ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮ মাঘ ১৪৩১

প্রযুক্তি বাজারে ডিপসিক

শেরিফ ফারুকী

প্রকাশিত: ১৯:৩৪, ৩১ জানুয়ারি ২০২৫

প্রযুক্তি বাজারে ডিপসিক

অস্বস্তি নিয়েই শুরু হলো প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় যাত্রা। চীনের এক ছোট্ট প্রযুক্তি কোম্পানি কাঁপিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের টেক হাব সিলিকন ভ্যালির পথঘাট। চীনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ডিপসিক, যা বাজারে আসার পর থেকে প্রযুক্তি জগতকে ভালোরকম ঝাঁকুনি দিয়েছে। মাত্র ৬০ লাখ ডলারের এই প্রযুক্তি সেয়ানে সেয়ানে লড়ছে আমেরিকান চ্যাটজিপিটির সঙ্গে। ডিপসিকের প্রতিষ্ঠাতা লিউ চেং-এর চিন্তা ছিল একটি শক্তিশালী, সাশ্রয়ী এবং সহজলভ্য এআই প্রযুক্তি তৈরি করা। কিন্তু তার হাতে ছিলো না পর্যাপ্ত চিপ, এমনকি নিষেধাজ্ঞার ফলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোনো নতুন চিপও আনা যাচ্ছিলো না। ফলে ভিন্নপথ ধরলেন তিনি। সংগ্রহ করলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এনভিডিয়ার অন্তত ১০০ পুরোনো চিপ, শুরু হলো এনভিডিয়ার চিপ দিয়ে তাদেরকে টেক্কা দেওয়ার খেলা। মাত্র ১ দিনেই ৬০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের বাজার হারালো এনভিডিয়া।

আর্থিক ধাক্কায় মেটা, এনভিডিয়া
পুরোনো এক চিপ ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী এআই প্রযুক্তির নতুন পথ তৈরি করেছে ডিপসিক। যদিও এই চিপের ক্ষমতা সীমিত, তবে ডিপসিক সেগুলো ব্যবহার করে এমন একটি শক্তিশালী মডেল তৈরি করেছে যা এআই জগতে বিস্ময়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৫ সালের শুরুতে ডিপসিক তার ফ্ল্যাগশিপ এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট ‘আর ওয়ান’ উন্মোচন করে, যা বাজারে আসার পরপরই টেক শেয়ারগুলোর দাম কমে যায়। বিশেষ করে এনভিডিয়া, ওপেনএআই, গুগল ও মেটার শেয়ারগুলোতে বড় ধস নামে। যেখানে ওপেনএআই তাদের মডেল তৈরি করতে শত শত কোটি ডলার খরচ করেছে, সেখানে ডিপসিক মাত্র ৬০ লাখ ডলার খরচ করে শক্তিশালী এআই তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। যেখানে অল্প পুঁজিতে বিশাল লাভের দেখা পেয়েছে ডিপসিক, সেখানে ওপেনএআই কোটি কোটি ডলার খরচেও দেখছে না লাভের মুখ।

সমস্যায় জর্জরিত ওপেনএআই
২০২৪ সালে ওপেনএআই এক্সিকিউটিভদের অনেকেই বিদায় নেন পক্ষপাতিত্ব ও সেন্সরশিপের অভিযোগ করে। পক্ষপাতিত্ব বলতে যখন কোনো তথ্য জানতে চায় মানুষ তখন চ্যাটজিপিটি আমেরিকার পক্ষের তথ্য দেয় এবং বিশেষ বিশেষ তথ্যের ক্ষেত্রে সেন্সর করে। তবে একই দৃশ্য চীনা এই চ্যাটবটেও আছে। ১৯৮৯ সালে চীনের তিয়েনআনমেন চত্বরে চলা সপ্তাহব্যাপী গণহত্যায় ছাত্রসহ কয়েক হাজার মানুষের হত্যা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করলে এড়িয়ে যায় ডিপসিক। ক্রমাগত আমেরিকান নিষেধাজ্ঞার ফলে চীনের প্রযুক্তি মার খেয়েছে দীর্ঘ সময়। এখন যেন ফিরিয়ে দেওয়ার সময়। এই প্রতিযোগিতায় চীন তাদের নিজস্ব প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করছে, যাতে তারা ওপেনএআই-এর মতো আমেরিকান কোনো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীল না থাকে। তারা ডিপসিক-এর মতো কোম্পানিকে সরকারি সাপোর্ট দিচ্ছে। ফলে পুরোনো হার্ডওয়্যার দিয়েই নতুন এআই তৈরি করে সক্ষমতা প্রমাণ করেছে ডিপসিক।

কম খরচে বড় লাফ
চ্যাটজিপিটি তৈরি করতে যে ধরনের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে তার ধারে কাছেও ছিলো না ডিপসিক। তাদের উদ্ভাবন ছিল পুরোনো প্রযুক্তি পুনরায় ব্যবহারে সক্ষম করে তোলার অভিনবত্বে। যেমন ইলন মাস্ক রকেটের ক্ষেত্রে করছেন। ডিপসিক মূলত পুরোনো চিপসেট এবং অল্পকিছু চিপ ব্যবহার করে শক্তিশালী একটি আলাপের মডেল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, যাকে চীনের এআই বিপ্লব হচ্ছে। আর চ্যাটজিপিটির ক্ষেত্রে একাধিক উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন হার্ডওয়্যার এবং বিশাল পরিমাণে ডেটার মাধ্যমে প্রশিক্ষিত মডেল কাজ করে থাকে। ওপেনএআই প্রযুক্তিগতভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন, যেমন কোডিং, লেখালেখি, এবং সাধারণ কথোপকথনের জন্য বিখ্যাত। সে জায়গায় ভাগ বসাচ্ছে পুঁচকে ডিপসিক। এবং ভাগটা ক্রমশই বাড়ছে। কেমন বাড়ছে হিসাবটা দেখুন, ১০ জানুয়ারি ডিপসিক আসার প্রথম দিনেই চ্যাটজিপিটির কোর অর্গানাইজেশন এনভিডিয়া ৬০০ কোটি ডলার লস করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শেয়ারের দাম কমে গেছে ১৭ শতাংশ। দেশটির ইতিহাসে কোনো কোম্পানির এটাই সর্বোচ্চ পতন।

শুরুটা বিতর্কিত ডিপসিকের
চ্যাটজিপিটি-ওপেনএআই দাবি করছে, ডিপসিক তাদের মডেলের হুবহু নকল তৈরি করছে, যা আইনের লঙ্ঘন। এখানে বলে রাখা ভালো, ডিপসিক কিংবা চ্যাটজিপিটি উভয়েই আমাদের তথ্য নিয়ে এরপর কাজ করে।
তো চ্যাটজিপিটি দাবি করছে, ডিপসিকের হাতে এতো তথ্য থাকার কথা না, তারা তথ্য চুরি করছে। এক্ষেত্রে ওপেনএআই এর এপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস ব্যবহার করেছে। এ বিষয়ে তদন্তও শুরু করেছে মার্কিন সরকার।
প্রমাণিত হলে যুক্তরাষ্ট্রে কপিরাইট আইন লঙ্ঘনের দায়ে দেশটিতে নিষিদ্ধ হতে পারে ডিপসিক।
ওপেনএআই আরো দাবি করেছে, ডিপসিক তাদের প্রযুক্তি  চুরি করেছে ডিস্টিলেশন টেকনিকের মাধ্যমে। ডিস্টিলেশন টেকনিক এমন একটি পদ্ধতি যেখানে একটি ছোট এআই মডেলকে বড় মডেলের মতো কাজ শেখানো হয়।

যা বলতে চায় না ডিপসিক
যা আগেই বলেছি, ১৯৮৯ সালের ৪ জুন তিয়ানানমেন স্কোয়ারে কী হয়েছিল জিজ্ঞেস করলে ডিপসিক উত্তর দেয়: ‘আমি দুঃখিত, আমি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো না। আমি একজন এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং আমাকে এমন উত্তর দেয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে যা সহায়ক এবং ক্ষতিকর নয়।’ বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান কে? উত্তর হিসেবে আসে, ‘২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে জুলাই ২০২৪-এর পরের তথ্য আমার ডেটাবেজে নেই।’ এর মানে হচ্ছে নির্ভরযোগ্য তথ্য দিচ্ছে না ডিপসিক।
একইসাথে নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপারে তারা মুখ বন্ধ রাখে। তিয়েনআনমেন এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কে না জানার ভান করে চীনের এই অ্যাপ। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কে প্রশ্ন করলে উত্তর দিয়েছে, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান’ নামে কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য নয়।’
অর্থাৎ চীনা প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন অ্যাপ হওয়ায় চীন যেসব বিষয়কে রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল মনে করে, সেসব বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ক্ষেত্রে এই এআই চ্যাটবট শতভাগ সঠিক হবে না। ফলে বিতর্ক সঙ্গী করেই জন্ম হলো ডিপসিকের।

×