাশে বসতি স্থাপনের চেষ্টায় সফল হয়েছে।

কিভাবে কাজ করে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন?
পৃথিবী থেকে ৪০০ কিলোমিটার উপরে অবস্থিত আইএসএস সম্পূর্ণরূপে সৌরশক্তির উপর নির্ভরশীল এবং এর বিশাল সোলার প্যানেল গুলো প্রতি ঘন্টায় ১৫ কিলোওয়াট শক্তি উৎপন্ন করে। কিন্তু ভাবুন, স্টেশনটি প্রতি সেকেন্ডে ৭৬ কিলোমিটার বেগে ছুটে চলেছে, যা একটি গাড়ির তুলনায় প্রায় ২৮ গুণ বেশি। এর মানে হলো, আইএসএস প্রতি ২৪ ঘন্টায় ১৬ বার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। আপনি যদি আইএসএস-এর একজন যাত্রী হতেন, তাহলে আপনি প্রতিদিন ১৬ বার সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখতেন।

আইএসএস-এ রয়েছে একটি প্রাপশন সিস্টেম, যা মূলত রাশিয়ান জেভেজডা মডিউল এবং সংযুক্ত কারগোজগুলোর থ্রাস্টার ব্যবহার করে কাজ করে। এটি মাঝে মাঝে চালু করা হয়, যাতে মহাকর্ষীয় টান ও বায়ুমন্ডলের ক্ষীণ ঘর্ষণের ফলে কমে আসা কক্ষপথের উচ্চতা ঠিক রাখা যায়।

মহাকাশচারীদের জীবনযাপন
মহাকাশে থাকা এই মানব সৃষ্ট বসতিতে প্রতিদিনের জীবনযাপন একটি অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। এখানে খাদ্য প্রস্তুত, পানির পুনঃব্যবহার এবং বাতাস পরিশোধনের মত জটিল প্রক্রিয়া গুলো চলতে থাকে। স্পেস এক্স এবং অন্যান্য বেসরকারি মহাকাশ সংস্থাগুলো আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তারা মহাকাশে সরঞ্জাম এবং খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্য পাঠানোর পাশাপাশি নভোচারীদের পরিবহনেও সাহায্য করছে।

মহাকাশচারীরা কিভাবে বেঁচে থাকে?
আইএসএস-এ মহাকাশচারীরা বিশেষভাবে প্যাকেজ করা খাবার খান, যা পৃথিবীতে থাকা মানুষের খাবারের স্বাদ ও পুষ্টি বজায় রাখে। পানির জন্য, আইএসএস-এ প্রতিবছর ৩০০০ লিটার বিশুদ্ধ পানি তৈরি করা হয়, যা আসে বাতাসের আর্দ্রতা এবং প্রসেস করা বর্য জল থেকে। অবাক কান্ড হলো, তারা ৯৫ শতাংশ পানি পুনরায় ব্যবহার করতে সক্ষম, যা মহাকাশে টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মহাকাশচারীদের প্রতিদিন অন্তত দুই ঘণ্টা ব্যায়াম করতে হয়, কারণ শূন্য মাধ্যাকর্ষণের পরিবেশে শরীরের হাড় ও পেশি ব্যবহৃত না হওয়ায় দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে, এক মাস মহাকাশে থাকলে পেশির শক্তি ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে এবং হাড়ের ঘনত্ব এক শতাংশ কমে যেতে পারে। এজন্য মহাকাশচারীদের ট্রেডমিল, স্ট্রেন্থ ট্রেনিং এবং সাইক্লিং এর মত বিশেষ ব্যায়াম করতে হয়, যাতে পৃথিবীতে ফিরে আসার পর তারা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারে।

মহাকাশে ঘুম
মহাকাশচারীরা বিশেষ ডিজাইন করা ছোট স্লিপিং পডে ঘুমান। এই পডগুলো শূন্য মাধ্যাকর্ষণে নিরাপদ ও আরামদায়ক বিশ্রামের জন্য তৈরি। পডের ভেতরে মহাকাশচারীদের ব্যক্তিগত জায়গা থাকে, যেখানে তারা নিজেদের ঘুমানোর জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু পেয়ে থাকেন। প্রতিটি পডে একটি লাইট, ভেন্টিলেশন সিস্টেম এবং কম্পন নিয়ন্ত্রণ থাকে, যা তাদেরকে শান্তিপূর্ণভাবে ঘুমাতে সাহায্য করে।

ভবিষ্যত
আইএসএস-এর আয়ুষ্কাল এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। ২০৩০ সালের পর এটি সম্ভবত অস্তিত্ব হারাতে পারে, যা মহাকাশ গবেষণার ভবিষ্যতের জন্য উদ্বেগের বিষয়। তাই নাসা এবং অন্যান্য মহাকাশ সংস্থাগুলো নতুন স্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে লুনার গেটওয়ে, যা চাঁদের কক্ষপথে স্থাপিত হবে। এটি শুধু একটি গবেষণার কেন্দ্র নয়, বরং চাঁদে মানব বসতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে এবং ভবিষ্যতে মঙ্গল গ্রহে অভিযানের জন্য প্রস্তুতির পথ তৈরি করবে।

ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন মহাকাশে মানুষের প্রথম আবাসস্থল হিসেবে কাজ করছে, যেখানে বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন গবেষণার মাধ্যমে মহাবিশ্বের গোপন রহস্য উন্মোচন করছেন। এই স্টেশনটি মানবজাতির জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে এবং চাঁদ ও মঙ্গলে বসবাসের স্বপ্নকে আরো বাস্তবমুখী করে তুলেছে।

নুসরাত

×