ছবি: বিবিসি
এটি একটি ফুটবল স্টেডিয়ামের আকারের এলাকা আলোকিত করতে পারত': ১৯৯৩ সালে রাশিয়া কীভাবে একটি বিশাল মহাকাশ আয়না উৎক্ষেপণ করেছিল।
ভ্লাদিমির সিরোমিয়াটনিকভের সাহসী প্রচেষ্টা সাইবেরিয়াকে মহাকাশ আয়নার মাধ্যমে আলোকিত করার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। বিবিসির *Tomorrow's World* একটি উচ্চাভিলাষী পরীক্ষার কথা রিপোর্ট করেছিল, যা ১৯৯৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল।
এটি শুনতে কোনো *জেমস বন্ড* সিনেমার খলনায়কের পরিকল্পনার মতো লাগতে পারে—সূর্যের আলোকে ব্যবহার করে একটি বিশাল আয়না কক্ষপথে পাঠানো, তারপর সেটি প্রতিফলিত করে পৃথিবীর নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আলো পাঠানো। কিন্তু ঠিক এটিই রাশিয়ার মহাকাশ সংস্থা *রসকসমস* ১৯৯৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারিতে বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিল।
কিন্তু রুশ *Znamya* (রুশ ভাষায় অর্থ "পতাকা") প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল না কোনো ধ্বংসাত্মক ষড়যন্ত্র। বরং, এর উদ্দেশ্য ছিল আরও ইউটোপিয়ান। বিবিসির *Tomorrow's World*-এর উপস্থাপিকা কেট বেলিংহাম ব্যাখ্যা করেছিলেন, *Znamya*-এর উৎক্ষেপণের আগে এর লক্ষ্য ছিল **"শীতের অন্ধকার মাসগুলিতে সাইবেরিয়ার আর্কটিক শহরগুলোকে আলোকিত করা"**। মূলত, এটি রাশিয়ার মেরু অঞ্চলে রাতের পর সূর্যকে আবার জ্বালানোর চেষ্টা করেছিল।
১৯২৩ সালে ধারণার জন্ম
এখনও এই ধারণাটি অভিনব মনে হলেও, মহাকাশে আয়না ব্যবহার করে পৃথিবীতে আলো প্রতিফলিত করার ধারণাটি নতুন কিছু নয়। ১৯২৩ সালে, জার্মান রকেট বিশেষজ্ঞ *হারমান ওবার্থ* তার **The Rocket into Planetary Space** বইতে এই ধারণার কথা উল্লেখ করেছিলেন। তার গবেষণাপত্রটি এতটাই অকল্পনীয় বলে মনে হয়েছিল যে হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় সেটি প্রত্যাখ্যান করেছিল।
ওবার্থ গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন কিভাবে একটি রকেট পৃথিবীর কক্ষপথ ছাড়তে পারে। এই বইতে তিনি উল্লেখ করেন যে কক্ষপথে বিশাল আয়না স্থাপন করে পৃথিবীর নির্দিষ্ট অংশে সূর্যালোক প্রতিফলিত করা সম্ভব। তিনি মনে করতেন, এই আলো বিভিন্ন দুর্যোগ প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে—যেমন ১৯১২ সালে *টাইটানিক* জাহাজডুবি প্রতিরোধ করা কিংবা উদ্ধার প্রচেষ্টায় সহায়তা করা। ওবার্থ আরও ধারণা দিয়েছিলেন, মহাকাশ আয়না ব্যবহার করে শিপিং রুট থেকে বরফ গলানো বা আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব হতে পারে।
নাজিদের ‘সান গান’ প্রকল্প
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, জার্মান বিজ্ঞানীরা আবারও এই ধারণাটিকে পুনরুজ্জীবিত করে। *হিলার্সলেবেন* শহরের নাজি গবেষণা কেন্দ্রে বিজ্ঞানীরা **Sonnengewehr** (*সান গান*) নামের এক ভয়ঙ্কর মহাকাশ-অস্ত্র তৈরির পরিকল্পনা করেছিলেন। ১৯৪৫ সালে *Time* ম্যাগাজিন রিপোর্ট করেছিল যে, বন্দী জার্মান বিজ্ঞানীরা মার্কিন গোয়েন্দাদের জানিয়েছিলেন, *সান গান* প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল সূর্যালোক প্রতিফলিত করে শহর পুড়িয়ে ফেলা বা হ্রদের পানি গরম করে ফেলা।
তাদের মতে, এই মহাকাশ অস্ত্রটি ৫০ বছরের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য হতে পারে। যদিও মার্কিন গোয়েন্দারা এটি নিয়ে সন্দিহান ছিলেন, তবুও এই পরিকল্পনাটি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
১৯৭০-এর দশকে ফের নতুন জীবন পেল ধারণাটি
জার্মান-বংশোদ্ভূত আরেক বিজ্ঞানী *ক্রাফ্ট এহরিকি* ১৯৭০-এর দশকে আবারও এই ধারণার প্রতি মনোযোগ দেন। এহরিকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির *V-2 রকেট* প্রকল্পে কাজ করেছিলেন এবং যুদ্ধের পর মার্কিন *অপারেশন পেপারক্লিপ* প্রোগ্রামের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসা হয়।
১৯৭৮ সালে, তিনি *Power Soletta* ধারণাটি উপস্থাপন করেন, যেখানে বিশাল মহাকাশ আয়না ব্যবহার করে কৃষকদের জন্য ২৪ ঘণ্টার আলো সরবরাহ করা বা সৌরশক্তি সংগ্রহ করে পৃথিবীতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলা হয়। যদিও এহরিকি ১৯৮৪ সালে মারা যান, তবুও ১৯৯৭ সালে তার দেহভস্ম মহাকাশে পাঠানো হয় *Star Trek*-এর নির্মাতা জিন রডেনবেরি এবং মনোবিজ্ঞানী *টিমোথি লিয়ারি*-র সাথে।
নাসার আগ্রহ এবং রাশিয়ার উদ্যোগ
১৯৮০-এর দশকে *NASA* কক্ষপথে সৌরশক্তি সংগ্রহের জন্য *Solares* প্রকল্প নিয়ে গবেষণা করে, কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থায়নের অভাবে এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তবে রাশিয়ায় এই ধারণাটি নতুন উদ্যমে গ্রহণ করা হয়।
মহাকাশে পাল তোলা
এ সময়, রাশিয়ান বিজ্ঞানী *ভ্লাদিমির সিরোমিয়াটনিকভ* গবেষণা করছিলেন কিভাবে মহাকাশযানের সাথে বড় প্রতিফলিত সৌর পাল সংযুক্ত করা যায়। সিরোমিয়াটনিকভ মহাকাশ প্রকৌশলের একজন পথপ্রদর্শক ছিলেন। তিনি **Vostok** মহাকাশযানে কাজ করেছিলেন, যা ১৯৬১ সালে *ইউরি গ্যাগারিন*-কে নিয়ে প্রথমবার মহাকাশে গিয়েছিল।
তিনি **APAS (Androgynous Peripheral Assembly System)** নামে এক বিশেষ ডকিং মেকানিজম তৈরি করেছিলেন, যা ১৯৭৫ সালে *Apollo-Soyuz* যৌথ মহাকাশ অভিযানে ব্যবহৃত হয়। পরবর্তীতে, এটি *Mir* স্পেস স্টেশনে এবং বর্তমানে *International Space Station (ISS)*-এ ব্যবহৃত হচ্ছে।
সিরোমিয়াটনিকভ বিশ্বাস করতেন, যদি সৌর পাল একটি মহাকাশযানে যুক্ত করা হয়, তবে সূর্যালোকের ফোটন কণাগুলি আয়নার উপর পড়ে মহাকাশযানকে ধীরে ধীরে ধাক্কা দিয়ে সামনের দিকে চালিত করতে পারে, জ্বালানি পোড়ানোর দরকার ছাড়াই।
কিন্তু ১৯৯০-এর দশকের অর্থনৈতিক সংকটে রাশিয়ায় উচ্চাভিলাষী মহাকাশ প্রকল্পের জন্য তহবিল পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাই সিরোমিয়াটনিকভ তার পরিকল্পনার নতুন দিক উপস্থাপন করলেন—একটি মহাকাশ আয়না তৈরি করা যা রাশিয়ার মেরু অঞ্চলের জন্য অতিরিক্ত সূর্যালোক প্রতিফলিত করতে পারে।
এই ধারণাটি রাশিয়ার সরকার সমর্থন করেছিল। **Space Regatta Consortium** নামে রাশিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থার অর্থায়নে এবং *Roscosmos*-এর তত্ত্বাবধানে সিরোমিয়াটনিকভ *Znamya* প্রকল্পের কাজ শুরু করেন।
১৯৯৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি, রাশিয়া মহাকাশে *Znamya 2* উৎক্ষেপণ করেছিল, যা মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে আলো প্রতিফলিত করতে সক্ষম ছিল। যদিও এই পরীক্ষা পুরোপুরি সফল হয়নি, তবে এটি মহাকাশ বিজ্ঞানে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়।
এই ঐতিহাসিক উদ্যোগটি আধুনিক মহাকাশ প্রকল্পগুলোর জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে আছে এবং ভবিষ্যতে সৌরশক্তির ব্যবহার প্রসারে নতুন দিক উন্মোচন করতে পারে।
সূত্র: বিবিসি
সাজিদ