.
পৃথিবীতে শান্তির ধারণা একেক জনের কাছে একেকরকম। আর এ কারণেই একজনের কাছে যা ‘শান্তি’, অন্যজনের কাছে তা-ই প্রাণহানির কারণ। একজনের কাছে যা সার্বভৌমত্ব রক্ষার আন্দোলন, অন্যের কাছে তা-ই আবার স্বাধীনতা আন্দোলন! প্রাচীনকাল থেকে বিজ্ঞানী ও গবেষকরা যুদ্ধে সহায়ক মারাত্মক সব আবিষ্কার করে আসছেন। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রজেক্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে যার ভয়াবহতা দেখেছে বিশ্ববাসী। সভ্যতার শুরু থেকে অনেক বিজ্ঞানী স্বেচ্ছায় অস্ত্র তৈরিতে সাহায্য করেছেন। তবে সামরিক এসব মারণাস্ত্রের জন্য মানব সভ্যতার এমন করুণ পরিণতি হয়তো চাননি তারা।
আলফ্রেড নোবেল
আলফ্রেড নোবেলের নামে বিভিন্ন খাতের পাশাপাশি শান্তি পুরস্কারও দেওয়া হয়। তবে এই বিজ্ঞানীর আবিষ্কার আজকের দিনের যুদ্ধক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। নোবেল এবং তার বাবার কারবারই ছিল গোলাবারুদ, বোমা, ডিনামাইট তৈরি। আলফ্রেডের বাবা যখন ক্রিমিয়া যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য প্রথম সামুদ্রিক খনি আবিষ্কার করেছিলেন, পরে তা ডিনামাইট হিসেবে ব্যবহার হয়েছিল। এরপর ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধের উভয় পক্ষের সৈন্যরা এই বিস্ফোরকদ্রব্য ব্যবহার করেছিল। আলফ্রেড নোবেল নিজেও একাধারে একের পর এক বিস্ফোরক ও যুদ্ধাস্ত্রের উপাদান আবিষ্কার করেছেন, সারা ইউরোপে বিরাট বিরাট কারখানা গড়ে তুলে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ উপার্জন করেছেন। তবে এই বিজ্ঞানীর ভাষ্য, যুদ্ধক্ষেত্রে এর ব্যবহার নাকি অনিচ্ছাকৃত! ১৮৮৮ সালে ব্যালিস্টাইট তৈরির সময় তিনি ভালো কোনো অজুহাত খুঁজে পাননি। আলফ্রেড বলেছিলেন, এটি ধোঁয়াবিহীন গানপাউডার, যা তিনি বিক্রি করতেন। তিনি দাবি করেছিলেন, সৈন্যদের সাহায্যের জন্য তিনি এতে কাজ করেননি।
নিকোলা টেসলা
নিকোলা টেসলা অলটারনেটিং কারেন্ট ও অন্যান্য বৈদ্যুতিক উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করে সফলতা পেয়েছিলেন। তার আবিষ্কারের মধ্যে একটি ব্যতিক্রমী আবিষ্কার ছিল ‘মৃত্যুরশ্মি’। ১৯১৫ সালে নিউইয়র্ক টাইমসের এক শিরোনামে এই প্রকল্প সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। এই সমরাস্ত্রে থরের মতো শক্তির বোল্টগুলোকে গুলি করবে কিন্তু বিদ্যুতের পরিবর্তে এতে ২ লাখ ৭০ হাজার মাইল বেগে ধাতব আয়রন বিম তৈরি করবে। টেসলা এই রশ্মির নাম দিয়েছিলেন ‘শান্তির রশ্মি’। টেসলা দাবি করেছিলেন যে, এটি ২৫০ মাইল (৩৮৬ কিলোমিটার) দূর থেকে যুদ্ধবিমান ধ্বংস করতে পারবে। বিশ্লেষকদের মতে, পৃথিবী গোল না হয়ে সমতল হলে এই রশ্মি পৃথিবীর পরিধি ভেদ করে যেতে পারত সুদূরে।
টমাস আলভা এডিসন
টমাস আলভা এডিসনের মতো সফল মানুষ ইতিহাসে বিরল। বৈদ্যুতিক বাতি, সাউন্ড রেকর্ডিং, ভিডিওগ্রাফির মতো আবিষ্কারসহ মোট ১ হাজার ৯৩টি আবিষ্কারের পেটেন্ট রয়েছে এই বিজ্ঞানীর নামে। এডিসন এমন একজন উদ্ভাবক ছিলেন যে, তার অনেক ধারণার মধ্যে অস্ত্র খুঁজে পাওয়া খুব একটা আশ্চর্যের বিষয় নয়, যার মধ্যে বিখ্যাতভাবে আলোর বাল্ব, ফোনোগ্রাফ এবং মোশন-পিকচার ক্যামেরা অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশের ক্ষেত্রে আমেরিকা তাদের সশস্ত্র বাহিনীকে প্রস্তুত হওয়ার জন্য প্রকাশ্যে আহ্বান জানানোর পর তাকে নৌ-পরামর্শ বোর্ডের প্রধান করা হয়। এর আগে এডিসন স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধে নৌবাহিনীকে সাহায্য করেছিলেন। বোর্ড সশস্ত্র বাহিনীর কাছে জমা দেওয়া ধারণাগুলো পর্যালোচনা ও পরীক্ষা করে থাকে। সেই সঙ্গে তাদের নিজস্ব অবদান রাখে। ব্যক্তিগতভাবে এডিসন যুদ্ধে প্রায় ৪৯টি ধারণা নিয়ে কাজ করেছিলেন। সে সময় অনেকে প্রতিরক্ষামূলক এবং শত্রু শনাক্তকরণে মনোযোগী হলেও এডিসন এমন ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে সাহায্য করেছিলেন, যা ভূপৃষ্ঠ থেকে সমুদ্রে শত্রুর ঘাঁটিতে হামলা চালাতে পারে। এ ছাড়া তিনি সেনাবাহিনীর জন্য আর্টিলারি শেল তৈরি করেন, যা বাতাসে বিস্ফোরিত হয়, আরও ধ্বংসাত্মক করে তোলে।
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিকে সবাই বিখ্যাত শিল্পী হিসেবেই চেনেন। মোনালিসা ও লাস্ট সাপারের মতো ছবি এঁকেছেন তিনি। তবে তার অন্য একটি পরিচয়ও রয়েছে, তিনি একজন প্রতিভাবান প্রকৌশলী ছিলেন। প্রচুর আগ্নেয়াস্ত্রের পরিকল্পনাও করেছিলেন। যদিও তৎকালীন মিলানের ডিউকের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি এটি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কারণ, তার জীবদ্দশায় ইতালি ঐক্যবদ্ধ দেশ হিসেবে কম এবং বিরোধপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে বেশি পরিচিত ছিল। সে হিসেবে যুদ্ধ তখন অস্বাভাবিক ছিল না। তার উদ্ভাবনগুলোর মধ্যে ট্যাঙ্কের উদাহরণও খুঁজে পাওয়া যায়, যেখানে আটজন ক্রু কয়েকটি কামান নিয়ে অবস্থান করছিল। এটি যেদিকে সরে যাবে, সেখানেই গুলি করতে পারবে। মনে করা হয়, ভিঞ্চি এই যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণে ইচ্ছাকৃত ত্রুটি রেখে নকশা করেছিলেন। ফলে এটি কম সরানো যেত এবং কম ধ্বংসাত্মক ছিল। তার নকশাকৃত আরও একটি অস্ত্র সম্ভবত যুদ্ধেও ব্যবহার করা হয়েছিল।
ম্যারি কুরি
পৃথিবীখ্যাত নারী বিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রথমেই আসে ম্যারি কুরির নাম। যে সময়টাতে সারা পৃথিবীতে মেয়েরা ছিল অনেক পিছিয়ে, সে সময় ম্যারি কুরি বিশ্ববাসীকে এনে দিয়েছেন অসংখ্য অর্জন। পোল্যান্ডে জন্ম নেওয়া ম্যারি দুটি উপাদানের আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। প্রথমবার নোবেল পেয়েছিলেন পদার্থবিজ্ঞানে। রেডিয়ো অ্যাক্টিভিটি বা তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে গবেষণার জন্য। মাত্র ৮ বছর পর দ্বিতীয় নোবেল পান রসায়নে। রেডিয়াম এবং পোলোনিয়াম আবিষ্কারের জন্য। আর এই দুটি উপাদানই সামরিক যানসহ ঘড়ি, বিমানের সুইচ এবং যন্ত্রের ডায়ালগুলোতে ব্যাপকভাবে প্রয়োগ হয়ে থাকে। তৎকালীন লোকেরা ১৯৬০ এবং ১৯৭০ এর দশকে এটি ব্যবহার করা বন্ধ করে দেয় যখন তারা বুঝতে পেরেছিল, এটি তাদের স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক। এই আবিষ্কারে ম্যারি কুরি ও তার স্বামী পেয়েরি কুরিও স্বাস্থ্যগত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। আর রেডিয়াম আবিষ্কারের কোনো পেটেন্ট করেননি তারা। সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের বিনামূল্যে জানিয়ে দেন রেডিয়াম সংগ্রহের উপায়।