ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৫ মার্চ ২০২৫, ২১ ফাল্গুন ১৪৩১

প্রাচীন হিমবাহের সন্ধান থেকে জটিল প্রাণের বিবর্তনের রহস্য উন্মোচন

প্রকাশিত: ০৩:৩১, ৫ মার্চ ২০২৫; আপডেট: ০৩:৩৩, ৫ মার্চ ২০২৫

প্রাচীন হিমবাহের সন্ধান থেকে জটিল প্রাণের বিবর্তনের রহস্য উন্মোচন

ছবি : সিএনএন

বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, অর্ধ বিলিয়ন বছরেরও বেশি সময় আগে, বরফে আচ্ছাদিত শীতল পৃথিবীতে হিমবাহগুলি ভূমির খনিজ উপাদান সংগ্রহ করে সাগরে ফেলে দিয়ে জটিল প্রাণের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহ করেছিল।

নতুন এক গবেষণার মতে, বিশাল হিমবাহগুলো বরফে ঢাকা ভূমির উপর দিয়ে অগ্রসর হওয়ার সময় পৃথিবীর ভূত্বকের শিলাগুলোকে ক্ষয় করে এবং গভীর ক্ষত তৈরি করেছিল। পরবর্তীতে, যখন এই হিমবাহগুলো গলে যায়, তখন তারা প্রচুর পরিমাণে স্থলভাগের রাসায়নিক উপাদান সমুদ্রে প্রবাহিত করে। গবেষকদের মতে, এই "হিমবাহের ঝাড়ু" ভূমির খনিজ উপাদান সমুদ্রের রাসায়নিক গঠনে পরিবর্তন এনেছিল এবং পুষ্টি উপাদান যুক্ত করেছিল, যা জটিল প্রাণের বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

এই প্রাচীন বরফ যুগ, যা নিওপ্রোটেরোজোয়িক যুগ বা "স্নোবল আর্থ" (বরফ বল পৃথিবী) নামে পরিচিত, প্রায় ১ বিলিয়ন বছর আগে শুরু হয়ে ৫৪৩ মিলিয়ন বছর আগে শেষ হয়েছিল। সে সময় পৃথিবীর ভূমি একত্রিত হয়ে রোডিনিয়া নামক এক বিশাল মহাদেশ গঠন করেছিল এবং পরে তা ভেঙে যায়। প্রাথমিক জীবন যেমন মাইক্রোবস, সায়ানোব্যাকটেরিয়া, স্পঞ্জ ও সাগরের তলদেশে বসবাসকারী জীব সমুদ্রকে বাসস্থান বানিয়েছিল। এই যুগের শেষে প্রথমবারের মতো কবচ, খোলস ও কাঁটা বিশিষ্ট সামুদ্রিক প্রাণী দেখা যায়, যা জটিল প্রাণের বিবর্তনের সূচনা করে।

এতদিন বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এবং সমুদ্রের অগভীর পানিতে অক্সিজেনের বৃদ্ধি এই বিবর্তনের প্রধান কারণ। তবে, মঙ্গলবার "জিওলজি" জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় বিজ্ঞানীরা বলেছেন, প্রাচীন হিমবাহের গতিবিধিই সমুদ্রের রাসায়নিক পরিবর্তন এনেছিল, যা জটিল প্রাণের বিবর্তনে সহায়ক হয়েছিল।

প্রাচীন জলবায়ু থেকে বর্তমান জলবায়ু সংকটের শিক্ষা

"স্নোবল আর্থ" অধ্যয়ন করে শুধু পৃথিবীর অতীত সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় না, এটি আধুনিক জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয় বলে জানিয়েছেন গবেষণার প্রধান লেখক ড. ক্রিস কার্কল্যান্ড।

তিনি বলেন, "আমাদের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস দেখায় যে পৃথিবীর একটি অংশে পরিবর্তন ঘটলে তা অন্য অংশেও প্রভাব ফেলে।" তবে, অতীতের পরিবর্তনগুলো কোটি বছর ধরে ঘটেছে, আর এখন মানবসৃষ্ট জলবায়ু সংকটের ফলে পৃথিবী দ্রুত উষ্ণ হয়ে যাচ্ছে।

"এই দ্রুত পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর স্বাভাবিক ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে," বলেন কার্কল্যান্ড।

বরফ যুগ থেকে উষ্ণ পৃথিবী

হিমবাহের চলাচল বা গ্লেসিয়েশন ভূমির খনিজ পদার্থ সমুদ্র, হ্রদ ও নদীতে স্থানান্তর করে, যা জলজ খাদ্য শৃঙ্খলার ভিত্তি তৈরি করে। তবে, বিজ্ঞানীরা এতদিন জানতেন না যে নিওপ্রোটেরোজোয়িক যুগের হিমবাহগুলো আদৌ নড়াচড়া করেছিল কি না, অথবা এতটাই চলাচল করেছিল যে তারা ভূমির ক্ষয় ঘটিয়ে খনিজ সমুদ্রে নিয়ে যেতে পেরেছিল কি না।

কার্কল্যান্ড বলেন, "অনেকে ধারণা করতেন যে 'স্নোবল আর্থ' এর বরফ মহাদেশের অভ্যন্তরীণ অংশে ব্যাপক ক্ষয় সৃষ্টি করেছিল, কিন্তু এটি কতটা সক্রিয় ছিল তা স্পষ্ট ছিল না। কারণ, অনেকেই মনে করতেন এই বরফ হয়তো একেবারেই স্থির ছিল বা সামান্যই নড়াচড়া করেছিল।"

স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডে খনিজ বিশ্লেষণে স্নোবল আর্থের রহস্য উন্মোচন

ড. কার্কল্যান্ড এবং তার সহকর্মীরা স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ডে নিওপ্রোটেরোজোয়িক যুগের শিলা গঠনের স্তর থেকে সংগ্রহ করা অবক্ষেপ (সেডিমেন্ট) পরীক্ষা করে তাদের গবেষণার উত্তর খুঁজে পেয়েছেন। গবেষক দল জিরকন (zircon) নামক এক ধরনের স্ফটিকযুক্ত খনিজ পরীক্ষা করেছেন, যা অত্যন্ত টেকসই এবং কঠিন ভূতাত্ত্বিক ঘটনাগুলোর মধ্যেও অবিকৃত থাকতে পারে।

জিরকনে ইউরেনিয়াম থাকে, যা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে সময়ের সাথে বিভিন্ন পর্যায়ে রূপান্তরিত হয়। এই ইউরেনিয়ামের ক্ষয়ের হার পরিমাপের মাধ্যমে ভূতাত্ত্বিকরা পৃথিবীর অতীত সম্পর্কে ধারণা পেয়ে থাকেন।

প্রাচীন বরফ যুগ ও পরবর্তী উষ্ণ পৃথিবীর পার্থক্য

গবেষকরা এমন সময়ের অবক্ষেপ পরীক্ষা করেছেন, যখন পৃথিবী সম্পূর্ণ বরফে আবৃত ছিল, এবং এরপর "হটহাউস আর্থ" (উষ্ণ পৃথিবী) সময়কালের নমুনা নিয়েও পরীক্ষা চালিয়েছেন, যখন বরফ গলে গিয়েছিল। তারা দেখতে পান যে স্নোবল আর্থ যুগের খনিজ উপাদান পরবর্তী সময়ের অবক্ষেপের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল।

ড. কার্কল্যান্ড CNN-কে এক ইমেইলে জানান, "আমরা এই খনিজ কণাগুলোর বৈশিষ্ট্যে অনন্য কিছু পরিবর্তন দেখতে পেয়েছি। মূলত, এই শিলা স্তরগুলোর ‘ডিএনএ’ ফিঙ্গারপ্রিন্ট বদলে গেছে।"

গবেষণার মূল্যায়ন ও বিতর্ক

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ভূতত্ত্বের অধ্যাপক ড. গ্রাহাম শিল্ডস, যিনি এই গবেষণায় সরাসরি জড়িত ছিলেন না, তিনি বলেন, এই গবেষণার ফলাফল হিমবাহের সক্রিয়তার ধারণাকে কিছুটা সমর্থন করে। তবে, তিনি ইঙ্গিত দেন যে গবেষণায় মারিনোয়ান বরফ যুগ (Snowball Earth-এর শেষ পর্যায়) সম্পর্কিত তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

ড. শিল্ডস আরও বলেন, "গ্লেসিয়াল ক্ষয়ের সাথে জটিল প্রাণের বিবর্তনের সংযোগ আগেও প্রস্তাব করা হয়েছিল, তবে এটি বিতর্কিত, কারণ সংযোগটি ব্যাখ্যার চেয়ে অনুমাননির্ভর।"

তিনি বলেন, "নাটকীয় ভৌগলিক পরিবর্তনের ফলে বৃহৎ আকারের প্রাণীর উদ্ভব হয়েছিল—এটি আকর্ষণীয় ধারণা। তবে এই গবেষণায় মূলত একটি পরীক্ষাযোগ্য অনুমান উপস্থাপন করা হয়েছে, বিতর্কের সমাধান করা হয়নি।"

হিমবাহ গলে যাওয়ার ফলে সমুদ্রের রূপান্তর

স্নোবল আর্থ যুগের শিলাগুলোর মধ্যে পুরনো খনিজ উপাদান পাওয়া গেছে, এবং এগুলোর মধ্যে বিভিন্ন সময়ের খনিজ মিশ্রিত ছিল। এটি দেখায় যে এই শিলাগুলো বরফের চাপ ও গতির ফলে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে।

তবে, বরফ গলার সময় পাওয়া শিলাগুলোর মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম বয়সী খনিজ ছিল, এবং তাতে ভঙ্গুর কণার অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে প্রবাহিত পানি আগের ক্ষয়ে যাওয়া পদার্থকে দ্রবীভূত করে ধুয়ে নিয়ে গেছে।

নিওপ্রোটেরোজোয়িক যুগের শেষের দিকে সমুদ্রের রাসায়নিক গঠনে ইউরেনিয়ামের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল। আগের গবেষণাগুলো এই বৃদ্ধিকে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধির সাথে যুক্ত করেছিল। তবে, ড. কার্কল্যান্ড বলেন, "আমাদের তথ্য ইঙ্গিত দেয় যে এই রাসায়নিক উপাদানসমূহ সমুদ্রে পৌঁছানোর আরেকটি কারণ ছিল ভূমি থেকে খনিজ পদার্থের প্রবাহ।"

তিনি আরও বলেন, "এই শিলাগুলোর মধ্যে যে ‘নিখোঁজ’ দ্রবীভূত উপাদান ছিল, সেটিই পরবর্তীতে সমুদ্রের রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে আবার ফিরে এসেছে।"

গবেষকরা বলছেন, "ভূতাত্ত্বিক ও সামুদ্রিক পরিবেশের পরিবর্তনগুলোর মানচিত্র তৈরি করে আমরা দেখতে পাচ্ছি কীভাবে পৃথিবীর একটি অংশের রাসায়নিক উপাদান অন্য অংশে স্থানান্তরিত হয়েছে।"

স্নোবল আর্থ যুগে বরফ যুগের সমাপ্তি এবং রাসায়নিক পরিবর্তন

গবেষকদের মতে, প্রায় ৭২০ মিলিয়ন থেকে ৬৩৫ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে অন্তত দুটি প্রধান হিমবাহ যুগ (glaciation events) সংঘটিত হয়েছিল। নিওপ্রোটেরোজোয়িক যুগের শেষে, যখন পৃথিবীর বরফ ধীরে ধীরে গলতে শুরু করেছিল, তখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ও মহাসাগরে গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটছিল।

ড. কার্কল্যান্ড বলেন, "এই হিমবাহ যুগের সমাপ্তি চিহ্নিত হয়েছিল বায়ুমণ্ডল ও সমুদ্রের অক্সিজেনের দ্রুত বৃদ্ধির মাধ্যমে। এটি সম্ভবত পাথরের ওপর আবহাওয়াজনিত ক্ষয়ের (weathering) বৃদ্ধি এবং সমুদ্রে পুষ্টি উপাদানের প্রবাহ বৃদ্ধির কারণে হয়েছিল।" এই পরিবর্তনগুলোর ফলে পুষ্টি চক্র আরও সমৃদ্ধ হয়েছিল এবং জটিল প্রাণী বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছিল।

নতুন গবেষণা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির পৃথিবী ও গ্রহবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. অ্যান্ড্রু নল, যিনি এই গবেষণায় সরাসরি যুক্ত ছিলেন না, জানান, "নিওপ্রোটেরোজোয়িক বরফ যুগের বরফগলা ধ্বংসাবশেষ (glacial debris) প্রাণীর বিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করেছিল—এই ধারণাটি আগেও ছিল।"

তবে, তিনি মনে করেন এখনও প্রশ্ন রয়ে গেছে যে, এই হিমবাহ যুগের কারণে সমুদ্রে যে খনিজ পদার্থ প্রবাহিত হয়েছিল, তা দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশগত পরিবর্তন আনতে যথেষ্ট ছিল কি না।

ড. নল আরও বলেন, আগের গবেষণাগুলো দেখিয়েছে যে এই ধরনের বরফ যুগের প্রভাব হয়তো সাময়িক ছিল—অর্থাৎ, পুষ্টি উপাদানের একটি বড় অংশ স্বল্প সময়ের জন্য প্রাথমিক উৎপাদন (primary production) এবং অক্সিজেনের স্তর বাড়াতে পারে, কিন্তু পরে পরিবেশ আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়।

তিনি বলেন, "নতুন গবেষণা আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন এনেছে, তবে আলোচনা এখানেই শেষ নয়—এটি চলতে থাকবে।"

আধুনিক জলবায়ু সংকটের শিক্ষা

প্রাচীন নিওপ্রোটেরোজোয়িক যুগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের ধরণ একই রকম কিছু প্রক্রিয়ায় পরিচালিত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO₂) এবং ফিডব্যাক লুপের (feedback loops) ভূমিকা, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি প্রক্রিয়া পৃথিবীর বিদ্যমান জলবায়ু ব্যবস্থাকে আরও তীব্র করে তোলে।

প্রাচীন জলবায়ু পরিবর্তনের নিদর্শনগুলো দেখায় যে ক্লাইমেট টিপিং পয়েন্ট (climate tipping points) কখন এবং কীভাবে ঘটে—অর্থাৎ, যখন নির্দিষ্ট একটি মাত্রা অতিক্রম করা হয়, তখন তা পরিবেশে বিশাল পরিবর্তন নিয়ে আসে যা প্রায়ই অপরিবর্তনীয় হয়ে পড়ে।

তবে, বর্তমানে পৃথিবী দ্রুত উষ্ণ হয়ে উঠছে, বরং ধীরে ধীরে শীতল হচ্ছে না। পৃথিবীর বরফ যুগে পৌঁছাতে মিলিয়ন বছর লেগেছিল, কিন্তু আজকের জলবায়ু পরিবর্তন মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে তীব্র আকার ধারণ করেছে, যা প্রাকৃতিক পরিবর্তনের গতির তুলনায় অনেক দ্রুত, বলেন ড. কার্কল্যান্ড।

তিনি বলেন, "তবে জলবায়ু পরিবর্তনের গতিবিধি বিশ্লেষণ করতে এখনও আমরা CO₂ সঞ্চয়, ফিডব্যাক লুপ এবং টিপিং পয়েন্টের সম্পর্ক বুঝে থাকি।"

ড. কার্কল্যান্ড আরও বলেন, "আমরা দেখতে পাচ্ছি, পৃথিবীর এক অংশ পরিবর্তিত হলে, রাসায়নিক সংযোগের মাধ্যমে অন্যান্য অংশেও পরিবর্তন আসে। পৃথিবীর একটি উপাদান বদলালে, পুরো ব্যবস্থা বদলে যেতে পারে।"

 

সূত্র: সিএনএন

মো. মহিউদ্দিন

×