চীনা এআই কোম্পানি ডিপসিক সম্প্রতি মার্কিন বাজারে তাদের ডিপসিক-আর১ মডেল উন্মোচনের পর প্রযুক্তি জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এটি অ্যাপল অ্যাপ স্টোরের শীর্ষস্থানীয় ফ্রি অ্যাপের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। মার্কিন কোম্পানিগুলোর তুলনায় অত্যন্ত কম খরচে তৈরি এই এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট এআই শিল্পের অর্থনৈতিক ভারসাম্যে বড় পরিবর্তন এনেছে।
ডিপসিকের তৈরি ডিপসিক-আর১ চ্যাটবট মুক্তি পাওয়ার পরপরই অ্যাপল অ্যাপ স্টোরে সর্বাধিক ডাউনলোড হওয়া ফ্রি অ্যাপের শীর্ষে উঠে আসে। এটি মার্কিন এআই কোম্পানিগুলোর তুলনায় অনেক কম ব্যয়ে তৈরি হওয়ায় সিলিকন ভ্যালির প্রতিষ্ঠিত প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চ্যাটজিপিটি তৈরিতে শতকোটি ডলার ব্যয় হলেও, ডিপসিক মাত্র ৬০ লাখ ডলারে তৈরি হয়েছে। এটি তুলনামূলক কম দামি ও সহজলভ্য চিপ ব্যবহার করে, যেখানে চ্যাটজিপিটি শক্তিশালী ও ব্যয়বহুল এনভিডিয়া চিপসেটের ওপর নির্ভরশীল। চ্যাটজিপিটি তুলনামূলকভাবে উন্মুক্ত হলেও, ডিপসিক বিশেষ করে চীনের রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল বিষয়গুলো এড়িয়ে চলে।
ডিপসিকের সাফল্যের ফলে এনভিডিয়ার বাজারমূল্য একদিনে ৬০০ বিলিয়ন ডলার কমে গেছে, যা এআই চিপ ব্যবসার জন্য নতুন সংকেত বহন করে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের এআই নেতৃত্ব প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।
ডিপসিকের উত্থান এআই প্রতিযোগিতায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। কম খরচ, ওপেন-সোর্স মডেল এবং দ্রুত জনপ্রিয়তা এর মাধ্যমে একটি নতুন প্রতিযোগিতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, চ্যাটজিপিটি কি নেতৃত্ব ধরে রাখতে পারবে, নাকি ডিপসিক নতুন আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে।
ডিপসিকের প্রতিষ্ঠাতা লিয়াং ওয়েনফেং তার হেজ ফান্ডের মূলধন ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটি চালু করেন। বলা হয়, তিনি এনভিডিয়ার ৫০ হাজারের বেশি A100 চিপ সংগ্রহ করেছিলেন, যা চীনে রপ্তানি নিষিদ্ধ। তুলনামূলক কম ব্যয়বহুল চিপের সঙ্গে এই চিপগুলো সংযুক্ত করেই ডিপসিক একটি শক্তিশালী এআই তৈরি করেছে। এর ফলে বিশাল বাজেট ও উচ্চমানের চিপ ছাড়াও এআই বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সম্ভব—এটি প্রমাণ করেছে ডিপসিক।
ডিপসিকের এই সাফল্য মার্কিন টেক ইন্ডাস্ট্রিতে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। ২৭ জানুয়ারি ডিপসিকের কম খরচের এআই মডেল প্রকাশিত হওয়ার পর চিপ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বিশেষ করে, মার্কিন চিপ জায়ান্ট এনভিডিয়ার শেয়ার মূল্য একদিনে ৬০০ বিলিয়ন ডলার কমে যায়, যা মার্কিন ইতিহাসে একদিনের সর্বোচ্চ লোকসানের রেকর্ড। এনভিডিয়া এতদিন বাজারমূল্যে বিশ্বের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান থাকলেও, এই পতনের ফলে তারা অ্যাপল ও মাইক্রোসফটের পর তৃতীয় স্থানে নেমে আসে।
যদিও ডিপসিকের জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তবে এর সেন্সরশিপ নীতির কারণে কিছু উদ্বেগও রয়েছে। কিছু ব্যবহারকারী জানিয়েছেন, সাইন-আপ প্রক্রিয়ায় সমস্যা হচ্ছে। পাশাপাশি, রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর প্রশ্নের উত্তর দিতে ডিপসিক অপারগ।
ডিপসিকের সাফল্য এআই শিল্পের প্রচলিত ধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করছে। এতদিন মনে করা হতো, উন্নত এআই তৈরি করতে উচ্চমানের চিপ ও বিশাল বাজেট অপরিহার্য। তবে ডিপসিক প্রমাণ করেছে, স্বল্প ব্যয়ে কার্যকর এআই মডেল তৈরি করা সম্ভব। বিশ্লেষকদের মতে, এই সাফল্য এআই প্রতিযোগিতায় চীনকে এগিয়ে দিতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি আধিপত্যের ভারসাম্য পরিবর্তন করতে পারে।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এআই প্রতিযোগিতা এখন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। ডিপসিকের মতো স্বল্প খরচে তৈরি শক্তিশালী এআই মডেলের উত্থান ভবিষ্যতে গ্লোবাল টেক ইন্ডাস্ট্রির দিকনির্দেশনা পরিবর্তন করতে পারে। তবে সেন্সরশিপ ও রাজনৈতিক প্রভাব এআই-এর নিরপেক্ষতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তৈরি করেছে, যা ভবিষ্যতে আরও বিতর্কের জন্ম দিতে পারে।
আফরোজা