.
২০২৪ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেলেন মার্কিন বিজ্ঞানী জন জে হপফিল্ড ও কানাডিয়ান বিজ্ঞানী জেফরি ই হিন্টন। ২০০১ সাল থেকে শুরু হওয়া নোবেল পুরস্কারে পদার্থ বিভাগে এখন পর্যন্ত নোবেল পেয়েছেন ২২৬ বিজ্ঞানী। এবার সেই লিস্টে ঢুকে গেল হপফিল্ড ও হিন্টনের নাম। এই দুই অধ্যাপক নোবেল পেয়েছেন কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মেশিন লার্নিং সম্ভব করে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবনের জন্য। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন- শেরিফ ফারুকী
চ্যাটজিপিটিসহ আরও আরও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সিস্টেম এবারের নোবেল কমিটির কাছে গুরুত্ব পেয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মিডজার্নি কী করে? একটা ছবি সম্পর্কে আপনি কিছু ইনপুট দিলেন। তারপর সে ভাবে ছবিটা কেমন হবে। এসব কিভাবে করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা? কম্পিউটার তো চিন্তা করতে পারে না। তাহলে? তাহলে কম্পিউটারকে শেখাতে হবে মেশিন লার্নিং। মেশিন বা যন্ত্রকে বিশেষ সিস্টেমে শেখাতে হয়। সাধারণভাবে যেকোনো যন্ত্রকেই তো শেখানো বা বলে দেওয়া হয়, কিভাবে কাজ করতে হবে। সাধারণ সফটওয়্যার বা প্রোগ্রামের সঙ্গে মেশিন লার্নিংয়ের পার্থক্য হলো, সাধারণ প্রোগ্রামিংয়ের ক্ষেত্রে যন্ত্র কী কী করবে, ধাপে ধাপে সব বলে দিতে হয়। আর মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে অনেক উদাহরণ দেওয়া হয়। এসব উদাহরণ বিশ্লেষণ করে প্রোগ্রামটি নিজে নিজে শিখে নেয়, কিভাবে কী করতে হবে। মেশিন লার্ন করে বা শেখে এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এটাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এবারের নোবেল এই প্রক্রিয়াকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে, অনেক দূর।
হপফিল্ডের নামে এই সিস্টেমের নাম ‘হপফিল্ড নেটওয়ার্ক’। ধরে নিন, এই নেটওয়ার্ককে একটা ঝাপসা বা অসমাপ্ত ছবি দেওয়া হলো যার কিছু পিক্সেল মিসিং। নেটওয়ার্কটা এখন কাজ করবে, চেষ্টা করবে ছবিটাকে পূর্ণতা দিতে। কিভাবে দেবে? এটি বিভিন্ন ধরনের পিক্সেল মিলিয়ে পুরো নেটওয়ার্কের শক্তি যে পিক্সেলের জন্য সর্বনি¤œ হয়, সেই পিক্সেলটা বেছে নেবে। সেই পিক্সেলটা বসাবে একটা মিসিং পিক্সেলের জায়গায়। এভাবে ধাপে ধাপে এটি বারবার নতুন পিক্সেল তৈরি করে, তা সঠিক জায়গায় বসিয়ে বসিয়ে ঝাপসা বা অসমাপ্ত ছবিটিকে সম্পূর্ণ ছবিতে রূপান্তর করে। এই কাজটা তো কোনো ফটো তোলার দোকানেও হয়, তাহলে এখানে বিশেষত্ব কী? এখানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজটা হবে। প্রোগ্রামই বুঝে নেবে কিভাবে কি করতে হবে।
মেশিন লার্নিংয়ের একটা বিশেষ পদ্ধতি আছে। মানুষের মস্তিষ্ক যেভাবে কাজ করে, যন্ত্রকে ঠিক সেভাবেই শিক্ষা দেওয়া হয়। এটাকেই বলা হয় কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক। এ প্রযুক্তি তৈরি করা হয়েছে আমাদের মস্তিষ্কের গঠন অনুসরণ করে। আমাদের মস্তিষ্কের কোষগুলোর নাম নিউরন। শতকোটি নিউরন পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বুদ্ধিমত্তা এবং স্মৃতি সংরক্ষণব্যবস্থা তৈরি করে। কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কে মস্তিষ্কের নিউরনের আদলে তৈরি করা হয় একেকটি নোড। নিউরনের মতো প্রতিটি নোড হয় আলাদা মান ও বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। প্রতিটি নোড পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পরস্পরকে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য দিয়ে প্রভাবিত করে। মস্তিষ্কের মতোই পুরো নেটওয়ার্কটি মিলে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
হপফিল্ড ১৯৮২ সালে ও হিন্টন ১৯৮৬ সালে এই বিষয়ক গবেষণা শুরু করেন। এরমধ্যে পৃথিবী কত বদলে গেল। সেই গবেষণার হাত ধরে এলো চ্যাটজিপিটি। সময়ের হিসেবে পেরিয়ে গেল প্রায় ৪০ বছর। নোবেল কমিটি পুরস্কার দেওয়ার সময় বলেছে এই মেশিন লার্নিং কেমন পাল্টে দিতে পারে মানবসভ্যতা। তারা বলেছে, ‘জন হপফিল্ড এমন একটি অবকাঠামো বানিয়েছেন, যা তথ্য জমা করে রাখার পাশাপাশি আবার পুনর্গঠন করতে পারে। এটা সামনের দিনে আমাদের অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।’
অন্যদিকে অধ্যাপক জেফরি হিন্টন এই হপফিল্ড নেওয়ার্ক ব্যবহার করে নতুন এক ধরনের নেটওয়ার্ক তৈরি করেন। এই নেটওয়ার্ককে বলা হয় ‘বোলজম্যান মেশিন’। এই মেশিন সিস্টেম ডেটা বা তথ্যের মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ও প্যাটার্ন আলাদা করা শিখতে পারে। এ কাজে হিন্টন ব্যবহার করেন পরিসংখ্যানগত পদার্থবিদ্যা বা স্ট্যাটিস্টিক্যাল ফিজিকস। বোলজম্যান মেশিনকে একগাদা উদাহরণ ইনপুট হিসেবে দেওয়া হয়। এবার টেস্ট বা পরীক্ষার জন্য কোনো ছবি দিলে সেই ছবিটা কোন ক্যাটাগরি বা বিভাগের, সেটা আলাদা করতে পারে বোলজম্যান মেশিন। আবার প্যাটার্ন অনুসারে অসমাপ্ত ছবিকে সম্পূর্ণ করতে পারে কিংবা বানাতে পারে নতুন ছবিও।
বর্তমানে যন্ত্র যে শিখছে, কথা বলছে, ছবি আঁকছে, এসবেরই ভিত্তি গড়ে দিয়েছেন এবারের দুই নোবেলজয়ীÑ জন জে হপফিল্ড ও জেফরি ই হিন্টন। আজকের এই বৈপ্লবিক এআইয়ের দুনিয়ায় বসে তাদের কাজের গুরুত্ব বোধহয় আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই। নোবেল কমিটি ফর ফিজিকসের চেয়ারম্যান এলেন মুনস বলেন, ‘পদার্থবিজ্ঞানে আমরা বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নতুন কোনো পদার্থ তৈরি বা বড় কিছু যদি করতে চাই, সে ক্ষেত্রে কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক নানাভাবে আমাদের সাহায্য করতে পারে।’
হপফিল্ড নেটওয়ার্কের ওপর কাজ করা হিন্টন আগে গুগলে কাজ করতেন। ২০২৩ সালে চাকরি ছেড়ে গবেষণায় মন দেন। বর্তমানে তিনি টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত।
আর হপফিল্ড আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। এআইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী হিন্টন। তিনি বলেন, ‘আজকের দিনে এআইয়ের এই প্রসারকে শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে তুলনা করলেও ভুল হবে না। শুধু তফাতটা হলো, সে সময় শারীরিক কর্মক্ষমতায় মানুষকে ছাপিয়ে গিয়েছিল যন্ত্র। আর এখন ছাপিয়ে যাবে বুদ্ধিমত্তাতেও। আমার বিশ্বাস, শীঘ্রই মানুষকে হারিয়ে দেবে কম্পিউটার।’ কিন্তু মানুষ শিখেছে দূরন্ত ঘোড়ার মুখে লাগাম লাগিয়ে পোষ মানানো, শিখেছে আগুন নিয়ন্ত্রণ। কখনো মানুষকে হারিয়ে দিলে বিজ্ঞানীরাই পথ দেখাবেন কিভাবে লাগাম টানতে হয়। সামনের যুগটা হয়তো কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তারই হবে। তবে যুগটা সম্ভাবনারও।